তওবাতূন নসূহা ও তওবা কবুলের বাহ্যিক নিদর্শন।

“ইয়া আইয়ূহাল্লাজীনা আমানু তুবু ইলাল্লাহ তওবাতূন নসূহা” – সূরা তাহরিম । আয়াত-৮
মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ্ তায়ালার কাছে তওবা করো-আন্তরিক তওবা ।

আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী বুৎপত্তিগত ভাবে ‘নসূহা’ শব্দটি দুইটি অর্থ বহন করে ১) খাটি করা ২) কাপড় সেলাই করা ও কাপড়ে তালি দেওয়া ।প্রথম অর্থ অনুযায়ী ‘নসুহা’ এমন তওবা যা রিয়া ও সুনাম, যশের প্রলোভন মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন ও পরকালের আযাবের ভয়ে ভীত হয়ে, গোনাহের কারণে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করা ।

দ্বিতীয় অর্থ অনুযায়ী গোনাহের কারণে “সৎকর্ম-রূপ-কাপড়” ছিদ্র হয়ে যায় । তওবা সেই কাপড়ের ছেড়া জায়গা গুলো তালী দিয়ে ঠিক করে দেয় ।

হযরত হাসান বস রী (রহঃ) বলেন, “অতীত কর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না করার পাকাপোক্ত ইচ্ছাকে “তওবাতূন” নসূহা বলে । হযরত কলবি (রহঃ) বলেন, “মুখে ক্ষমা প্রার্থনা করা, অন্তরে অনুশোচনা করা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে ভবিষ্যতে গোনাহ থেকে দূরে রাখা ।

হযরত আলী (রা)-কে তওবা কি প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ৬ টি বিষয়ের একত্রে সমাবেশকে তওবা বলে তাহলো : ১) অতীত গোনাহের জন্য অনুতাপ ২) তরক করা ফরয ও ওয়াজিবের ক্বাযা করা ৩) কারো সম্পদ অন্যায় ভাবে গ্রাস করলে তা ফেরত দেওয়া ৪) হাতে বা মুখে কাউকে কষ্ট দিলে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ৫) ভবিষ্যতে সেই গোনাহের কাছে না যাওয়ার ওয়াদা করা ৬) নিজেকে যেমন আল্লাহ্র নাফরমান দেখেছিল তেমনই আল্লাহ্র ফরমবরদার দেখা ।

তওবা বা সৎকর্ম জান্নাত ও মাগফেরাতের মূল্য হতে পারে না । সৎকর্মের বিনিময়ে মানুষ পার্থিব জীবনে নেয়ামত পেয়ে থাকে । জান্নাত আল্লাহর কৃপা ও অনুগ্রহের উপর নির্ভরশীল ।

তিনটি কাজ তাড়াতাড়ি করা উত্তম: ১) ওয়াক্ত হওয়ার সাথে সাথে নামাজ ২) মৃত্যুর সাথে সাথে দ্রুত মুর্দার দাফন ও ৩) পাপ হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক তওবা করা ।

তওবা আমরা করতে পারি কিন্তু তা কবুল হোল কি না তা কি করে বুঝব ? কবুলকারী তো আল্লাহ্ রব্বুল ইজ্জত । এক সময় ইবাদত কবুলের আলামত প্রকাশ হতো । যেমন হযরত আদম (আঃ) এর দুই ছেলে হাবিল ও কাবিল কুরবানি করলে একজনের কুরবানি আকাশ হতে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ এসে পুড়িয়ে দিয়ে যায় যা কুরবানি কবুলের লক্ষণ । অন্য জনের কুরবানি অক্ষত পড়ে থাকে যা কুরবানি প্রত্যাখ্যানের ইঙ্গিত । এই জামানায় সেই প্রচলন আর নেই ।
বুজুর্গ ব্যক্তিদের বর্ণনা মতে নিম্ন লিখিত আলামত তওবা কবুলের লক্ষণ: কেউ যদি তওবার পরে নিজের মধ্যে বা অন্য কারো মধ্যে নিম্নের আচরণের লক্ষণীয় স্থায়ী পরিবর্তন দেখতে পান তাহলে অনুমান করা যেতে পারে যে তওবা কবুল হয়েছে ।

১) তওবা করার পর থেকে মিথ্যা বলা, অপরের গীবত করা, অপ্রয়োজনীয় কথা বলা বন্দ হয়ে যায় ।২) তওবা কারী অন্তরে অপরের প্রতি হিংসা ও শত্রুতার ভাব পোষণ না করা ।৩) অসৎ সংসর্গ ত্যাগ করা ।৪) দুনিয়ার মহব্বত অন্তর থেকে বের করে দেওয়া ।৫) আল্লাহ্ তার ভাগ্যে যে পরিমাণ রিজিকের দায়িত্ব নিয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা । লোভ লালসা দূর করা ।

হযরত আবু হুরায়রাহ (রা) হাদিসের একজন বিখ্যাত রাবি । এশার নামাজের পর একদিন নবীজির (সাঃ) দরবারে যাচ্ছিলেন । পথিমধ্যে একজন স্ত্রীলোক তাঁকে বল্লেন , আমি পাপ করেছি । আমার কি তওবার সুযোগ আছে? আমি যিনা করেছি ও অবৈধ সন্তানটিকে হত্যা করেছি । উত্তরে আবু হুরায়রাহ বল্লেন, তুমি ধ্বংস হয়েছ সাথে আরও একজনকে ধ্বংস করেছ ।

নবিজীর দরবারে যেয়ে এই কথা বললে নবিজী আবু হুরায়রাহ কে বল্লেন, ইন্না লিল্লাহে ও ইন্না ইলায়হে রাজেউন । হে আবু হুরায়রাহ, তুমি নিজেও ধ্বংস হয়েছ সাথে তাকেও ধ্বংস করেছ । তোমার কি এই আয়াত মনে নেই ?
“………… ইল্লা মান তাবা ওয়া আমানা ওয়া আমেলা সলেহান ফাউলায়িকা ইয়ুবাদ্দিলুল্লাহ সায়্যিয়াতিহিম হাসানাতিন অকানাল্লাহু গাফুরুর রাহিম ।

অর্থ: কিন্তু যারা তওবা করে এবঙ্ ঈমান আনয়ন করে আর নেক আমল করতে থাকে, তাহলে অমন সব লোকের গোনাহকে আল্লাহ্ নেকী দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন । আল্লাহপাক পরম দয়াবান ও ক্ষমাশীল ।
আবু হুরায়রাহ বের হয়ে গেলেন । মদিনার অলিতে গলিতে ওই মহিলাকে খুঁজতে লাগলেন। তাঁর উদ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখে বাচ্চারা তাঁকে পগল বলতে লাগল ।

ওই মহিলার সাথে দেখা হলে আবু হুরায়রাহ জানিয়ে দিলেন যে তাঁর তওবার দুয়ার খোলা আছে । একথা শুনে আনন্দের আতিশয্যে ওই মহিলা বলে উঠলেন যে, আমার এই বাগানটা আমি মিসকিনদেরকে সদকা করে দিলাম ।

আল্লাহ্ রহমান, রহিম, গফুর, গফফার । মানুষের পাপের চেয়ে আল্লাহর ক্ষমা অনেক অনেক উপরে । দরকার তওবার তাড়না অনুভব করা । খালেস দিলে তওবা করা । গোনাহে জীবন রুক্ষ মরুময় হয়ে গেলেও করুনাময়ের কাছে হাত তুলে রহমত চাইলে তিনি ফেরায়ে দিবেন না । শুধু তওবাতুন নসুহা হতে হবে ।

হে আল্লাহ্, হে মহামহিম, তুমি আমাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করো । গুনাহে, অন্যায়ে, ভুলে, পাপে আমাদের জীবন মাধুরীহীন হয়ে উঠেছে । তোমার ক্ষমার পরশ দিয়ে আমাদেরকে তোমার ইবাদত করার, উপাসনা করার, তোমার দয়া পাওয়ার সুযোগটুকু এনে দাও ।

“জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো,সকল মাধুরি লুকায়ে যায় গীতসুধারসে এসো ।……………………………………………………………

বাসনা যখন বিপুল ধুলায়,

অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়

ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো ।”– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *