গত ২৫শে মে, ২০২২, অ্যামেরিকার টেক্সাসের একটা প্রাইমারী স্কুলে বন্দুকধারীর গুলিতে ১৯ জন বাচ্চা নিহত হয়। নিহত হচ্ছে প্রতি নিয়ত, প্রতি বৎসর! 

২০১২ সালে স্যান্ডি হুক এলিমেণ্টারি স্কুলে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত ২৬ জন শিশুর মধ্যে ২০ জনই ছিল ৫-৬ বৎসর বয়সী।  

যে অবুঝ, অবোধ বাচ্চা পড়ার আনন্দে স্কুলে গিয়েছিল সে বন্দকুধারীর গুলিতে নিহত! তার অপরাধ, তার পাপ কি ছিল? 

তার বাবা মা সারা জীবন বয়ে বেড়াবে এই রক্তাক্ত স্মৃতি। তার সহপাঠীরা দেখল সহপাঠীর করুন মৃত্যু। যারা বেঁচে থাকলো তারা যে মানসিক ট্রমা নিয়ে জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে বা বড় হচ্ছে তারাতো মানসিকভাবে পঙ্গু!

এই তথাকথিত সভ্য সমাজের ঘোলাটে স্রোত কোন অথৈ সাগরের মোহনায় যেয়ে মিশবে?

অ্যামেরিকায় প্রতিদিন গড়ে ১০০ মানুষ বন্দুক হামলায় মারা যায় ও আরও ১০০ মানুষ আহত হয়। 

অ্যামেরিকার টোটাল মানুষের তুলনায় টোটাল আগ্নায়স্ত্রের সংখ্যা বেশী। ১২০.৫০%। সারা দুনিয়ার মানুষের মাত্র ৫% অ্যামেরিকায় বাস করে কিন্তু সারা দুনিয়ার ব্যক্তিগত আগ্নায়স্ত্রের ৪৫% ই অ্যামেরিকায়। 

আগ্নায়স্ত্রের কারণে বছরে অ্যামেরিকায় ৩৫০০০ মানুষ মারা যায় যার  আত্মহত্যায় ২২০০০ জন ও অস্ত্রের আক্রমণে হত্যা ১২০০০জন। আবার অন্য উন্নত দেশের তুলনায় অ্যামেরিকার নারীরা ১২ গুণ বেশী বন্দুক হামলার শিকার হন। 

সব সমাজে, সব ধর্মে মানুষকে সবার উপর স্থান দেওয়া হয়েছে।

আমাদের উপমহাদেশে মধ্যযুগে চতুর্দশ শতকে কবি  বড়ু চণ্ডীদাস সেই কবে বলে গেছেন,

“সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” 

নজরুল লিখলেন,

“গাহি সাম্যের গান 

মানুষের চেয়ে বড় কিছু নয় নহে কিছু মহীয়ান।”

সনাতন ধর্ম, গৌতম বুদ্ধ, নানক, কবির, বিবেকানন্দ সবাই মানুষের কথা বলেছেন।

আমাদের ইসলামে মানুষের অধিকার, মানুষকে সেবা করার উপর অধিক গুরুত্ব আরপ করা হয়েছে। হিলফুল ফুজুল ও মদিনা সনদের পরতে পরতে মানুষের কল্যাণের কথা রয়েছে।

“পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করার জন্য কেউ কাউকে হত্যা করল, সে যেন পৃথিবীর সকল মানুষকে হত্যা করল। আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করল, সে যেন সকল মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। (সূরা মায়েদা : ৩২)

এখনও পর্যন্ত আমাদের পূর্ব দেশ সমুহে যে মানবিকতা, সম্প্রীতি সৌহার্দ রয়েছে তার উপমা বিরল। 

শিল্প বিপ্লব, আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের একদেশদর্শী উন্নতি, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ মানুষকে লোভাতুর করে ফেলেছে। কনজুমারিজম বা ভোগবাদ মানুষকে এমন এক আত্মকেন্দ্রিক অবস্থায় নিয়ে গেছে যে সব তত্ত্ব ও তথ্য তৈরি হচ্ছে ভোগবাদের মোটাতাজাকরণ ঘিরে। 

“When financial solvency is ensured, Spiritual bankruptcy starts.”

অর্থাৎ, অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নিশ্চিত হলেই আত্মিক দৈন্যতা শুরু হয়। 

অ্যামেরিকার শিশু সহ নানা নরহত্যা এই ইঙ্গিতই দেয় যে সচ্ছলতা ও ভোগবাদের নামে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের নামে যে লাগামহীন অনাচার, পাপাচার ও অজাচার চলছিল তারই পরিণতিতে আজকের এই নিষ্ঠুর নরহত্যা। 

নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে অবজ্ঞাভরে দূরে ছুঁড়ে যাচ্ছেতাই জীবন যাপনের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে তা যে ঠুনকো, তা যে কোন দেশ ও জাতিকে স্থায়ী কোন শান্তির পথ নির্দেশ করতে পারে না, তা এই নরহত্যা, বেলেল্লাপনা, সন্তানদের উপস্থিতিতে বাবা মায়ের বিবাহ, হর হামেশা বিয়ে ও বিচ্ছেদ, সন্তানকে শাসন করলেই পুলিশ ডাকা, অস্ত্র ও নেশা দ্রব্যের অবাধ সরবরাহ সহ হাজারো আপাতঃ চক্ষু শীতলকারী বল্গাহারা উদ্যামতা একটা জাতিকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে তার, উৎকৃষ্ট বা প্রকৃষ্ট যাই বলেন, উদাহরণ এই অ্যামেরিকা। 

এরা চকলেটের থেকে শুরু করে অস্ত্র সবই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে উৎপাদন করে। 

সারা দুনিয়া এদের মুক্ত বাজার! 

বিষ্ণুর অষ্টম অবতার ভগবান শ্রী কৃষ্ণ যখন বাসুদেব ও দেবকীর অষ্টম সন্তান হিসেবে জন্ম গ্রহণ করেন এবং লালিত পালিত হন তাঁকে কেন্দ্র করে বাংলায় একটা প্রবাদ প্রচলিত হয়ঃ

“তোমারে বধিবে যে, গোঁকুলে বাড়িছে সে।” কংস রাজাকে বধ করার ইঙ্গিতে এই কথা বলা হয়েছিলো। 

অ্যামেরিকার ক্ষেত্রেও তার অস্ত্রের ব্যবসা ও নৈতিকতা বিবর্জিত বেহায়া সামাজিক রীতি পদ্ধতি বুমেরাং হয়ে তাকেই দংশন করছে। 

একটা দেশের, একটা সমাজের মূল হচ্ছে পরিবার। এই পরিবারের নীতি নৈতিকতার শিক্ষা সন্তানকে সমাজ ও জগতের বৃহত্তর পরিমণ্ডলে অবদান রাখতে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। 

ভোগ বিলাসের দরিয়ায় চুবায়ে, ব্যক্তিস্বাত্যন্ত্রের বন্ধনহারা স্বেচ্ছাচারিতায় আকণ্ঠ ডুবায়ে আর যাই হোক সন্তান মানুষ করা যায় না, পরিবার ও জাতি গঠন করা যায় না।  

এই শিকড় কেটে অ্যামেরিকা এখন এমন আত্মঘাতী অবস্থায় পৌঁছেছে যে এই মেকী মেকআপ ঘষে তুলে সমাজে মানবিকতার চর্চা শুরু করতেও অনেক যুগ কেটে যেতে পারে। 

অ্যামেরিকার এই ভ্রান্তি তার বিজ্ঞান সহ নানা গবেষণা ও আবিষ্কারকে ম্লান করে পক্ষাঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।   

কলম্বাস বেঁচে থাকলে সে এই ধরনের স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড দেখলে নিশ্চয়ই লজ্জা পেত!

অ্যামেরিকার পুলিশ বিভাগের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে “বেশী গরম পড়ার জন্যে বন্দুক সহিংসতা বাড়ছে!!” (প্রথম আলো)

এই প্রতিবেদন পড়ে গোপাল ভাঁড়ের একটা গল্প মনে পড়ে গেলোঃ 

গোপাল ভাঁড় চিঠি লিখে দিতে অস্বীকার করেছিল এই যুক্তিতে  যে তার পায়ে ব্যাথা। চিঠির সাথে পায়ের ব্যাথার সম্পর্কের ব্যখ্যা হচ্ছে, তার হাতের লেখা এত খারাপ যে গোপালকে নিজে ঐ দূর দেশে যেয়ে নিজের লেখা চিঠি পড়ে দিয়ে আসতে হবে। যেহেতু পায়ে ব্যাথা তাই গোপাল চিঠি লিখে দিতে পারবে না।  

গোপালের যুক্তিরও তো একটা শেষ ব্যাখ্যা আছে কিন্তু অ্যামেরিকার গোপালদের প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা কি?

“নিউট্রন বোমা চেনো,

মানুষ চেনো না!”– কবি হেলাল হাফিয

-পিউ রিসার্চ সার্ভে অনুযায়ী আমেরিকার ১০ জনের ৪ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ বাড়ীতে বন্দুক নিয়ে বসবাস করেন।

-গ্যালাপ সার্ভে বলে আগ্নেয়স্ত্র রাখার প্রধান কারণ ব্যক্তিগত নিরাপত্তা।

-গত বৎসরের পিউ রিসার্চ সার্ভে অনুযায়ী ৪৮% অ্যামেরিকান বলেন  বর্তমান সময়ে অ্যামেরিকার সব চেয়ে বড় সমস্যা বন্দুক-হিংস্রতা।

-২০১৯ সালের পর থেকে ৫৩% অ্যামেরিকান আগ্নেয়স্ত্রের আইন কঠোর করার পক্ষপাতি।

-জনপদের বা পল্লী অঞ্চলের অ্যামেরিকানরা আরও বেশী পরিমাণে আগ্নেয়স্ত্রের বৃদ্ধি চান।

উপরের পরিসংখ্যান বলে দেয়, সমাজটা কতটা ভঙ্গুর, কতটা অস্থির, কতটা অগভীর, কতটা অমানবিক।

আবারও সেই বিখ্যাত উক্তিটা বলতে ইচ্ছে করছেঃ

“If you teach your children three R’s (Reading, Writing Arithmetic) and leave the fourth R (Religion), you will get a fifth R (Rascal)। 

তুমি সন্তানকে লেখাপড়া, গণিত শেখালে কিন্তু ধর্ম (বিশ্বের অধিকাংশ ধর্মের মানবিক আবেদনগুলোর সাযুজ্য জ্বলন্ত) শেখালে না, তাহলে তুমি  পাবে পঞ্চম ‘আর’ অর্থাৎ একটা রাস্কেল বা বদমাশ। 

Categories: Uncategorized

1 Comment

Ferdusi Chowdhury · June 17, 2022 at 4:39 am

তুমি সন্তানকে লেখাপড়া, গণিত শেখালে কিন্তু ধর্ম (বিশ্বের অধিকাংশ ধর্মের মানবিক আবেদনগুলোর সাযুজ্য জ্বলন্ত) শেখালে না, তাহলে তুমি পাবে পঞ্চম ‘আর’ অর্থাৎ একটা রাস্কেল বা বদমাশ। সত্যিই স্যার ধর্ম বিষয়ে বাচ্চাদের জানা অনেক জরুরি। স্যার আপনার ট্রেনিং এ এইসব বিষয় গুলো আসলে খুব ভাল হবে আমাদের এই প্রজন্মের কাছে।

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *