আজ বিশ্ব সুখ দিবস। 

সমাজে কিছু দরিদ্র মানুষ আছে যাদের টাকা ছাড়া আর কিছুই নেই। দিন দিন এদের সংখ্যা বেড়েই চলছে।

টাকা ও দুনিয়াবি আবর্জনা ছাড়াও সুখের যে আরও কত উপকরণ চারিদিকে ছড়ায়ে আছে তা উপলব্ধি করার চেতনা আমরা হারায়ে ফেলেছি। 

ভোগবাদ ও তথাকথিত আবিষ্কারের উন্নতি আমাদেরকে স্থুলতর করে ফেলেছে। বিজ্ঞান চলে গেছে মাড়োয়ারির হাতে। পুঁজি আর মুনাফা হচ্ছে উপাসনালয় ও মন্ত্র। এর “নিগড় গড়ি চরণে পরিলি সাধে কি ফল লভিনু তাই ভাবি মনে” র মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে গেছি আমরা। 

সুখকে সংজ্ঞায় সীমাবদ্ধ করতে চাওয়াই হচ্ছে প্রথম শ্রেণীর নির্বুদ্ধিতা। 

মহাভারত’-এর বনপর্বে পঞ্চ পাণ্ডবের অন্যতম ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের প্রতি বকরূপী যক্ষের ইন্টারভিউয়ের শেষ প্রশ্ন ছিলঃ এ জগতে সুখী কে? 

ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির উত্তরে বলেছিলেনঃ “অঋণী, অপ্রবাসী অবস্থায় যে ব্যক্তি দিন শেষে  শাকান্ন ভক্ষণ করে, সে-ই প্রকৃত সুখী।

দুইজন মানুষের সুখের উপাচার ও অনুভূতি এক রকম না। কারণ পৃথিবীর লোক সংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি এবং সুখের সংজ্ঞাও কমবেশি ৮০০ কোটি রকমের। 

৫০০০ বৎসরের প্রাচীন গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস থেকে শুরু করে বারট্রান্ড রাসেল হয়ে আজকের  জোসে ওর্তেগা গ্যাসেট সহ বহু দার্শনিক সুখ নিয়ে কথা বলেছেন। 

সুখের গোপন রহস্য বেশী চাওয়ার মধ্যে না বরং কম ভোগ করার মানসিকতা তৈরি ও সেভাবে অভ্যাস গড়ে তোলার মধ্যে। 

কামনা বাসনায় ঘৃতাহুতি না দিয়ে এগুলকে গলা টিপে বসে আনার মধ্যেই আছে সুখের চাবি।

দুঃখ কলিজায় গর্ত না খুঁড়লে সুখ বাসা বাধবে কোথায়? 

জেরেমি মেন্থাম অবশ্য অন্য সংজ্ঞা দিয়েছেন যদিও অঙ্ক করে সুখ মাপা যায় না। তিনি বলেন, “কোন কাজ থেকে ভোগান্তি বাদ দিলে যে টুকু অবশিষ্ট থাকে তাই সুখ।”

তাই কি সুখ? 

এপিকিউরাস অবশ্য পার্থিব বিষয়কে এড়িয়ে যান নাই।তাঁর মতে দুনিয়াবি বিষয়-আশয় সুখের অণুঘটক। 

ফ্রেড্রিক  নিতসে  সুখকে চঞ্চল বলেছেন। বলেছেন, ”সুখ অলসতার এক আদর্শ অবস্থা যেখানে কোন উদ্বেগ ও মর্মযাতনা নেই।” 

কল্পিত জীবন ও বাস্তব জীবনের সঙ্গমস্থলকেই সুখ বলে। 

স্লাভজ জিজেক একটু আগিয়ে বলেন, “সুখ এক অনুকূল ‘ধারণা’, কোন সত্য না।”  

সুতরাং কোনো বস্তু দিয়ে ‘ধারণা’ মাপা যায় না। তবে মানুষের চঞ্চলমতি মন বাচ্চাদের মতো মনমতো কিছু পেলে তাৎক্ষণিক আনন্দে উল্লসিত হয়ে পড়ে যা ক্ষণস্থায়ী। এর উপযোগিতা শেষ হলেই  “হেথা নয় হোথা নয় অন্য কথা অন্য কোন খানে’র” মতো মন অস্থির হয়ে ওঠে।  

পৃথিবীতে এমন বৃক্ষ নেই যাকে ঝড় ঝঞ্ঝা বাতাস বিদ্যুৎ আন্দোলিত ও মথিত করে নাই। সুতরাং জাগতিক জীবনে পাওয়া না পাওয়ার অভিঘাত থাকবেই। 

প্রশান্ত অন্তর যে কোন স্থানেই আনন্দ সুখ উদযাপন অনুভব করেন।

সুতরাং সহজ পথ হচ্ছে পাঠের অভ্যাস গড়ে মনকে প্রশান্ত করা ও সে অনুযায়ী কর্ম করে যাওয়া।

সুখ আসলে অন্যকে সুখী করার মধ্যেই নিহিত। চারপাশের মানুষ ও পৃথিবীকে সুখী দেখলেই সুখ অনুভব অনেক সহজ। ব্যাক্তিগত ও বৈশ্বক সুখ একই সুত্রে গাঁথা। স্রষ্টাও মহাবিশ্বে থাকলেও অণুতেই তাঁর অনুরণন।  

“পরের কারণে স্বার্থে দিয়া বলি

        এ জীবন মন সকলি দাও,

তার মত সুখ কোথাও কি আছে?

        আপনার কথা ভুলিয়া যাও।”- কামিনী রায় 

গাছ কাউকেই ছায়া থেকে বঞ্চিত করে না এমন কি যে কাঠুরিয়া একটু পরে গাছের মুলে কুঠারাঘাত করবে  সেই কাঠুরিয়াকেও ছায়া থেকে বঞ্চিত করে না। তাহলে আমরা সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে কেন অন্যের জীবনের দ্বীপ জ্বালানোর রসদ হতে পারি না? পারলেই সুখ অনুভবে এসে স্থির হবে। সুখ আসলে গতকাল বপন করা বীজ থেকে উৎপন্ন ফসল। 

“ধন রত্ন সুখৈশ্বর্য কিছুতেই সুখ নাই,

সুখ পর-উপকারে, তারি মাঝে খোঁজ ভাই!”- কায়কোবাদ

রজনীকান্ত সেন যখন গলায় ক্যান্সার আক্রান্ত হলেন, ক্রমে ক্রমে কথা বলার শক্তি হারালেন তখনও তিনি এটাকে স্রষ্টার পক্ষ থেকে মঙ্গলের সিদ্ধান্ত মনে করে এই অমর গানটা লিখলেনঃ

“আমায় সকল রকমে কাঙাল করেছে

গর্ব করিতে চুর

তাই যশ, অর্থ, মান, স্বাস্থ্য

সকলি করিছে দূর

বুঝিয়া দয়াল ব্যাধি দিল মোরে

বেদনা দিলো প্রচুর।

পবিত্র কোরানে সুখ দুঃখের বিষয়ে বলা হয়েছেঃ

‘কষ্টের সঙ্গেই তো স্বস্তি আছে, অবশ্যই কষ্টের সঙ্গেই স্বস্তি রয়েছে। ‘ (সুরা ইনশিরাহ, আয়াত: ৫-৬)।

বাগদাদের মনান্তরের সময়ে বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহঃ) এবাদতের বাইরেও পথে ঘাঁটে এমনকি মসজিদের দেয়ালে হেলান দিয়ে ক্রমাগত তেলাওয়াত করে যেতেন  “ফাইন্না মাআল উসরে ইউসরা, ইন্না মাআল উসরে ইউসরা।” 

হাদিসে এসেছেঃ “আল্লাহর ভয়ে তুমি যা কিছু ছেড়ে দিবে, আল্লাহ্ তোমাকে তার চেয়ে উত্তম কিছু অবশ্যই দান করবেন।” সুতরাং দুনিয়াবি শান শওকতের লালসায় ক্লান্ত কুকুরের মতো জিব্বহা লম্বা করে লাভ কি? জীবন শেষে তো অনেককেই পরকালমুখী হয়ে উৎকণ্ঠায় মুহূর্ত পার করতে হয়। 

ইমাম ইবনুল কাইয়ামাহ সুখ সন্ধানে আল্লাহ্‌র উপর তাওয়াক্কুলকে প্রাধান্য দিয়েছেনঃ

“আল্লাহর কাছে আপনি প্রার্থনা করা বন্ধ করে দিলে তিনি রাগান্বিত হন। অথচ আদম সন্তানের কাছে কিছু প্রার্থনা করলে সে রেগে যায়।” 

সুতরাং যতটুকু আছে তাই নিয়ে খুশী থাকার মতো সুখ আর নাই। সুস্থ দেহ যে কত বড় সম্পদ ও নেয়ামত তা বুঝতে হলে মাঝে মধ্যে হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ। লালসা খাটো হয়ে আসবে। 

আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরানে বলেন,” লাএন শাকারতুম, লাজীদান্নাকুম। ওলা এনকাফারতুম, ইন্না আজাবি লাশাদিদ।”- যদি তোমরা শোকর কর তাহলে আমার নেয়ামত বাড়ায়ে দেব। আর যদি কুফরি কর তাহলে জেনে রাখো, আমার শাস্তি কঠোর, কঠিন। 

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন ও তাঁর নেয়ামতের শোকর আদায় করা তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন। 

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *