রমজান-৩০ 

আজ নাজাতের দশক ও পবিত্র মাহে রমজনের শেষ দিন। 

আগামীকাল ঈদুল ফিতর।

মুসলমানদের বাৎসরিক দুইটা উৎসবের অন্যতম একটা উৎসব আগামীকাল।

আজ আমরা পিছনের দিকে তাকায়ে দেখতে চেষ্টা করবো দেড় হাজার বৎসর আগের সর্ব প্রথম ঈদুল ফিতর কেমন ছিল। 

নবী করীম (সঃ) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে  মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় যান। হিজরত থেকে হিজরি সাল গণনা শুরু হয়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭ বৎসর পরে হযরত ওমরের (রাঃ) সময় থেকে হিজরি সাল চালু হয়। 

হিজরতের প্রথম বৎসরের অষ্টম মাসে অর্থাৎ শাবান মাসে রোজা ফরজ হওয়ার আয়াত নাযিল হয় ও নবম মাস অর্থাৎ রমজান থেকে রোজা রাখা শুরু হয়। রমজান শেষে শাওালের এক তারিখে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। 

মদিনায় হিজরত করার পর নবীজী দেখলেন ওখানকার লোকেরা দুইটা উৎসব পালন করে। ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’। ঐ দুইটার আদলে মুসলমানদের জন্য  দুইটা উৎসব প্রবর্তন কর হয়। 

মক্কার জালেমদের হাত থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে মদিনায় ঠিক হয়ে দাঁড়াবার আগেই মদিনার উপকণ্ঠে বদর প্রান্তরে শক্তিশালী শত্রুর সাথে এক অসম যুদ্ধ শুরু হয়। 

যুদ্ধ শুরু হলে আল্লাহ্‌র নবী (সঃ) কাতর কণ্ঠে আল্লাহ্‌র  কাছে মিনতির সাথে  মোনাজাত করে বলেন, “হে আল্লাহ্‌, মুসলমানদের এই দল যদি আজ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তাহলে দুনিয়ায় তোমার ইবাদত করার কেউ থাকবে না। তুমি কি চাও আজকের পরে তোমার ইবাদত আর না করা হোক?”

বদরের যুদ্ধকে  কেন্দ্র করে সুরা আনফাল নাযিল হয়। আল্লাহ্‌ বলেন, ”আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।সুতরাং তোমরা মোমেনদের অবিচল রাখো, অচিরেই আমি তাঁদের (কাফেরদের)  হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করবো যারা কুফরি করে। (সুরা আনফাল, আয়াত-১২)

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রাঃ) আবু জেহেলের মাথা কেটে নবীজিকে দেখান ইসলামের ঘোর শত্রুর পরিণতি। 

রেওয়াজ অনুযায়ী রণপ্রান্তরে ৩ দিন অবস্থানের পর মদিনায় ফেরার পথে ‘সাফরা’ প্রান্তরে এসে নবীজী ‘নজর ইবন হারেস’ কে হত্যার আদেশ দেন। এই সেই কুলাঙ্গার যে পারস্য দেশে যেয়ে রুপকথা, উপকথা শিখে এসে মদিনার মানুষদেরকে একত্র করে শোনাতো যাতে মানুষ নবী করীম (সঃ) ‘এর কাছে না যায়!! 

একটু পরে ‘আরকুজ জাবিয়া’য় পৌঁছে  ‘ওকবা ইবন আবু মোয়ায়ত’ কে হত্যার আদেশ দেন। এই সেই নরাধম যে নামাযরত অবস্থায় রসুল্লাহ (সঃ) ‘এর উপর উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে দিয়েছিল এবং নবিজীর গলায় চাদর পেঁচায়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। 

শুধু বদর প্রন্তরের নোংরা কূপেই কুরাইশদের ২৪ জন সর্দারের লাশ পুঁতে ফেলা হয়েছিলো যা ছিল মক্কার শত্রুদের উপর এক অপ্রত্যাশিত চরম আঘাত। (হিরসিমা-নাগাসাকি’র মতো)

ইসলামের শুরু থেকে নানা অত্যাচার,  প্রকাশ্যে ইবাদতে বাঁধা, আবিসিনিয়ায় সাহাবাদের হিজরত, তায়েফে নবিজীর হিজরত ও অসহনীয়, অমর্যাদাকর অত্যাচার সহ দুঃসহ সময়ের ক্রান্তিতে এসে মদিনায় হিজরত। 

ওরা পিছু ছাড়ে নাই। বদরের অসম যুদ্ধে অকল্পনীয় বিজয়। এবার আল্লাহ্‌ সুবহানাল্লাতায়ালা মুসলমানদেরকে বুক ভোরে নিস্বাস নিতে ও প্রাণ খুলে আনন্দ করতে সুযোগ করে দিলেন “ঈদুল ফিতর” ‘এর।

সিয়াম বা রোজার সাথে সাথে সদকাতুল ফিতর ফরজ করা হয়। যাকাতের পরিমাণও নিদিষ্ট করে দেওয়া হয়। এতে অনেক অভাবী মোহাজেরদের সমস্যার আশু সমাধান হয়। 

সবাই মিলে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন। 

সে দিনের ঈদের চেহারা ছিল অন্য রকম। উচ্চস্বরে হামদ, তাকবির, তাসবিহ ও তাওহিদের ঘোষণা করতে করতে মুসলমানেরা ঈদগাহে হাজির হয়েছিলেন, যা তাঁরা আগে করতে পারতেন না। তাঁদের মন ছিল আল্লাহ্‌র নেয়ামত ও সাহায্যের কারণে পরিপূর্ণ। 

আজকের ঈদের সাথে তুলনা করলে আমরা কেয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করলেও সেই অনুভূতি উপলব্ধি করতে পারবো না। নবীজী (সঃ) ও সাহাবারা (রাঃ) যে অবর্ণনীয়, অকল্পনীয় কষ্ট  সহ্য করে দ্বীন ইসলামকে কায়েম করে গেছেন আমাদের জন্য আজকে আমরা তৈরি করা রাস্তা দিয়ে হাঁটতেও গাফিলতি করি!

“ স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে স্বল্পসংখ্যক। পৃথিবীতে তোমরা দুর্বল পরিগণিত হতে, তোমরা আশঙ্কা করতে, লোকেরা তোমাদেরকে আকস্মিকভাবে ধরে নিয়ে যাবে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দেন, স্বীয় সাহায্যের দ্বারা তোমাদের শক্তিশালী করেন এবং তোমাদের উত্তম বস্তুসমুহ জীবিকারুপে দান করেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হও।” (সুরা আনফাল, আয়াত-২৬)     

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে ইসলামকে বুঝার, ঈদের তাৎপর্য উপলব্ধি করার ও ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রতিফলন ঘটানোর তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।  

আমাদের দেশে ঈদের প্রচলন।

দেড়শ বৎসর আগেও আমাদের এই অঞ্চলে ঈদ উদজাপনের তেমন কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। হাজী শরিয়াতুল্লাহর সময়ে একটু একটু করে ঈদ উৎসব পালনের রেওয়াজ শুরু হয়। এর পূর্বে মুসলমান থাকলেও তাঁদের মধ্যে লোকায়ত ধর্মের রীতি রেওয়াজ প্রচলিত ছিল বেশী। ঈদ না। 

১৬১০ সালে যখন মোঘলরা এদেশে আসে তখন তারা কামান দেগে ঈদ উৎসব  করতো। তারা ঈদের নামাজ পরে হাতি ঘোড়ায় চড়ে ফেরার পথে নীচের মানুষদের দিকে পয়সা ছুঁড়ে দিতো। সাধারণ মানুষের মধ্যে ঈদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না। 

১৮৮৫ সালে ইংরেজ ঐতিহাসিক জেমস ওয়াইজের লেখায়ও দেখা যায় ঈদ উদযাপন তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না।  

রমজান- ২৯

নাজাতের দশকের নবম দিন। 

আজ পহেলা মে। 

১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের ‘হে’ মার্কেটে অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজসহ বিভিন্ন দাবিতে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন করে। সমাবেশে শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায় পুলিশ। এর পরের গল্প আমাদের সবার জানা। 

আজ থেকে প্রায় ১৩০০ বৎসর আগে ইসলামের নবী মোহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (সঃ) শ্রমের মর্যাদা ও শ্রমিকের অধিকার নিয়ে যে আইন প্রবর্তন করেন তা  ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে এবং আমাদের বদ খাসলাতের কারণে বস্তাবন্দী হয়ে আছে।

প্রিন্ট ও ডিজিটাল মিডিয়ার কল্যাণে, ভোগবাদী অর্থনীতির দাপটে শিকাগোর হে মার্কেটের আন্দোলন শ্রমকের দাবি আদায়ের মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। 

হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গনসঙ্গীতে ফুটে উঠেছে গণমানুষের শ্রমিক জনতার সংগ্রাম আর প্রতিবাদের সুর। ১৯৭৩ সালে হেমাঙ্গ অনুবাদ করে লিখলেন ১৭৩ লাইনের অমর গণসঙ্গীত, বিশ্ববিখ্যাত অ্যামেরিকান গায়ক পিট সিগার যাকে বলেছেন আমেরিকার মহত্তম গীতিকা। তার কয়েক্তি লাইন এরকমঃ

“কালো পাথরে খোঁদাই জন হেনরি 

জানাইছে গড়া পেশী ঝলমল 

হাতুড়ীর ঘায়ে ঘায়ে পাথরে আগুন ধরে

হাতুড়ী চালানো তাঁর সম্বল

হো হো হো   

হাতুড়ী চালানো তাঁর সম্বল।

………………………………

সাদা সর্দার বলে হেসে হেসে

কালো নিগারের দেখো দুঃসাহস

তোর যদি জয় হয় হবে না সূর্যদয়

দুনিয়াটা হবে তোর বশ 

হো হো হো

দুনিয়াটা হবে তোর বশ।” 

আমাদের দেশে ফকির আলমগিরের কণ্ঠে এ জ্ঞান ভিন্ন মাত্রা পেয়েছিলো। 

১৩০০ বৎসর আগে ইসলামের নবী ও তাঁর সঙ্গিরা কি করলেন?

১) নবীজী  নিজে মজুরির বিনিময়ে অন্যের খেতে পানি সেচ ও কুপ থেকে পানি তোলার কাজ করেছেন।

২) হযরত সালমান ফার্সি  (রাঃ) কে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য বিনিময় হিসেবে নিজের হাতে বৃক্ষ রোপন করেছেন।

৩) হযরত আলী (রাঃ) খলীফা হওয়ার আগে বায়তুল মাল থেকে কিছু না নিয়ে ইহুদির বাগানে শ্রমিকের কাজ করা অর্থ দিয়ে পরিবার প্রতিপালন করেছেন। 

উদাহরণ দিলে লেখার কলেবর বেড়ে যাবে। 

বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) তাঁর বিখ্যাত “ফতহুল গায়েব” কিতাবে বলেন, যে লোক অন্যের পরিশ্রমের ফল বিনা পরিশ্রমে ভোগ করে, সে ক্ষেত্রে যিনি পরিশ্রম করেন তিনি অলস ব্যক্তির রিজিকদাতা হয়ে যান।”  (অসিলা হয়ে যান। রিজিক দাতা তো আল্লাহ্‌)  

নবীজী ঘোষণা করেন, “শ্রমিক আল্লাহ্‌র বন্ধু”। (মেশকাতুল মাসাবিহ)

তাহলে দেখা যাচ্ছে আল্লাহ্‌র বন্ধুদের অমর্যাদা করার এখতিয়ার কারো নাই। কিন্তু আমরা অহরহ শ্রমিককে নিগৃহীত করেই তৃপ্তি পাই! নবীজী আরও বলেন, “দিন শেষ হওয়া পর্যন্ত যে শ্রমিক শ্রমরত অবস্থায় থাকেন, আল্লাহ্‌ তাঁর পাপগুলো ক্ষমা করে দেন। (মেশকাত)

“শ্রমিকের পারিশ্রমিক তাঁর গায়ের ঘাম শুখানোর আগেই পরিশোধ কর”- মেশকাত

হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন শ্রেণির মানুষের প্রতিপক্ষ হবো। 

ক) যে ব্যক্তি আমার নামের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরে তা ভঙ্গ করেছে, 

খ)  যে ব্যক্তি স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করেছে এবং গ)  যে ব্যক্তি কাউকে শ্রমিক নিযুক্ত করে নিজের কাজ আদায় করেছে, কিন্তু তার পারিশ্রমিক প্রদান করেনি। -বোখারি

হযরত ঈসা (আঃ) এক ব্যক্তিকে  উপাসনালয়ে দেখে  বল্লেনঃ তুমি কি করো? 

সে বললঃ আমি উপাসনা করি।  

ঈসা (আঃ) বল্লেনঃ তোমার জীবিকার ব্যবস্থা কে করে?

সে বললঃ আমার ভাই করে।

ঈসা (আঃ) বল্লেনঃ সে তোমার চেয়ে উত্তম। 

ইসলামে শ্রমের ও শ্রমিকের মর্যাদা অনেক অনেক উঁচুতে। নবীজী নিজে করে দেখায়ে গেছেন। তাঁর খলীফা, সাহাবিরা করে দেখায়ে গেছেন। 

কিন্তু দুঃখের বিষয় পরবর্তী যুগে এসে ভোগবাদের পাল্লায় পড়ে আমরা মুসলমানেরা তা অনেক অনেক দূরে ঠেলে ফেলে দিয়েছি।

যার পরিণামে আমেরিকার হে মার্কেটের শ্রমিক আন্দোলন পৃথিবীর মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আইকন হিসেবে দেশে দেশে পালিত হচ্ছে।

অথচ মক্কা বিজয়ের পর  নবীজী হাবসি বেলাল (রাঃ) ও আর একজন হাবসি সাহাবিকে সাথে নিয়ে পবিত্র মক্কার মসজিদে প্রবেশ করেছিলেন। কোন অভিজাত, সাদা চামড়ার কাউকে সাথে নিয়ে মক্কার ঘরে প্রবেশ করেন নাই। 

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে শ্রমিক হওয়ার ও শ্রমিকেকে মর্যাদার চোখে দেখার ও তাঁর গায়ের ঘাম শুখানোর আগে তাঁর পাওনা মিটায়ে দেওয়ার তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন। 

ইমান বা বিশ্বাসের ৭৭টি শাখা তিন ভাগে বিভক্ত। (ক) প্রথম ৭টি মুখ বা বাক্শক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, (খ) দ্বিতীয় ৩০টি মন বা বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত; (গ) তৃতীয় ৪০টি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা কর্মের সঙ্গে সংযুক্ত।

মুখের জবানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইমানের ৭টি বিষয়

(১) আল্লাহর একত্ব মুখে স্বীকার করা। (২) কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করা। (৩)  দ্বীন’ই ইলম শিক্ষা করা। (৪) দ্বীন’ই ইলম শিক্ষা দেওয়া ও দ্বীনের প্রচার করা। (৫) দোয়া করা (নিজের ও অন্যের কল্যাণ কামনা করা)। (৬) জিকির করা (আল্লাহর গুণাবলি আলোচনা করা)।  (৭) বাহুল্য কথাবার্তা বলা ও শোনা থেকে বিরত থাকা।

মনের বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইমানের ৩০টি বিষয় থেকে গুটি কয়েক উল্লেখ করছিঃ

(১) আল্লাহর, ফেরেশতাদের, আসমানি কিতাবসমূহে, সকল নবী-রাসুলগণের (আ.) প্রতি ভালো-মন্দ তাকদিরেরও, কিয়ামত ও বিচার দিবসের প্রতি, জান্নাত বা বেহেশতের প্রতি ও জাহান্নাম বা দোজখের প্রতি বিশ্বাস, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্যদের প্রতি ভালোবাসা, নবীজি (সা.)-কে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা করা,  সকল কর্মে রাসুল (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণ করা, যেকোনো কাজ ইখলাছের সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা, রিয়াকারী (আত্মপ্রদর্শন) ও মোনাফেকি পরিত্যাগ করা, সর্বক্ষণ অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখা,  আল্লাহর রহমতের আশা রাখা, কখনো কোনো গুনাহের কাজ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই তওবা করা,  সদা সর্বদা কথায় ও কাজে আল্লাহ তাআলার নিয়ামতসমূহের শুকর করতে থাকা, বৈধ ওয়াদা (প্রতিশ্রুতি) পালন করা, বিপদে ধৈর্য ধারণ করা, আল্লাহ তাআলা যখন যেই অবস্থায় রাখেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা, বিনয়ী হওয়া, বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা, গর্ব ও অহংকার পরিত্যাগ করা, হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা, রাগ-ক্রোধ দমন করা, কারও সঙ্গে মনোমালিন্য না রাখা, দুনিয়ার (ধন-সম্পদের) মহব্বত না রাখা

কর্মের সঙ্গে সংযুক্ত ইমানের ৪০টি বিষয়ের থেকে গুটি কয়েক উল্লেখ করছিঃ 

(১) পাক-পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। (২) নামাজ পড়া। (৩) জাকাত ও ছদকায়ে ফিতর আদায় করা (৪)  দানশীল মনের অধিকারী হওয়া।  (৫) রোজা রাখা। (৬) হজ করা, (৭)  স্ত্রী, সন্তানসন্ততি, পরিবার-পরিজন ও অধীনদের হক আদায়। (৯) সন্তান প্রতিপালন করা এবং তাদের  ইসলামের শিক্ষা দেওয়া। (১০) আত্মীয়স্বজনের হক প্রদান করা ও তাদের সঙ্গে সদাচার করা। (১২) পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচার করা। (১৩) চাকর-বাকর, কর্মচারী ও অধীনদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা।  (১৪) পরোপকার ও মানবকল্যাণে নিয়োজিত থাকা। (১৫) সৎ কাজে সহযোগিতা করা ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা। (১৬) অধীনদের শরিয়ত মতো পরিচালনা করা। (১৭) আমানত রক্ষা করা। (১৮) অভাবগ্রস্তকে কর্জে হাছানা (লাভবিহীন ঋণ) দিয়ে সাহায্য করা। (১৯) ঋণ পরিশোধ করা এবং পরিশোধের পূর্বে তা পরিশোধ করার দৃঢ় ইচ্ছা রাখা। (২০) পাড়া-প্রতিবেশীর উপকার করা এবং তারা কোনো প্রকার কষ্ট দিলে বা ক্ষতি করলে তা অম্লান বদনে সহ্য করা। (২১) কাজ-কারবার, লেনদেন পরিষ্কার রাখা; পাওনা আদায় করতে কঠোরতা ও দেনা পরিশোধ করতে শিথিলতা না করা। (২২) মাপে বেশ-কম না করা; পণ্যে ভেজাল না দেওয়া। (২৩) সুদ-ঘুষ ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকা। (২৪) সম্পদের সদ্ব্যবহার (বৈধভাবে উপার্জন ও জায়েজ পন্থায় ব্যয়) করা। রাস্তায় কষ্টদায়ক কোনো কিছু থাকলে তা অপসারণ করা। (বুখারি ও মুসলিম)।

রমজান- ২৮

নাজাতের দশকের অষ্টম দিন। ৩০.০৪.২২

আমাদের জ্ঞানের অভাবে আমরা কপটতা বা মোনাফেকি ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে থাকি। 

সমস্যাটা শুরু হয়েছে আমাদের মাতৃভাষা আরবি না হওয়ার কারণে। আমরা কলেমা পড়ে আল্লাহ্‌র উপর ঈমান এনেছি। কিন্তু কলেমা পড়াই  যথেষ্ট না। 

যথেষ্ট হতে হলে আমাদেরকে ইমানে মুফাসসালের অর্থ গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। নিজের রূহানী অবস্থানের দিকে তাকাতে হবে।

ঈমান অর্থ বিশ্বাস অর্থাৎ আল্লাহে বিশ্বাস। এবং মুফাসসাল অর্থ বিস্তারিত, ইন ডিটেইলস। অর্থাৎ যে যে বিষয় সমূহের উপর বিশ্বাস করলে ও সেই বিশ্বাস অনুযায়ী আমল করলে ঈমান পরিপূর্ণ হয়। 

ইমানে মুফাসসালঃ  “আমানতু বিল্লাহি, ওয়া মালায়িকাতিহি, ওয়া কুতুবিহি, ওয়া রাসুলিহি, ওয়াল ইয়াওমিল আখিরি, ওয়াল কদরি খয়রিহি ওয়া শাররিহি মিনাল্লাহি তাআলা, ওয়াল বাআছি বাদাল মাউত।” 

অর্থাৎ: আমি বিশ্বাস আনলাম আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর কিতাবসমূহের প্রতি, তাঁর রাসুলগণের প্রতি, কিয়ামতের দিনের প্রতি; তাকদিরের প্রতি, ভাগ্যের ভালো-মন্দ আল্লাহর পক্ষ থেকে; মৃত্যুর পর , তাবে পুনরুত্থানের প্রতি।’  

এর মধ্যে কিছু দৃশ্য আর কিছু অদৃশ্য বিষয় আছে। আল্লাহ্‌, ফেরেশতা, কিয়ামত,তকদির, ভালো মন্দ, মৃত্যু পরবর্তী জীবন এগুলো সবই অদৃশ্য। এগুলতে বিশ্বাস রাখতে হবে। যার জন্যে সুরা বাকারায় আল্লাহ্‌ বলেন, ”আল্লাজিনা ইউমেনুনা বেল গায়বে…” যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে।

অন্যদিকে কিতাব সমূহ ও রসূলগন দৃশ্যমান। যদিও রসুলকে দেখা আমাদের নসীবে হয় নাই কিন্তু তাঁর সাহাবী, তাবেয়ি, তাবে তাবেইন মারফত রসূলের বাণী আমাদের কাছে পৌঁছেছে। 

কিতাব সমূহের মধ্যে তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল ও কোরান। আমাদের ধর্ম গ্রন্থ আল কোরান। ঈমান সবগুল আসমানি কিতাবের উপর রাখতে হবে। ধর্মগ্রন্থ যেহেতু কোরান সেহেতু কোরান পড়া, বোঝা ও সে অনুযায়ী আমল করা অবশ্য কর্তব্য। 

কিন্তু দুঃখের বিষয় যে কিতাবের প্রথম নাযিলকৃত আয়াত ছিল “পড় তোমার প্রভুর নামে” সেই প্রথম আয়াতের সাথেই আমরা মুনাফেকি করছি। সাধারণ মানুষ হিসেবে অন্তত কোরান জানা উচিৎ ছিল কিন্তু তা করিনি।

আর যারা ধর্মীয় নেতা, যারা ধর্ম প্রচারক তাঁদের তো অবশ্যই কোরানের পাশাপাশি তাওরাত, যবুর, ইঞ্জিল ও জানা উচিৎ। আরও জানা উচিৎ অন্য ধর্মাবলম্বীদের গ্রন্থ সমূহ। তাহলেই তুলনামুলকভাবে তুলে ধরা সম্ভব কোরানের উচ্চ মর্যাদা। 

আমরা অনেকেই তা করি না। মাদ্রাসার যে সিলেবাস আছে দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল-এ তাই পড়ে পাশ করে আমরা ধর্মীয় বক্তা হয়ে যাই! অনেকে পাশ করলেও পঠিত বিষয় হারায়ে ফেলেন শুধু নামাজ পড়ানো, জানাজা পড়ানো, বিয়ে পড়ানো, মিলাদ পড়ানো সহ কিছু নিত্য প্রয়োজনীয় ইবাদতের নিয়ম কানুন জানার মধ্যে সীমিত থেকে। (বিশেষ কিছু ব্যক্তিত্ব ব্যতিত)

আমার নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লিখছি এ কথা গুলো। 

সুরা বাকারা, সুরা আল-ইমরান ও সুরা নেসা হচ্ছে আলিম শ্রেণীর সিলেবাস।আলিম পাশ করার পর একজন আলেম হয়ে যান কিন্তু সিলেবাস ওইটুকুই। (সম্প্রতি সিলেবাস পরিবর্তিত হলে সেটা আমার জানার বাইরে।)

ভিন দেশীয় ভাষা হওয়ায় আমরা বুঝিনা, কোশেশ করিনা কোরান শিখতে। যদিও সফট স্কিল, হার্ড স্কিল শিখে পেশাজীবনে উন্নতির চেষ্টার ত্রুটি করি না!

আবার যারা ধর্মের প্রচারক, ইউ টিউবে তুফান তোলেন তাঁদের বক্তব্যের বিষয়বস্তু, উপাস্থাপনার আদব ও ভাষার ব্যবহার এমন তীব্র ও উৎকট যে ধর্মে আগ্রহী হওয়ার চেয়ে অনেকে আশাহত হয়ে যান।

এহেন পরিস্থিতিতে আমরা যারা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত তারা ইসলাম কতটুকু বুঝি আর কততুকু মানি? এক সময় বাংলায় কোরানের তাফসির হবে না এই জন্য এই অঞ্চলে রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে। এখন আল্লাহ্‌র রহমতে বাংলা ও ইংরেজিতে অনেক অনেক তর্জমা, তফসির, অন্যান্য মাসায়ালা পাওয়া যায়। ইচ্ছা করলে আমরা তা সংগ্রহ করে পড়ে শিখতে পারি। দরকার শুধু ইচ্ছার।

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলামঃ  ঈমানের দৃশ্যমান অংশ কোরান ও নবী। অর্থাৎ কোরান ও হাদিস। নবী করীম (সঃ) বলে গেছেন, আমি দুইটা জিনিস রেখে গেলাম। যতক্ষণ তোমরা এই দুইটা জিনিস আঁকড়ে থাকবে ততক্ষণ তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। আর তা হচ্ছে, আল কোরান ও আমার হাদিস। 

আমরা মুখে উচ্চারণ করছি ইমানে মুফাসসাল কিন্তু কার্যত তা প্রত্যাহিক জীবনে আমল করছি না। তাহলে এটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এক ধরনের মোনাফেকি বা ভণ্ডামি। এই মোনাফেকি থেকে বের হয়ে না আসলে আল্লাহ্‌র মাগফেরাত ও নাজাত অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। 

আল্লাহ্‌ আমাদের উপর রহম করন। আমাদেরকে ইমানে মুফাসসালে উচ্চারিত বিষয়গুলো আমল করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন। 

ইমানে মুফাসসালের বিশেষ তাৎপর্য

ইমানে মুফাসসালে অতীব গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সাতটি বিষয় বিবৃত হয়েছে, যা প্রতিটি বিশ্বাসী মোমিন বিনা বাক্যব্যয়ে স্বীকার করবেন। এই সাতটি বিষয় যথাক্রমে: (১) আল্লাহ, (২) ফেরেশতা, (৩) কিতাব, (৪) রাসুল, (৫) কিয়ামত, (৬) তাকদির ও (৭) পরকাল। কালিমা তাইয়েবাতে এবং কালিমা শাহাদাতে ইমান বলতে শুধু আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর প্রতি বিশ্বাস করাকে বোঝানো হয়েছে। ইমানের মূল তিনটি বিষয় হলো: (১) তওহিদ বা আল্লাহর একত্ববাদ, (২) রিসালাত বা নবী-রাসুলদের প্রতি বিশ্বাস, (৩) আখিরাত বা পরকালের প্রতি বিশ্বাস। এই মর্মে কোরআন করিমে বলা হয়েছে: ‘(মুত্তাকিন তথা সাবধানি মুমিন তারা) যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, সালাত কায়েম করে, আমি যে রিজিক তাদের দিয়েছি তা হতে ব্যয় করে, আর যারা বিশ্বাস করে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তাতে এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আপনার পূর্বে, আর তারা পরকালে দৃঢ় বিশ্বাস রাখে। (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩-৪)।

ইমানের প্রকার ও প্রকরণ

ইমান ও ইসলামের পরিপূর্ণ বিবরণের নির্দেশনা রয়েছে ইমানে মুফাসসালে। হাদিস শরিফে আছে: ইমানের ৭৭টি শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর প্রথমটি হলো (কালিমা তাইয়েবা) ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’ (আল্লাহ ছাড়া মাবুদ নাই, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহ তাআলার রাসুল)। শেষটি হলো ‘রাস্তা বা পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরিয়ে ফেলা।’ (বুখারি)। ইমান বা বিশ্বাসের ৭৭টি শাখা তিন ভাগে বিভক্ত। (ক) প্রথম ৭টি মুখ বা বাক্শক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, (খ) দ্বিতীয় ৩০টি মন বা বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত; (গ) তৃতীয় ৪০টি শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা কর্মের সঙ্গে সংযুক্ত।

মুখের জবানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইমানের ৭টি বিষয়

(১) আল্লাহর একত্ব মুখে স্বীকার করা। (২) কোরআন শরিফ তিলাওয়াত করা। (৩) দিনি ইলম শিক্ষা করা। (৪) দিনি ইলম শিক্ষা দেওয়া ও দিনের প্রচার করা। (৫) দোয়া করা (নিজের ও অন্যের কল্যাণ কামনা করা)। (৬) জিকির করা (আল্লাহর গুণাবলি আলোচনা করা)। স্থান, কাল, পাত্র ও বিষয় নির্ধারিত সুনির্দিষ্ট মাছনুন দোয়াসমূহ অন্যতম জিকির। (৭) বাহুল্য কথাবার্তা বলা ও শোনা থেকে বিরত থাকা।

মনের বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ইমানের ৩০টি বিষয়

(১) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। (২) আল্লাহ ব্যতীত অন্য সবকিছুকে তাঁরই সৃষ্টি এই বিশ্বাস। (৩) ফেরেশতাদের অস্তিত্বের প্রতি বিশ্বাস। (৪) আসমানি কিতাবসমূহ বিশ্বাস। (৫) সকল নবী-রাসুলগণের (আ.) প্রতি বিশ্বাস। (৬) ভালো-মন্দ তাকদিরেরওপর বিশ্বাস। (৭) কিয়ামত ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস। (৮) জান্নাত বা বেহেশতের প্রতি বিশ্বাস। (৯) জাহান্নাম বা দোজখের প্রতি বিশ্বাস। (১০) আল্লাহর প্রতি ভক্তি ও মহব্বত। (১১) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্যদের প্রতি ভালোবাসা। (১২) নবীজি (সা.)-কে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা করা। (১৩) সকল কর্মে রাসুল (সা.)-এর সুন্নতের অনুসরণ করা। (১৪) যেকোনো কাজ ইখলাছের সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে করা। (১৫) রিয়াকারী (আত্মপ্রদর্শন) ও মোনাফেকি পরিত্যাগ করা। (১৬) সর্বক্ষণ অন্তরে আল্লাহর ভয় রাখা। (১৭) আল্লাহর রহমতের আশা রাখা। (১৮) কখনো কোনো গুনাহের কাজ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই তওবা করা। (১৯) সদা সর্বদা কথায় ও কাজে আল্লাহ তাআলার নিয়ামতসমূহের শুকর করতে থাকা। (২০) বৈধ ওয়াদা (প্রতিশ্রুতি) পালন করা। (২১) শাহ্ওয়াত বর্জন (অর্থাৎ কাম রিপুকে নিয়ন্ত্রণ) করা। (২২) বিপদে ধৈর্য ধারণ করা। (২৩) আল্লাহ তাআলা যখন যেই অবস্থায় রাখেন, তাতে সন্তুষ্ট থাকা। (২৪) বিনয়ী হওয়া। (২৫) বড়দের সম্মান ও ছোটদের স্নেহ করা। (২৬) গর্ব ও অহংকার পরিত্যাগ করা। (২৭) হিংসা-বিদ্বেষ পরিহার করা। (২৮) রাগ-ক্রোধ দমন করা, কারও সঙ্গে মনোমালিন্য না রাখা। (২৯) দুনিয়ার (ধন-সম্পদের) মহব্বত না রাখা। (৩০) লজ্জা থাকা।

কর্মের সঙ্গে সংযুক্ত ইমানের ৪০টি বিষয়

(১) পাক-পবিত্র ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। (২) ছতর ঢাকা। (৩) নামাজ পড়া। (৪) জাকাত-উশর ও ছদকায়ে ফিতর (এবং দান-দক্ষিণা) প্রদান করা। (৫) দাস-দাসীকে মুক্তি দেওয়া। (৬) ছখী দানশীল বা উদার মনের অধিকারী হওয়া। (৭) কোরআন-হাদিস-ফিকাহ শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। (৮) রোজা রাখা। রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা ও শবে কদর তালাশ করা। (৯) হজ করা, কাবা শরিফ তাওয়াফ করা এবং মদিনা শরিফ জিয়ারত করা। (১০) হিজরত করা। যে দেশে বা যে সমাজে থেকে দিন-ইমান রক্ষা করা যায় না, সে দেশ বা সমাজ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়া বা পরিবর্তনের চেষ্টা করা। (১১) আল্লাহর ওয়াস্তে মানত করলে তা পূর্ণ করা। (১২) আল্লাহর নামে কোনো জায়েজ কাজে কছম করলে, তা পূরণ করা। (১৩) আল্লাহর নামে কছম করে তা ভঙ্গ করলে তার কাফ্ফারাহ আদায় করা। (নাজায়েজ কাজের কছম করলে তা ভঙ্গ করে কাফ্ফারাহ আদায় করা)। (১৪) কাম-রিপু প্রবল হলে বিবাহ করা। (১৫) স্ত্রী, সন্তানসন্ততি, পরিবার-পরিজন ও অধীনদের হক আদায়। (১৬) সন্তান প্রতিপালন করা এবং তাদের দিনি ইসলামের শিক্ষা দেওয়া। (১৭) আত্মীয়স্বজনের হক প্রদান করা ও তাদের সঙ্গে সদাচার করা। (১৮) আল্লাহর হুকুমের বিপরীত নয় এমন সব বিষয়ে মনিবের বা মালিকের অনুগত থাকা। (১৯) জায়েজ ও হালাল বিষয়ে ওস্তাদ, পীর, মুরব্বিদের অনুগত থাকা। (২০) পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচার করা। (২১) চাকর-বাকর, কর্মচারী ও অধীনদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা। (২২) নেতৃবৃন্দ ও দায়িত্বশীলদের ন্যায়পরায়ণ ও দয়ালু হওয়া। (২৩) আহলুস সুন্নত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভুক্ত থাকা। (২৪) পরোপকার ও মানবকল্যাণে নিয়োজিত থাকা। (২৫) দায়িত্বশীলদের বৈধ নির্দেশ পালন করা। (২৬) সৎ কাজে সহযোগিতা করা ও অসৎ কাজে বাধা প্রদান করা। (২৭) অধীনদের শরিয়ত মতো পরিচালনা করা। (২৮) রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষা করা। (২৯) আমানত রক্ষা করা। মুসলমানের জান, মাল ও ইজ্জত আমানত। (৩০) অভাবগ্রস্তকে কর্জে হাছানা (লাভবিহীন ঋণ) দিয়ে সাহায্য করা। (৩১) ঋণ পরিশোধ করা এবং পরিশোধের পূর্বে তা পরিশোধ করার দৃঢ় ইচ্ছা রাখা। (৩২) পাড়া-প্রতিবেশীর উপকার করা এবং তারা কোনো প্রকার কষ্ট দিলে বা ক্ষতি করলে তা অম্লান বদনে সহ্য করা। (৩৩) কাজ-কারবার, লেনদেন পরিষ্কার রাখা; পাওনা আদায় করতে কঠোরতা ও দেনা পরিশোধ করতে শিথিলতা না করা। (৩৪) মাপে বেশ-কম না করা; পণ্যে ভেজাল না দেওয়া। (৩৫) সুদ-ঘুষ ইত্যাদি থেকে বেঁচে থাকা। (৩৬) সম্পদের সদ্ব্যবহার (বৈধভাবে উপার্জন ও জায়েজ পন্থায় ব্যয়) করা। (৩৭) সালামের জবাব দেওয়া ও হাঁচির উত্তর দেওয়া (দোয়া পড়া)। (৩৮) অবৈধ খেলাধুলা, রং-তামাশা ইত্যাদি হতে দূরে থাকা। (৩৯) ঈদের নামাজ আদায় করা ও কোরবানি করা। (৪০) রাস্তায় কষ্টদায়ক কোনো কিছু থাকলে তা অপসারণ করা। (বুখারি ও মুসলিম)।

মহানবী (সা.) বলেন, “তোমাদের কাছে এ মাস উপস্থিত। এতে রয়েছে এমন এক রাত, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ থেকে যে ব্যক্তি বঞ্চিত হলো সে সমস্ত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। কেবল বঞ্চিত ব্যক্তিরাই তা থেকে বঞ্চিত হয়।”  (সুনানে ইবনে মাজাহ)

রমজান- ২৭   ২৯.০৪.২২

আজ নাজাতের দশকের সপ্তম দিন।

যদিও রমজানের শেষের দশকের বেজোড় রাত্রে লায়লাতুল কদর খোঁজার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তবুও আমাদের এই অঞ্চলে ২৭শে রমজানকে লায়লাতুল কদর হিসেবে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে উদযাপন করা হয়।

তারই ধারাবাহিকতায় গত রাত্রে আমরা আন্তরিকতার সাথে, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যয়ের সাথে লায়লাতুল কদরের ইবাদত করেছি। 

লায়লাতুল কদর এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ রাত যাকে নিয়ে আল্লাহ্‌ সম্পূর্ণ একটা সুরা “সুরা কদর” অবতীর্ণ করেন। এর থেকেই লায়লাতুল কদরের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়। 

২৭ এর পরও বেজোড় ২৯ ‘এর রাত্র অবশিষ্ট থাকে যে রাত্রে লায়লাতুল কদর পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। আমরা রমজানের অবশিষ্ট রাতগুলো অত্যান্ত যত্নের সাথে ইবাদত বন্দেগীতে কাটাবো ইনশাল্লাহ, বিশেষত ২৯ এর রাত হয়তো কদরের ফজিলত নিয়ে আসতে পারে আমাদের জীবনে। 

মুসা (আঃ) সহিফাঃ  “যে মৃত্যুর দৃঢ় বিশ্বাস রাখে সে কিরুপে আনন্দিত থাকে? যে বিধিলিপি বিশ্বাস করে সে কিভাবে অপরাগ, হতদ্যাম ও চিন্তাযুক্ত থাকে? দুনিয়ার পরিবর্তনাদী ও মানুষের উত্থান পতন দেখে সে কিভাবে দুনিয়া নিয়ে নিশ্চিত থাকে? যে পরকালে বিশ্বাসী সে কিভাবে কর্মত্যাগ করে  নিশ্চিন্তে বসে থাকে?” 

নশ্বর এই জীবন, সসীম এই দুনিয়া যেহেতু আমাদের স্থায়ী আবাস না, সেই অনন্ত পরকালীন জীবনের সুখ ও শান্তির জন্য, অতীতের গোনাহ থেকে আল্লাহ্‌র থেকে নাজাত পাওয়ার জন্য আর মাত্র ২-৩ টা দিন অবশিষ্ট আছে। 

হতে পারে সামনের দিনগুলোর তাওবা ও ইবাদতের কল্যাণে আমরা আমাদের কাঙ্ক্ষিত মাগফেরাত ও নাজাত পেয়ে যেতে পারি, ইনশাল্লাহ।

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে বাকি রোজাগুলো পরিপূর্ণ বিধান অনুযায়ী পালন করার ও রোজা পরবর্তী জীবন ইসলামের বিধি বিধান মোতাবেক পরিচালিত করে “আল্লাহ্‌র হক” ও “মাখলুকের হক” আদায় করে এক রূপান্তরিত জীবন যাপন করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন। 

রমজান- ২৬

নাজাতের দশকের ষষ্ঠ দিন।

আজ রমজানের ২৬তম দিন।

পবিত্র লায়লাতুল কদর’এর রাত। বৃহস্পতিবার দিবাগত জুম্মাতুল বিদা ‘র পবিত্র রাত।

হাজার রাতের চেয়ে উত্তম এ রাত। “খায়রুম মেন আলফে শাহার।” আমরা সবাই জানি। অনেক জানি অনেকে।

যেটা জানি না তা হচ্ছে, সেজদায় আল্লাহর কাছে মিনতি করার আগে, মোনাজাতে চোখের পানিতে দুই হাত ভেজানোর আগে শুধু মুসলমান না, শুধু মানুষ না, সমস্ত মাখলুকের হক আদায় করে, রিজিক হালাল করে আল্লাহর দরবারে হাজির হয়ে কাকুতি মিনতি করলে আল্লাহ আমাদেরকে মাফ করে দিবেন, ইনশাআল্লাহ।

যদি তা না করা হয় তাহলে সব পরিশ্রম, সব কাকুতি শুধু সময়ের অপচয়ই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে মাখলুকের হক আদায় করে ও রিজিক হালাল করে তার সামনে জায়নামাজে দাঁড়ানোর তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।

রমজান- ২৫

আজ পবিত্র রজানের ২৫তম দিন। 

নাজাতের দশকের পঞ্চম দিন।

হযরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, “মাহে রমজানের প্রথম রজনীতেই শয়তান ও দুষ্ট জিনদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। দোজখের দরজাসমুহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং এর একটি দরজাও আর খোলা হয় না। বেহেস্তের দরজাসমুহ খুলে দেয়া হয় এবং এর একটি দরজাও আর বন্ধ করা হয় না। এমাসে একজন আহ্বানকারী ঘোষণা দিতে থাকেন, হে কল্যাণ অন্বেষণকারী অগ্রসর হও, আর হে পাপাসক্ত বিরত হও। আর এ মাসে আল্লাহ অজস্র লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। এবং প্রতি রাতেই এরূপ হতে থাকে। (তিরমিযী)

উপরের হাদিছের ভিতরে সব কিছুর বর্ণনা করে দেওয়া আছে।

এবার আমাদের কাজ হচ্ছে আল্লাহ্‌র সামনে নত হয়ে সমস্ত অপরাধ থেকে সরে এসে ক্ষমা চাওয়া। মিনতির সাথে মোনাজাত করা। 

মোনাজাত আরবী শব্দ যার অর্থ কারো সাথে নিচুস্বরে কথা বলা।

মুমিন যখন সলাতে দাঁড়ায় তখন সে আল্লাহর সাথে চুপে চুপে কথা বলে। মুমিনের পুরো সলাতই হলো মোনাজাত।

মোনাজাত হতে হবে ভয় ও আশা এই দুইয়ের সংমিশ্রণে। নিজের অপরাধ সমূহ স্মরণ করে শাস্তির ভয়ে প্রকম্পিত হওয়া ও অন্যদিকে রহমানুর রহীম আল্লাহ্‌র দয়ার কথা স্মরণ করে আশান্বিত হওয়া যে আল্লাহ্‌ মাফ করে দিবেন এই মানসিকতা নিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে কাতর মিনতি জানালে আসা করা যায় আল্লাহ্‌ আমাদেরকে মাফ করে দিবেন।

যদিও আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ”লা তাকনাতু মেররাহমাতিল্লাহ।” আল্লাহ্‌র রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ্‌ বলেছেন আদেশমূলক বাক্যে কিন্তু আমরা গোনাহগার তাই ভয়ে ভয়ে আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রত্যাশা করবো যে আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করলে মাফ করে দিতে পারেন। 

অন্যত্রও আল্লাহ্‌ বলেছেন, “ফা ইয়াগফিরু লিমাইয়াশাউ, ও ইউ আজ্জেবু মাইয়ুশাউ…” (সুরা বাকারা, আয়াত-২৮৪)  তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন এবং যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন। এখতিয়ার একমাত্র তাঁরই।     

কোরানের মাস এই রমজানে বেশী বেশী কোরান তেলাওয়াত ও অর্থ বুঝা অন্যতম জিকির। বুঝা জিনিশগুল নিজের দৈনন্দিন জীবনে আমল করা শ্রেষ্ঠ জিকির। আর জিকির অর্থ স্মরণ করা। আল্লাহ্‌র রহমত ও নিয়ামতের কথা স্মরণ করে আল্লাহ্‌র প্রতি কৃতজ্ঞ হলে এবং মাখলুকের হক আদায় করলে আমরা আশা করতে পারি আল্লাহ্‌ আমাদেরকে এই নাজাতের দশকের অসিলায় নাজাত দিয়ে দিবেন।

“শোন শোন ইয়া ইলাহী

আমার মোনাজাত।

তোমারি নাম জপে যেন,

(আমার) হৃদয় দিবস-রাত।”- কাজী নজরুল ইসলাম 

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে নামাজ ও নামাজ বহির্ভূত সমস্ত রকমের আন্তরিক মোনাজাত করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।  

আজ পবিত্র মাহে রমজানের ২৪তম দিন।

নাজাতের দশকের চতুর্থ দিন।

আজকের দিন সহ আর মাত্র সাতটা দিন আছে এর মধ্যে আমাদের নিজদেরকে সংশোধন করে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে ও তাঁর মাখলুকের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে নাজাত প্রাপ্তির পথে হাটতে হবে। 

রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের দশকের যদি দশক অনুযায়ী আমরা আলোচনা করি তাহলে দেখতে পাবো যে রহমতের দশকেই আমরা আঁটকে গেছি। কারণ আল্লাহ্‌ আমাদেরকে যে যে নিয়ামত দিয়ে রহম করেছেন তার শোকর করা আমাদের জন্য অবশ্য করণীয় যদিও আমরা তা কম করে থাকি। 

মানুষের অবচেতন মন সব সময় হাতের নাগালের বাইরের না পাওয়া স্বপ্নের জিনিস গুলোর প্রতি নিবদ্ধ থাকে। আলরেডি যে যে অপরুপ নিয়ামতে সমৃদ্ধ আমরা তার থেকে নজর ফিরায়ে রাখি। 

এই নিয়ামতের শোকরগোজারী  না হওয়া এক নাফরমানী কাজ। কারণ আল্লাহ্‌ কোরআনে বলেছেন, ”ওলা এন কাফারতুম, ইন্না আজাবি লা শাদিদ।”  যদি তোমরা শোকর না কর বা অস্বীকার কর তাহলে জেনে রেখ আমার আজাব ভয়ঙ্কর, কঠিন।

আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের নজর এড়ায়ে যায় তা হচ্ছে,  আল্লাহ্‌র নিয়ামতের সহিহ ব্যবহার না করা। নিয়ামত পাওয়ার চেয়ে নিয়ামতের ব্যবহার ও সংরক্ষণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতিতে একটা কথা বলা হয়, “It is difficult to spend money than to earn.”  টাকা উপার্জনের চেয়ে খরচ করা কঠিন। কঠিন বলতে সঠিক ভাবে খরচ করা। নইলে এটা অপচয়ের পর্যায়ে পড়ে ও মানুষ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। 

তেমনই আল্লাহ্‌র নিয়ামত পাওয়া সহজ। সৎ, অসৎ, চোর ডাকাত, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আল্লাহ্‌ নিয়ামত বণ্টন  করেন কিন্তু এই নিয়ামত শরিয়তের বিধান মতো ব্যবহার না করলে এর জন্য হিসাব দিতে হবে। আল্লাহ্‌র দেওয়া হালাল নিয়ামত সঠিক ব্যবহার না করার জন্য গনাহগার হওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। 

পবিত্র কালামে পাকে আল্লাহ্‌ ঘোষণা করেন,

“ইন্নাল ইনসানা লি রাব্বিহি লাকানুদ”

অর্থাৎ, নিশ্চয় মানুষ তার রবের প্রতি বড়ই অকৃতজ্ঞ” (সূরা যিলযাল)

বিপদে পড়লেই মানুষ সর্বান্তকরণে আল্লাহ্‌কে ডাকতে থাকে। আল্লাহ্‌ সাড়াও দেন। কিন্তু বিপদ চলে গেলে বান্দা অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়। আল্লাহ্‌র সাহায্যের কথা ভুলে যায়।  বিপদ কেটে গেলেই মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়।

আরবি শব্দ “কানুদ” -এর অর্থ শুধু অকৃতজ্ঞ না অন্য আর একটা অর্থ আছে। তখন নাম বাচক বিশেষ্যে অর্থ দাঁড়ায়, “যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নিয়ামতকে গোনাহের কাজে ব্যবহার করে তাকে “কানুদ” বলে।” 

এবার যদি আমরা আমাদের হালাল উপার্জনের অর্থ শরীয়ত মোতাবেক ব্যয় না করে অন্য পথে ব্যয় করি তাহলে আমরাও “কানুদ” -এর গোত্র ভুক্ত হবো এবং নাফরমান, গোনাহগারের খাতায় নাম লেখা হতে পারে। 

আমরা একটু অন্তর্মুখী হয়ে, নিজের ভিতরে ডুব দিয়ে যদি তালাশ করি তাহলে দেখতে পারবো আমরা আমাদের সমস্ত নিয়ামতকে কি কি কাজে ব্যবহার করি। তখন পরিষ্কার হবে কোথায় কোথায় সংশোধন করতে হবে।

আল্লাহ্‌ ঘোষণা করেছেন, ”আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর উপর প্রবল থাকবে।”  আশা করা যায় আল্লাহ্‌ ও তাঁর মাখলুকের হক আদায় করলে আল্লাহ্‌ আমাদেরকে মাফ করে দিবেন।

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে তাঁর দেওয়া নিয়ামতের শরিয়ত সম্মত ব্যবহার করার তৌফিক দেন। আল্লাহ্‌ ও তাঁর মাখলুকের হক আদায় করে আমরা আল্লাহ্‌র কাছ থেকে এই রমজানের অসিলায় মাগফেরাত ও নাজাত লাভ করতে পারি এই মোনাজাত করি। আমীন। 

23. আজ পবিত্র মাহে রমজানের ২৩তম দিন।

নাজাতের দশকের তিন দিন প্রায় শেষ।

আমাদের শ্রমনির্ভর জীবনে কোশেশ করে আললাহর কাছ থেকে মুক্তি বা পানাহ পাওয়ার সময় শেষ হয়ে আসছে।

পবিত্র কোরানে আল্লাহ বলেন,

“লাকাদ খালাকনাল ইনসানা ফি কাবাদ।”- সুরা বালাদ

অর্থাৎ নিশচয়ই আমি মানুষকে শ্রমনির্ভর হিসেবে তৈরী করেছি।

আমরা পেশাজীবিরা সকালে উঠে তড়িঘড়ি করে তৈরী হয়ে দিনের কাজ শুরু করি।

এই কাজ দুই প্রকারেরঃ

এক) চাকরীর কর্মস্থল বা নিজের ব্যবসার যায়গা। যেখান থেকে মুনাফা অর্জন করে আমরা জীবন নির্বাহ বা অন্য কাজ করি।

দুই) ঐ ব্যবসা বা কর্মস্থলে কাজ করে নিজের প্রতিদিনের পরকাল হাসিল করি।কেউ সফল হয় ও পরকালের আযাব থেকে মুক্ত হয় আবার কারো কারো শ্রম ও প্রচেষ্টা তার ধ্বংসের কারণ হয়।

সুতরাং আমাদের প্রতিদিনের কাজের কোয়ালিটি এমন হওয়া উচিত যার মাধ্যমে আমরা ইহকাল ও পরকালের কল্যান এক সাথে অর্জন করতে পারি।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা ভোগবাদের অসওয়াসায় এমন ভাবে মত্ত হয়ে পড়ি যে হালাল হারামের বাছ বিচার করি না। এতে সাময়িক জাগতিক তথাকথিত সাফল্য আসলেও আসলে তা আমাদের জন্য ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে।

মাহে রমজানের নাজাতের দশকে এসে আমাদেরকে একটু অভিনিবেশ সহকারে ভাবতে হবে যে আমরা সত্যিকারে কোথায় চলেছি।

এতেকাফের অনেক কল্যানের এটাও একটা দিক যে বান্দা মসজিদের নির্জনে বসে হিসাব করতে পারে কি তার জীবনের অর্জন ও কোথায় তার ঘাটতি আছে। সে অনুযায়ী সে পরিকল্পনা করে, কর্মপদ্ধতি তৈরী করে সামনের দিনগুলোতে এগুতে পারে।

জাগতিক মোহ আমাদেরকে এতই অন্ধ করে রেখেছে যে কাজের তাড়ায় আমরা ফুরসত পাই না প্রতি দিনের কাজের ইহ-পরকালীন আয় ব্যয়ের হিসাব মিলাতে।

দুনিয়াবী সম্পদ অর্জনকে যতই সফলতা হিসেবে দেখা হোক না কেন বস্তুত জীবনোপকরণের সমাহার সৎ ও আললাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার আলামত না।

তেমনি অভাব অনটন ও দারিদ্র্য প্রত্যাখ্যাত ও লাঞ্চিত হওয়ার দলীল না।

সুতরাং সম্পদ যেহেতু সফলতা ও বিফলতার দলীল না, তাই নিজের প্রতিদিনের কর্মকে যদি ব্যবসা হিসাবে ভেবে দিনশেষে নিজের কাছে হিসাব নেওয়া যায় যে আমার আজকের ব্যবসায়ে পরকাল অর্জন করলাম না পরকাল খোয়ালাম তাহলে দিনান্তের প্রান্তে এসে হাহাকার করতে হবে না।

আল্লাহ আমাদেরকে নামাজের হক, রোজার হক, মাখলুকের হক সহ যাবতীয় হক আদায় করে আল্লাহর কাছ থেকে মোনাজাত করে নাজাত লাভ করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।

22. আজ পবিত্র রমজানের ২২তম দিন।

নাজাতের দশকের দ্বিতীয় দিন।

আললাহর কাছ থেকে নাজাত বা মুক্তি পেত হলে আললাহ ও তার মাখলুকের প্রতি প্রতিটি কাজ চুলচেরা হিসেব করে করতে হবে।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সহিফায় আললাহ সুবহানাল্লাহ ঘোষণা করেন, “হে ভূঁইফোড় বাদশাহ, আমি তোমাকে ধন ঐশ্বর্য স্তুপিকৃত করতে বাদশাহী দেই নাই।

বরং দিয়েছি যাতে মজলুমদের বদ দোয়া আমার আললাহ পরযন্ত না পৌঁছায়।

কেননা, আমি মজলুমের দোয়া ফিরায়ে দেই না। যদিও তা কাফেরের মুখ থেকে হয়।”

সুতরাং আমাদেরকে যা যা সম্পদ ও সামর্থ্য দেয়া হয়েছে তার উত্তম ব্যবহার করতে হবে। অন্যের পাওনা হক আাদায় করতে হবে। যদি বান্দা জুলুমের শিকার হয় ও আললাহর দরবারে হাত তুলে দোয়া করে তাহলে সেই দোয়া কবুল হয়। কারণ আললাহ ও মজলুমের মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না।

আললাহ আমাদেরকে হেদায়েত করুন, সিরাতুল মুসতাকিমে পরিচালিত করুন যাতে আমরা কারো কাছে জালেম হিসেবে উপস্থিত না হই।

কারো প্রতি কোনো জুলুম করলে তার কাছ থেকে আগে মাফ চেয়ে নিয়ে তারপর আললাহর কাছে রোজা রেখে, নামাজের হক আদায় করে ও অন্যান্য ইবাদত সঠিক ভাবে আদায় করে, নাজাতের দরখাস্ত করলে হয়তো আললাহ মাফ করে দিতে পারেন। নাজাত দিতে পারেন।

আমাদের হাতের অবশিষ্ট অল্প সময়ের মধ্যে আমরা যাতে বান্দার হক আদায় করে, প্রযোজনে বান্দার কাছ থেকে মাফ চেয়ে নিয়ে সেজদায় পড়ে আললাহর কাছে নাজাত প্রার্থনা করতে পারি সেই এরাদাই পোষন করি।

আললাহ আমাদেরকে এ তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।

নাজাত।

21. আজ রমজানের ২১তম দিন।

নাজাতের দশকের প্রথম দিন শুরু।

এর মধ্য দিয়ে শেষ হবে পবিত্র মাহে রমজান।

আমরা সবাই নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী রমজানের ইবাদত ও দান সদকা করে যাচ্ছি। প্রতি মোনাজাতে আললাহর কাছে আমাদের ইবাদতের-দারিদ্র্যতা উল্লেখ করে এই অসম্পূর্ণ ইবাদত কবুল করে আমাদেরকে রমজানের রহমত, মাগফেরাত ও নাজাত দেওয়ার জন্য আকুল আকুতি জানাচ্ছি।

আমরা প্রতিটা লেনদেন যদি গভীর দর্শনের দৃষ্টিতে দেখি তাহলে দেখতে পাবো যে প্রতিটা প্রাপকের প্রাপ্য হিসাব করে বুঝায়ে দেওয়া শরিয়তের বিধান।

এই দেনাপাওনাকে কেন্দ্রে রেখে আললাহ একটি সুরা নাজিল করেন। তা হচ্ছে সুরা “তাতফীক.”

“তাতফিক” অর্থ প্রাপককে মাপে বা ওজনে কম দেওয়া। প্রাপককে ওজনে কম দেওয়া অপরাধ। হারাম।

শুধু দুনিয়াবী মাল সম্পদের বেলায়ই না, আললাহর সামনে নামাজে দাড়ায়ে যদি রুকু সেজদা ঠিক মতো আদায় না করা হয় তাও “তাতফীক।”

হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) একদিন এক নামাজিকে রুকু সেজদা ঠিক মতো আদায় না করতে দেখে বললেন, “তুমি তো আল্লাহর প্রাপ্য আদায়ে “তাতফীক” করছো।”

শুধু দুনিয়াবী লেনদেন না,

নামাজ সহ সব রকমের ইবাদতে যদি “তাতফীক” করা হয় তাহলে সেই ইবাদত আল্লাহর কাছে কতটুকু গ্রহনযোগ্য হবে তা নিজেদেরই ভেবে দেখা উচিত।

আমরা জেনেছি আম্বিয়া ও আউলিয়া কেরামেরা নামাজ পড়তে শুরু করলে এক আয়াত তেলাওয়াত করে এত দীর্ঘ সময় নীরব উপলব্ধিতে কটাতেন যে অন্যরা ভাবতো উনি হয়তো পরবর্তি আয়াত ভুলে গেছেন।

অথবা, এত দীর্ঘ সময় নামাজে দাড়ায়ে থাকায় পাখীরা গাছ বা খাম্বা মনে করে মাথার উপর বসে পড়েছে।

আর আজকের সময়ে আমাদের অস্থির ভাবে নামাজ পড়া দেখলে অবাক হতে হয়।

আললাহ আমাদেরকে “তাতফীক” থেকে রেহাই দিন। ইবাদতের মর্যাদা রক্ষা করে আভিজাত্যপূর্ণ ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নেক নজর লাভ করতে পারি আললাহ আমাদেরকে সেই তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *