রমজান-১০

আজ পবিত্র রমজানের দশম দিন। রহমতের শেষ দিন। 

পবিত্র কালামে পাকের সুরা আম্বিয়ার ১০৭ নবমর আয়াতে আল্লাহ্‌ বলেন, “ওমা আরসালনাকা ইল্লা রহমাতাল্লেল আলামিন।”

অর্থাৎ, হে নবী আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য কেবল রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।

পবিত্র কোরানে আল্লাহ্‌ মানুষকে দুইভাবে সম্বোধন করেছেনঃ এক- “ইয়া আয়্যুহাল্লাজিনা আমানু”  হে ইমানদারগণ বা তোমরা যারা ঈমান এনেছো। 

দুই- “ইয়া আয়্যুহান নাস” হে মানব মণ্ডলী। 

শুধু ঈমানদারদের জন্য সম্মধন সসীম অর্থে অর্থাৎ শুধু মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে বলা। আর যখন মানব মণ্ডলী বলে সম্মধন করা হয় তখন অসীম অর্থে অর্থাৎ বিশ্বজগতের সমস্ত মানুষকে লক্ষ্য করে বলা হয়। 

উপরের আয়াতে “আপনাকে সমগ্র বিশ্বজগতের” বলে জগতের সমস্ত মানুষ,জীন ও অন্যান্য মাখলুককে বোঝানো হয়েছে। 

মানুষ ভিন্ন অন্য মাখলুকের জন্য যে নবীজী রহমত স্বরূপ তার প্রমাণে একটা উদাহরণ দেইঃ

যুদ্ধলব্ধ গনিমতকে নবীজী (সঃ) ৫ ভাগ করলেন। ১ ভাগ নিজের অধীনে রাখলেন। ৩ ভাগ অশ্বারোহী বাহিনীকে দিলেন এবং ১ ভাগ পদাতিক বাহিনীকে দিলেন।  

এই ৩ ভাগ অশ্বারোহী বাহিনীকে দেওয়ার কারণ এর থেকে ১ ভাগ পাবে সৈনিকটা ও ২ ভাগ পাবে তাকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে বইয়ে নেওয়া, যুদ্ধ করা ঘোরাটা!! 

আল্লাহ্ তাঁর রহমতকে যেমন পাপী পুণ্যবান সবার জন্য সমান ভাবে বণ্টন করেন যেমন, বৃষ্টি, রোদ, সূর্যর আলো, ফল, ফসল ইত্যাদি শুধু বিশেষভাবে মুসলমানদের জন্য না, জগতের সকল মানুষের জন্য। 

ঠিক তেমনি আল্লাহ্‌র শ্রেষ্ঠ রহমত তাঁর নবীকে জগতের সকলের জন্য বলে ঘোষণা করেন। 

রহমতের দশ দিনের শেষ দিনে আমাদের প্রার্থনা আমরা যেন আল্লাহ্‌র পাঠানো শ্রেষ্ঠ রহমত নবী করীম (সঃ) কে উত্তমরূপে উপলব্ধি করতে পারি ও তাঁর দেখানো পথে চলে জীবনকে সাজাতে পারি সার্থক করতে পারি।  

নবী করীম (সঃ) এর গুরুত্ব বোঝানর জন্য আল্লাহ্‌ এরশাদ করেন, 

“ইন্নাল্লাহা ওয়ামালাইকাতাহু ইউসাল্লুনা আলান্ নাবিয়্যি ইয়া আইয়্যু হাল্লাজিনা আমানু সাল্লু সালাইহি ওয়া সাল্লিমু তাসলিমা।”

অর্থাৎ আল্লাহ তার ফেরশতাকুল নিয়ে নবীর উপর দরুদ কালাম প্রেরণ করেন। যারা ইমান এনেছ তারা আমার নবীকে যথাযথভাবে দরুদ ও সালাম প্রদান কর।

এ সালাম আমরা দৈনন্দিন জীবনে যে সালাম বিনিময় করি তার মতো না। এটা বিশেষ সালাম। এ সালামকে আল্লাহ্‌ সসীম করে বলেছেন,  “যারা ইমান এনেছ তারা” নবীর প্রতি সালাম প্রদান কর। 

এর পর আসবে কোরানের সেই মহান ঘোষণা, “কুল এন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহ, ফাত্তাবিয়ুনি।”  অর্থাৎ তোমরা যদি আল্লাহ্‌কে ভালবাস তাহলে আমাকে অনুস্মরণ কর। সরল অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহ্‌র আনুগত্য করতে হলে রসূলের (সঃ) দেখানো পথেই হতে হবে।

“ আল্লাকে যে পাইতে চায়, হজরতকে ভালবেসে,

আরশ কুর্সী লওহ কালাম না চাইতেই পেয়েছে সে।

………………………………………………………….

এই দুনিয়ায় দিবা- রাতি

ঈদ হবে তোর নিত্য সাথী;

তুই যা চাস তাই পাবি হেথায়, আহমদ চান যদি হেসে।”- কাজী নজরুল ইসলাম

নবী (সঃ) যার রহমতের ভাণ্ডারে আছে সে কেন অন্য রহমতের কাঙাল হয়ে হন্যে হয়ে ফেরে?

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে তাঁর শ্রেষ্ঠ রহমত নবী করীম (সঃ) কে চেনার, জানার ও উপলব্ধি করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।  

রমজান-৯

আজ পবিত্র রমজানের নবম দিন। রহমতের আর একদিন বাকি।

আল্লাহ্‌ কালামে পাকে ঘোষণা করেন, “যদি তোমরা আমার নিয়ামতের শোকর কর তাহলে আমি আমার নিয়ামত আরও বাড়ায়ে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও তাহলে জেনে রেখো আমার শাস্তি ভয়ঙ্কর কঠিন।” 

আমরা আল্লাহ্‌র নিয়ামতের সাগরে ডুবে আছি যেমন মাছ পানিতে থাকে। মাছকে পানির উপরে উঠালেই কেবল সে বুঝতে পারে কোন নেয়ামতের দরিয়ায় সে ডুবে ছিল। 

আমাদের বেলায়ও তাই। আমাদের থেকে নেয়ামত সমূহ সরায়ে নিলেই কেবল আমরা বুঝতে পারি কোন নেয়ামতে আমরা ছিলাম। কঠিন করোনা কালে অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে শুরু অনেক কিছুতেই বুঝতে পেরেছি আল্লাহ্‌র নেয়ামত কি জিনিস। 

পাশাপাশি বান্দার থেকে পাওয়া সাহায্য ও নেয়ামতের জন্য শোকর করতে হয়। 

আরও বেশী পাওয়ার লোভে ছুটতে ছুটতে আমরা অলরেডি পাওয়া নেয়ামতের কথা ভুলে যাই। শোকর করতেও ভুলে যাই। আর এই ভুলে যাওয়া আল্লাহ্‌র আদেশের নাফরমানী করা। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তাঁর নাফরমান বান্দাকে ক্ষমা করবেন না।

আল্লাহ্‌র নেয়ামত, রহমত ও বান্দার কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের শোকর না করার পরিণাম একটা ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে জানার চেষ্টা করি।

বাবা সম্রাট শাহজাহানকে আগ্রা দুর্গে বন্দী করে, বড় ভাই দারা’কে শিরচ্ছেদ করে, আর এক ভাই সুজাকে তাড়ায়ে আরাকানে দূর করে আওরঙ্গজেব মোঘল সিংহাসনে আরহন করেন।

উৎসব শেষে নানা দেশে অজস্র উপঢৌকন সহ দুত পাঠানো শুরু করেন। পারস্যে দুত পাঠালে পারস্যরাজ তাকে ইজ্জতের সাথে অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেন। 

দুতের দেওয়া সমস্ত উপঢৌকন অবজ্ঞাভরে প্রাসাদের কর্মীদের মাঝে বিলিয়ে দেন। শুধু ৬০ ক্যারেটের একটা হীরা নিজের জন্য রাখেন।

কিছুদিন পর পারস্যাধিপতি বল্লেন, ”তুমি কি তাদের একজন না যারা  আওরঙ্গজেবকে রক্ত ক্ষয় করে, ভাইকে খুন করে, বাবাকে বন্দি করতে সাহায্য করেছ? অথচ তোমরা সবাইতো সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকেও সন্মান ও সুযোগ সুবিধা নিয়েছিলে। কিন্তু আজ নেমকহারামি করলে।”

পারস্যরাজ দুতের দাঁড়ি কেটে ফেলার হুকুম দিয়ে বল্লেন তুমি দাঁড়ি রাখার মতো ইজ্জতের যোগ্য না। 

দেড়শ উন্নত জাতের ঘোড়া, গালিচা, কিংখাব, মুল্যবান কাপড়চোপড় দিয়ে দুতকে বিদায় করে দিলেন। 

দুতের মুখে সব শুনে আওরঙ্গজেব রাগে ফুসতে লাগলেন। ঘোড়া গুলোকে সাধারণ যায়গায় রেখে শিয়াদেরকে অপবিত্র অবস্থায় ঐ ঘোড়ায় চড়তে আদেশ দিলেন। (পারস্যে শিয়া‘রা সংখ্যাগুরু হওয়ায় তাদের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ হয়ে এই আদেশ দেওয়া।) 

এই টুকু মনঃপুত না হওয়ায় ঘোড়া গুলোকে হত্যার নির্দেশ দেন। উপঢৌকন পুড়ায়ে ফেলতে বলেন। তাও মনঃপুত না হওয়ায় হিংসায় জ্বলতে জ্বলতে পারস্যরাজকে অজস্র গালিগালাজ করতে থাকেন।

উপকারির প্রতি অকৃতজ্ঞ হওয়া, ক্ষমতার গর্বে অন্ধ হওয়া, মোনাফেকি করা এই সমস্তই ইসলামে নিষিদ্ধ। কিন্তু এই সমস্ত নেগেটিভ ইমোশন ও আচরণ আমাদেরকে দিন দিন অতলে নিয়ে যাচ্ছে। 

একজন ভিন্নধর্মাবলম্বী কোরান হাদিছ পড়বেন না, তিনি দেখবেন আপনাকে, আমাকে। আপনার, আমার চেহারায়, আচরণে তিনি দেখবেন ইসলামকে। তাহলে আমরা যদি ইসলামের অনুশাসনগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিফলিত না করি তাহলে অন্যেরা কি শিখবে আমাদের থেকে? আমরাই বা কি করে নিজেদেরকে পরিশুদ্ধ করবো ও রমজানের ফজিলত হাসিল করবো?

আল্লাহ্‌ ইসলামের অনুশাসনগুলোকে আমাদের ও আমাদের পরিবারের সবার পক্ষে আমলের তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।   

রমজান-৮

আজ পবিত্র রমজানের অষ্টম দিন। 

ওয়াদা ভঙ্গ ও আমানতের খেয়ানতের জন্য আমাদের সমাজের অনেক বন্ধন ও শৃঙ্খল অত্যান্ত নাজুক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।  

ওয়াদা এবং আমানত কেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আজ আমরা বনু কোরাইযার যুদ্ধের এক ঘটনার আলোকে উপলব্ধি করব।

অবরুদ্ধ বনু  কোরাইযার ইহুদীরা নবী করীম (সঃ) ‘র কাছে প্রস্তাব দিলো যে  মুসলমানদের পক্ষ থেকে  আবু লোবাবাকে তাদের কাছে দুতিয়ালির জন্য পাঠানো হউক। কারো ছিল এই, আবু লোবাবার (রাঃ)’র বাগান ও পরিবার ঐ অঞ্চলে ছিল। সখ্যতা ছিল। ইহুদীদের ধারণা ছিল আবু লোবাবা (রাঃ) ইহুদীদের নিরাপত্তার পক্ষে কাজ করবে। 

ইহুদীরা আবু লোবাবা (রাঃ) কে বলল, ”আপনি কি চান আমরা মহাম্মাদের প্রস্তাব অনুযায়ী তাঁর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করি?” 

আবু লোবাবা (রাঃ)  বল্লেন। হ্যাঁ, চাই। এর পরই তিনি নিজ গলায় হাত দিয়ে ইঙ্গিত করলেন যার অর্থ তোমরা অস্ত্র সমর্পণ করতে পারো তবে এর পরই তোমাদেরকে হত্যা করা হবে।

পরক্ষনেই আবু লোবাবা (রাঃ) ‘র মনে পড়ে গেলো তিনি নবী করিন (সাঃ) ‘র পক্ষ থেকে মধ্যস্থতার জন্য এসেছেন। নিজ কর্মে মর্মাহত হয়ে তিনি মদিনায় ফিরে যেয়ে মসজিদে নববীতে নিজেকে শক্ত করে বাঁধলেন এবং ওয়াদা করলেন আগামীতে কোনদিনও বনু কোরাইযার জমিতে পা দিবেন না। নবী করীম (সাঃ) নিজ হাতে বাঁধন খুলে না দিলে তিনি ঐ অবস্থায়ই থাকবেন। 

ঘটনা শুনে নবী করিন (সাঃ) বল্লেন, ও যদি ভুল বুঝার পর আমার কাছে আসত তাহলে আমি আল্লাহ্‌র কাছে ওর জন্য মাগফেরাতের দোয়া করতাম। এখন তো আমি বাঁধন খুলতে পারবো না যতক্ষণ আল্লাহ্‌ তাকে মাফ না করেন। 

এক নাগাড়ে ৬ রাত মসজিদে নববীতে বাঁধা ছিলেন আবু লোবাবা (রাঃ) । নামাজের সময় তাঁর স্ত্রী এসে বাঁধন খুলে দিতেন। নামাজ শেষে আবার সেই বাঁধন। ৬ দিন পড়ে নবী করীম (সঃ )‘র কাছে আবু লোবাবা (রাঃ)’র তওবা কবুলের ওহি আসে। 

হযরত উম্মে সালমা ঘরের দরোজায় দাঁড়ায়ে আবু লোবাবা (রাঃ) ‘র  তওবা কবুলের ওহির খবর জানালে এক সাহাবী বাঁধন খুলে যান কিন্তু আবু লোবাবা  (রাঃ) রাজী হন নাই। নবী করীম (সঃ) ফজরের নামাজের জন্য বের হয়ে বাঁধন খুলে দেন।

“আল্লাহ তআলা ওয়াদা ভঙ্গকারীর গোনাহ ক্ষমা করবেন না। কেননা অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে বান্দার হক নষ্ট হয়। আর বান্দার হক আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।”

ওয়াদা ও আমানতের খেয়ানত করে কোন লেভেলের অনুতপ্ত হলে একজন মুসলমান এমন আচরণ করতে পারে তাঁর নিজের সাথে। 

আমরা দৈনন্দিন জীবনে অহরহ ওয়াদা ভাঙছি, আমানতের খেয়ানত করছি!! সমাজকে পৌঁছে দিচ্ছি আরও পংকিলতার অতলে। 

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে রমজানের উসিলায় আমাদের ওয়াদা ও আমানতের প্রতি অটল থাকের তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন। 

রমজান-৭    09.04.2022

আজ রমজানের রহমতের সপ্তম দিন। 

আমরা সবাই আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আরও বেশী রহমত প্রত্যাশী। রমজান আসে যায় কিন্তু আমাদের চাহিদা অনুযায়ী সবার ভাগ্যে বর্ধিত রহমত জোটে না। এর পিছনে আমার দৃষ্টিতে প্রধান কারণ দুইটাঃ

১) আমরা প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত নেই। 

কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে যা যেমন করে করা উচিৎ তা করতে পারিনা বা করি না। শেষ পর্যন্ত সেটা সিদ্ধান্ত হিসেবেই থেকে যায় আর রেখে যায় হতাশা।

সিদ্ধান্ত তাঁকেই বলে যখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেনেওয়ালার জীবনাচারের মধ্যে আমুল পরিবর্তন আসে। চলা ফেরা কথা বার্তা, কাজ কর্ম, সঙ্গী সাথী, গল্প আড্ডা, ইবাদত বন্দেগী, আরাধনা উপাসনা, ঘুম ইত্যাদিতে পরিবর্তন আসতেই হবে। 

যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমাদের জীবনাচারের  মধ্যে কোন পরিবর্তন না আসে তাহলে বুঝে নিতে হবে যে এই সিদ্ধান্তে কোন ভালো ফল আসবে না। 

যেমন যদি আমরা মনে করি যে আরবি না শিখলে আমরা ইবাদত বন্দেগীতে উচ্চারিত আয়াতের অর্থ বুঝবো না ও মজা পাওয়া যাবে না তাই আরবি শেখার সিদ্ধান্ত নিলাম। এখন যদি সময় ম্যানেজ করে, উপযুক্ত শিক্ষকের কাছে যেয়ে শেখা শুরু করা না হয় ও লাগে থাকা না হয় তাহলে অনেক অনেক রমজান এসে চলে যাবে কিন্তু আরবি শেখা হবে না। 

অথবা পেশাজীবনে আমরা একজন জি এম হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর মুহূর্ত থেকে যদি আমি নিজেকে ঐ যায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন না করি, কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা অর্জন না করি, দক্ষ হয়ে না উঠি, ইন্ডাস্ট্রির গতিবিধি না জানি, বর্তমান কোম্পানিতে ক্যারিয়ার হবে কি হবে না তা না বুঝি, প্রয়োজনে চাকরি পরিবর্তনের ঝুঁকি না নিতে পারি  তাহলে ঐ সিদ্ধান্ত সিদ্ধান্তই থেকে যাবে জি এম হওয়া আর হবে না। 

২) ঠিক একই ভাবে এক মাস  রমাজানের রোজা রেখে নিজের জীবনে যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে এই রোজা রেখে কোন উপকারই হবে না। কিন্তু আমরা রমজানের রোজা রাখতে রাখতে রমজান থেকে বিশাল রহমত সহ অনেক কিছু প্রত্যাশা করি। 

কিন্তু রমজানের হক আদায় না করে শুধু উপবাস করলে উপবাসের উপকার পাওয়া যেতে পারে কিন্তু রমজানের রোজার অসিলায় কাঙ্ক্ষিত রহমত পাওয়া নাও যেতে পারে। তবে আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করলে আমাদেরকে অভাবিত রহমতের সাগয়ে ভাসাতে পারেন। কারণ আল্লাহ্‌ কালামে পাকে ঘোষণা করেন,” ফাআলুল্লে মা ইউরিদ” তাঁর যা ইচ্ছা তাই করেন।  

রোজাদারদের উদ্দেশ্যে করে কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন, 

ফুরিয়ে এলো রমজানেরি মোবারক মাস।

…………………………………………………….

রোজা রেখেছিলি, হে পরহেজগার মোমিন!

ভুলেছিলি দুনিয়াদারি রোজার তিরিশ দিন;

তরক করেছিলি তোরা কে কে ভোগ-বিলাস?

সারা বছর গুনাহ যত ছিল রে জমা,

রোজা রেখে খোদার কাছে পেলি সে ক্ষমা,

ফেরেশতা সব সালাম করে কহিছে সাবাস।”

তিরিশ দিনের পরের পরিবর্তন বা ট্রান্সফরমেশান যদি না হয় তাহলে রোজার থেকে ভালো প্রত্যশা করা বোকামি। আর তাই হয়ে চলছে আমাদের জীবনে অহরহ। 

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে তাঁর রহমতের সাগর থেকে রহম করুন যাতে আমরা রমজানের হক আদায় করতে পারি এবং রমজানের দেখানো পথে চলে জীবনে কামিয়াবি হতে পারি। আমীন। 

রমজান-৬

প্রতিটা কাজের আমরা একটা প্রতিক্রিয়া দেখি। ইহলৌকিক বা দুনিয়াবী কাজের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনই আধ্যাত্মিক ও  পারলৌকিক জীবনের ক্ষেত্রেও। 

ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া বা ফল থাকতেই হবে।  প্রতিক্রিয়া বা ফল  না থাকতে তাকে আমরা কাজ বলতে পারিনা। এখানে ফিজিক্সের উদাহরণের সাহায্য নিতে পারি। কাজের সংজ্ঞায় ফিজিক্স বলেঃ

কাজ = বল x সরণ ।

W = Fx S যেখানে 

F = বল এবং S = সরণ ।

 কোন বস্তুর উপর বল প্রয়োগ করলে সেই বস্তুর স্থানচ্যুতি হতে হবে।  পইজিটিভ পরিবর্তন হতে হবে। 

পরিবর্তন  যেমন, একটা টেবিল এক যায়গা থেকে অন্য যায়গায় ধাক্কা দিয়ে বা উঁচু করে নিয়ে যাওয়ার জন্য যদি কোন শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সেই শ্রমিক যদি নিদিষ্ট যায়গায় টেবিলটাকে সরাতে না পারে তাহলে তাকে কাজ বলা যায় না এবং আমরা তাকে চুক্তি মোতাবেক পারিশ্রমিক দেব না কারণ বল প্রয়োগ হলেও টেবিলের স্থান চ্যুতি হয় নাই বা  কাজটা হয় নাই। 

পৃথিবীর সমস্ত কাজে বস্তুর স্থানচ্যুতি বা পরিবর্তন হতে হবে।  

আমরা যে নামাজ রোজা করছি তার মাধ্যমেও আমাদের দৃশ্যমান জগতে পরিবর্তন হতে হবে যার ফলে অদৃশ্য জগতেও পরিবর্তন আসবে। 

নামাজ রোজার মাধ্যমে যদি আমাদের আচার আচরণের কোন  পরিবর্তন না হয় তাহলে বুঝে নিতে হবে, “আমি যা ছিলাম, তাই আছি।”

নামাজ রোজার মাধ্যমে আমার থেকে যদি সমস্ত নেগেটিভ ইমোশান বা নফসে আম্মারার খাসলাত ক্রমান্বয়ে  দূর না হয় তাহলে বুঝতে হবে আমাদের নামাজ রোজা হচ্ছে না।  

নামাজ রোজার বাহ্যিক দিকের বাইরে আমাদের তাকাতে হবে। নামাজ রোজায় উচ্চারিত কোরানের আয়াত সমূহ কি বলছে তা জেনে সেই অনুযায়ী যদি আমরা আমাদের পারিবারিক, সামাজিক জীবন গড়তে পারি তাহলে দেখা যাবে আমাদের থেকে লোভ, লালসা, চুরি, ঘুষ, বান্দার হক নষ্ট করা,  হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা, গীবত, রিয়া ইত্যাদি সমস্ত নফসে আম্মারার খাসলাত বা নেগেটিভ ইমোশান ধীরে ধীরে দূর হয়ে গেছে এবং আমরা একটা সুন্দর জীবনের দিকে পা বাড়াচ্ছি। 

ছোট বেলায় বাবার কাছ থেকে একটা হাদিস শিখেছিলাম বাংলায় যার অর্থ হচ্ছে, ”সমগ্র বিশ্ববাসির চরিত্র সুগঠিত করার জন্যেই মাত্র আমি প্রেরিত হয়েছি।” 

নামাজ রোজার মাধ্যমে আমাদের মধ্যের সমস্ত নেগেটিভ ইমোশন দূর হয়ে আমরা উত্তম চরিত্রের অধিকারী হই আল্লাহ্‌ আমাদেরকে এই তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন। 

রমজান-৫

রমজানের বিশেষ শিক্ষা হচ্ছে সংযম। 

সংযম বলতে সাধারনভাবে আমরা কোন প্রলোভন থেকে বিরত থাকাকেই বুঝি। সংযমের জন্য প্রয়োজন  কাজটা সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি, এর প্রভাব ও পরিণাম সম্পর্কে জ্ঞান। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা অতো কিছু না ভেবেই কাজটা করে বসি। এর ফলে ইহকালে হয় খারাপ পরিণতি ও পরকালে অপেক্ষা করছে তার চেয়ে ভয়াবহ পরিণতি। 

দুনিয়া প্রীতির পরিণাম হিসেবে ওহদের যুদ্ধে মুসলমানদের উপর কি ভয়াবহ পরিণতি নেমে আসে আমরা সেদিকে একটু দৃষ্টিপাত করি। 

বদরের যুদ্ধে অসম লোকবল নিয়ে অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন ছিল মুসলমানদের জন্য সুদূর প্রভাববিস্তারকারী এর বিস্ময়কর ঘটনা। এই যুদ্ধেই মক্কার কুরাইশদের প্রধান প্রধান নেতারা নিহত হয়। পরাজয়ে ফুঁসে ওঠা কাফেররা বিশাল প্রস্তুতি নিয়ে পরবর্তী বৎসর ওহদের প্রান্তরে মুসলমানদের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার মানসে উপস্থিত হয়। 

সৈন্যবিন্যাস করে নবী করীম (সঃ) সবাইকে উপদেশ, নসিহত করেন। 

নবী করীম (সঃ) কানাত উপত্যাকার দক্ষিণ পূর্বে পাহাড়ের গিরিপথে তীরন্দাজদের ছোট্ট বাহিনী নিযুক্ত করে বলেন,             ”তোমরা ঘোড় সওয়ার শত্রুদের দিকে তীর নিক্ষেপ করে তাদেরকে আমাদের থেকে দূরে রাখবে। তারা যেন আমাদের উপর পিছন দিক থেকে আক্রমণ করতে না পারে। জয় পরাজয় উভয় ক্ষেত্রেই তোমরা তোমাদের অবস্থানে অটল থাকবে, কোন অবস্থাতেই অন্য দিকে যাবে না। যদি তোমরা দেখো যে আমরা মারা পড়ছি তবুও তোমরা আমাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসো না। যদি দেখো আমরা বিজয়ী হয়ে গণিমতের মাল সংগ্রহ করছি তাহলেও তোমরা তোমাদের যায়গা ছেড়ে সরে যেও না।”

কিন্তু এখানেই মুসলমান সৈন্যরা ভয়ানক ভুল করে বসলেন। মুসলমান সৈন্যদেরকে  গণিমতের মাল সংগ্রহ করতে দেখে সংযম ধরে রাখতে পারলেন না।   

এই দলের নেতা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রাঃ) সৈন্যদেরকে নবী করিম (সঃ) ‘এর নির্দেশ মনে করায়ে দিলেও তারা দল নেতার কথা কনে তুলল না। মনের খুশীতে গণিমতের মাল সংগ্রহ করতে লেগে গেলেন। 

খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (তখনও মুসলমান হন নাই) তিন বার  এই গিরিপথ দিয়ে আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। এইবার তীরন্দাজদের ভুলের সুযোগ নিয়ে এই পথ দিয়ে বিধ্বস্ত কাফেরদের যুদ্ধের গতি পাল্টায়ে দেন। 

এই ভুলের কারণেই  কাফির ওতবা ইবনে আবু ওআক্কাস নবী করীম (সঃ) ‘এর প্রতি পাথর নিক্ষেপ করলে নবিজীর নীচের মাড়ির ডান দিকের দাঁত ভেঙ্গে যায়। নীচের ঠোঁট কেটে যায়। 

আবদুল্লা ইবনে শিহাব জুহরি নবী করীম (সঃ) ‘এর কপালে আঘাত করে। আবদুল্লা ইবন কোমায়া নবিজীর কাঁধে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করে।   ইবন কোমায়া তরবারি দিয়ে দ্বিতীয়বার আঘাত করলে নবিজীর ডান চোখের নীচে লেগে বর্মের কোড়া চেহারায় বিধে যায়। 

এত বড় বিপর্যয়ের মধ্যেও নবীজী (সঃ) বলেন,  “হে আল্লাহ্‌ আমার কওমকে ক্ষমা কর, কেননা ওরা জানে না।”  এর পরিপ্রেক্ষিতে সুরা আল ইমরানের এই আয়াত নাজিল হয়, “তিনি তাদের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন অথবা তাদেরকে শাস্তি দিবেন, এ বিষয়ে তোমার করণীয় কিছুই নেই, কারণ তারা জালেম।”

বিজয় অর্জিত হলেও আরও কিছু ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে আসে শুধুমাত্র তীরন্দাজরা সংযম রক্ষা করতে পারে নাই এই কারণে। 

সামান্য নফসের প্রলোভন কি ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে উপরের আলোচনা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 

এই শিক্ষা থেকে আমরা পবিত্র রমজানে “নিজেরা নিজেদের সাথে” ওয়াদাবদ্ধ হতে পারি যে আমরা শুধু “সংযম” ‘এর অনুশীলন করতে থাকব রমজান ও রমজান পরবর্তী মাস সমুহে। আগামী রমজানে আমরা তুলনা করব আমরা প্রত্যেকে এ বৎসরের চেয়ে সংযমে কতটা এগিয়ে আগামী বৎসরে যদি আল্লাহ্‌ আমাদেরকে আগামী রমজান পর্যন্ত হায়াতে তৈয়েবাহ দান করেন। 

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে সংযমের এই অনুশীলন করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।  

রমজান-4  

মাহে রমজানের রহমতের চতুর্থ দিন আজ।

সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াত সব চেয়ে বেশী আলচিত হয় রোজার আলোচনায়। আয়াতের শেষে অংশে আল্লাহ্‌ বলেন, 

”লা আল্লাকুম তাত্তাকুন” অর্থাৎ যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো। 

তাকওয়া অর্থ খোদাভীতি। বোঝানো হয়েছে খোদার নির্দেশিত পথ অবলম্বন করতে। যা কিছু আদেশ করা হয়েছে তা আনুপুংখ পালন করা ও যা নিষেধ করা হয়েছে তা থেকে বিরত থাকা। 

এক আল্লাহ্‌তে ঈমান আনলে আল্লাহ্‌র সমস্ত বিধানাবলি মেনে চলাই সেই ঈমানের সত্যতার শর্ত। আল্লাহ্‌র বিধান না মানলে শর্ত অনাম্য করা হয় এবং শুধু মৌখিক ঈমান থাকে যা অর্থহীন। 

আল্লাহ্‌ সিয়াম বা রোজা ফরজ করে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে এই রোজা পূর্ববর্তীদের উপরও ফরজ ছিল। এবং রোজা ফরজ করার উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। 

খোদা ভীতিতৈরি হলে ধীরে ধীরে তা খোদাপ্রীতিতে পরিণত হয়। প্রথমে ঈমানের শর্ত হিসেবে আল্লাহ্‌র বিধান পালনে বাধ্য হওয়া। পরবর্তীতে খোদার দেওয়া রহমত, নেয়ামত, ইজ্জতের  কারণে খোদার প্রতি এক গভীর প্রেমের জন্ম হয়। বান্দা তখন জান্নাতের লোভে ইবাদত করে না। ইবাদত করে জান্নাতের মালিকের লোভে। জান্নাতের মালিককে পাওয়ার লোভে। 

“খোদার প্রেমের সরাব পিয়ে বেহুশ হয়ে রই পড়ে হায়,

ছেড়ে মসজিদ আমার মুর্শিদ এল যে এই পথ ধরে।।

দুনিয়াদারীর শেষে আমার নামাজ  রোজার বদলাতে

চাই না বেহেশত খোদার কাছে নিত্য মোনাজার ক’রে।”

রমজান-৩        ০৫.০৪.২০২২

মাহে রমজানের রহমতের তৃতীয় দিন আজ। 

আমরা সুখ সম্পদ আর সাফল্যের  জন্য প্রতিনিয়ত কি না করছি!

এত এত আবিষ্কার, সুখ-সামগ্রী, বিলাস ব্যাসন, উদ্দীপনা উল্লাসে  জীবনপাত, তবুও দিনের শেষে কি যেন এক হাহাকার আচ্ছন্ন করে রাখে।মনে হয়,

”বাজিল ব্যাকুল বাণী নিখিলের প্রাণে, 

হেথা নয়,  হেথা নয়, আর কোনখানে।”

বা

ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে–

“হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে।” -র মতো আত্মা অস্থির থাকে। 

সেই “অন্য কথা” কোথায়? রবীন্দ্রনাথই আরেক যায়গায় আক্ষেপ করে লিখলেন,

“প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন,

তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে।”

সমস্থ পৃথিবীর সহায়-সম্পদের মালিক হয়েও মানুষের অন্তর হাহকার করে। এই অন্তরের শান্তি একমাত্র বিশ্বনিয়ন্তা আল্লাহ্‌র কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণের মধ্যে নিহিত। একবার সেই বিরাটের কাছে নিজেকে সঁপে দিলে আত্মায় যে শান্তি পাওয়া যায় সে শান্তি জগতের আর কোথাও পাওয়া যায় না। 

এজন্য জ্ঞানীরা সময় থাকতেই কল্পিত  সোনার হরিনের পিছে না ছুটে মহান স্রষ্টার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে নিজের কাজে মগ্ন হয়েছেন। তৃপ্তির সাথে ঘুমায়েছেন। ঘুমের ওষুধ লাগেনি। 

আমি অনেক সম্পদশালী, কোম্পানির মালিক, বড় সাহেবদেরকে দেখেছি যারা একটু ঘুমের জন্য কাঙাল। রুহ-আফজা বা ঘুমের ওষুধ ছাড়া ঘুমাতে পারেন না। 

আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরানের শুরুতেই সুরা বাকারা’তে ঘোষণা করেন,

“আল্লাজিনা ইউ মেনুনা বেল গায়বে, ও ইউ কি মুনাসসলাতা ও মেম্মারাজাকনা হুম ইউন ফেকুন।   ওল্লাজিনা ইউ মেনুনা বেমা উনজেলা ইলাইকা ওমা উনজিলা মেন কাবলেকা। অবেল আখেরাতে হুম ইউকেনুন। উলাইকা আলা হুদাম্মের রব্বেহিম, ও উলাইকা হুমুল মুফলেহুন।”

সফলদের সংজ্ঞা দিতে যেয়ে আল্লাহ্‌ প্রথমেই গায়েব বা অদৃশ্যে বিশ্বাস ও সালাতের পরই  তাদেরকে যে রিজিক দেওয়া হয়েছে তার থেকে খরচ করার কথা বলা হয়েছে।  মেম্মারাজাকনা হুম ইউন ফেকুন।

আল্লাহ্‌ ঘোষিত সংজ্ঞা অনুযায়ী “আল্লাহ্‌র দেওয়া রিজিক থেকে যারা দুস্থ, অভাবীদেরকে দান করে” তারাই সফলকামীদের অন্তর্ভুক্ত। 

নবী করীম (সঃ) বদরের যুদ্ধে বন্দীদের সাথে উত্তম আচরণের কথা বললে সাহাবীরা নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদেরকে নিজেদের রুটি খেতে দিতেন। (উল্লেখ্য, তৎকালীন ইয়াসরিব বা মদিনায় রুটি দামী খাবার ছিল।) 

নবী করীম (সঃ) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামগণ যে উত্তম আদর্শের নজির রেখে গেছেন আমরা তার থেকে যোজন যোজন দূরে সরে ইট কাঠ পাথরের মধ্যে আনন্দ-তৃপ্তি – সুখ -শান্তি -সাফল্য খুঁজে মরছি। কিন্তু দিন শেষে, 

“সে যে চমকে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায় 

যায় না তারে বাঁধা,

সে যে নাগাল পেলে পালায় ঠেলে 

লাগায় চোখে ধাঁ ধাঁ” ‘র মতো  দুনিয়ার পিছনে ছুটে ছুটে আমরা ক্লান্ত। আজো এমন কোন উপাচার নেই যা পেয়ে মানুষ বলেছে আমি সুখী বা এমন কোন মানুষ পাওয়া যাবে না যে বা যারা দুনিয়ার পিছনে ছুটে সফল হয়েছে। কিছু টাকা কড়ির মালিক হতে পেরেছে কিন্তু জীবনের যে পরিতৃপ্তি তা পায় নি (সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া)। 

জীবনে তৃপ্ত হতে গেলে, শান্তি পেতে গেলে, সফল হতে গেলে কোরানের পথে আসতে হবে। কোরান দুনিয়া ত্যাগের কথা বলে নি। বরং শিখিয়েছে ,” রব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা, ও ফিল আখিরাতে  হাসানা…।” আল্লাহ্‌ দোয়ায় প্রথমেই দুনিয়ার ভালো সব কিছু চাইবার জন্য শিখিয়েছেন এর পর পরকালের মঙ্গলের জন্য দোয়া করতে শিখিয়েছেন। 

সুতরাং সেই মহান আল্লাহ্‌ রব্বুল আলামিনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে, তাঁর দেওয়া বিধান মেনে দুনিয়া চাইলে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ই পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে সিরাতুল মুস্তাকিমে চলার তৌফিক এনায়েত করুন। আমাদের রিজিক থেকে আল্লাহ্‌র পথে খরচ করার মানসিকতা তৈরিতে মদদ দেন। আমীন। 

রমজান-২

গতকাল লিখেছিলাম রোজা শুধু দৈহিক না। মনোদৈহিক। সাইকো-সোমাটিক। দেহের রোজায় রোজা সম্পূর্ণ হয় না। নফসের রোজা রাখতে হবে। 

মোটা দাগে নফস তিন প্রকারেরঃ

১। নফসে আম্মারাঃ যে নফস সব সময় মানুষকে অন্যায় কাজে উৎসাহিত করে, কুপথে পরিচালিত করে।  দৈনন্দিন জীবনে দেখা সমস্ত ভোগের উপকরণ দেখে নফসে আম্মারা লালায়িত হয়ে পড়ে। কামনা বাসনার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়। সেই কামনার আগুনে ক্রমাগত ঘৃতাহুতি দিতে দিতে মানুষ পংকিলতার অতলে হারাতে বসে। 

রজনীকান্ত সেন আক্ষেপ করে লিখেছেন,

“এই পাপ চিত্ত সদা তাপ-লিপ্ত রহি’

এনেছে দুরপনেয় মৃত্যু বিকার বহি’

দেবতা গো, দয়া করি কর পরিত্রাণ।।” 

আল্লাহ্‌ রব্বুল আলামিন পবিত্র কোরানের সুরা শামসে ঘোষণা করেছেনঃ

‘নিঃসন্দেহে মানুষের মধ্যে সেই সফলকাম যে তাকে পরিশুদ্ধ করেছে। আর যে তাকে কলুষিত করেছে সে ব্যর্থ হয়েছে।’ -সূরা শামস: ৯-১০

২) নফসে লাউয়ামাহঃ অনুতপ্ত নফস। যে নফস কৃত অপরাধ, পাপের জন্য অনুতপ্ত, অনুশোচনায় দিশেহারা। পাপের প্রতি আকর্ষণ থাকলেও আতঙ্কে জাগ্রত হন, আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হয়ে তাওবা করেন। 

বিশাল আশার আলোকবর্তিকা নিয়ে হাজির হয় এই নফসে লাউয়ামাহ। আমরা যারা নফসের তাড়নায়, শয়তানের ওছওছায়, দুনিয়ার পাল্লায় পড়ে ভুল করে বসি তাদের অন্তরে যদি এই অনুতাপ কাজ করে তাহলে বুঝতে হবে দীপ নেভে নাই। এই আশার আলোটুকুই সবচেয়ে বড় সম্পদ। 

নবী করীম (সঃ) নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে “জেহাদে আকবর” বলেছেন। অস্ত্র নিয়ে শত্রুর সাথে যুদ্ধের মাঠে যুদ্ধ করাকে তিনি ছোট যুদ্ধ বলেছেন আর নফসের সাথের যুদ্ধকে “জেহাদে আকবর” বলেছেন।

আমার ফাইজারের জীবনে কিছুদিন নামাজ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। একদিন আমার এলমে তাসাউফের শিক্ষক মৌলানা ফরিদুদ্দিন আত্তার সাহেবের কাছে গেলাম তাঁর চামেলিবাগের বাসায়। আমার অন্তরের কথা খুলে বললাম। তিনি এমন একজন পজিটিভ মানুষ ছিলেন যে মৃদু হেসে বল্লেন, তোমার মধ্যে যে অনুতাপের প্রদীপ মিট মিট করে জ্বলছে ওটাই তোমাকে রক্ষা করবে। পরামর্শ দিলেন কিভাবে আবার নামাজে নিয়মিত হবো ও অন্যান্য তজবিহ ঠিক করব। হযরতের পরামর্শে আমি সেপথের দিশা খুঁজে পাই।  

সঠিক মেনটর পেলে এই নফস অনেক উঁচু স্তরে পৌঁছাতে পারে।

৩) নফসে মুতমায়েন্নাহঃ শুদ্ধ, প্রশান্ত আত্মা।  যে মুমিন বান্দা আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসূলের দেখানো পথে থেকে ইহকাল ও পরকালের মধ্যে সুন্দর সেতুবন্ধন করেছেন তাঁর আত্মা পরিচ্ছন্ন। তিনি সর্বাবস্থায় নির্বিকার। এই ধরনের আত্মাকে সম্বোধন করে আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরানে বলেন,  

“ইয়া আইয়াতুহান নাফসুল মুতমাইন্নাহ, ইরজিয়ি’ ইলা রব্বিকি রদিয়াতাম মারদিয়্যাহ, ফাদখুলি ফিল ই’বাদি ওয়াদখুলি ফিল জান্নাতি”।

হে প্রশান্ত আত্মা! তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। অতঃপর শামিল হয়ে যাও আমার (নেক) বান্দাদের মধ্যে এবং প্রবেশ করো আমার জান্নাতে৷

-আল কোরআন

এই রমজানে আল্লাহ্‌ আমাদেরকে নফসের সাথের যুদ্ধে বিজয়ী করুন। আমীন। 

ইনশাল্লাহ নফসের অন্যান্য শাখা নিয়ে আগামীতে লিখব। 

রমজান-১     ০৩.০৪.২০২২

রমজানুল মুবারক!

গত রমজান থেকে আল্লাহ্‌ সুবহনাল্লাহতায়ালা আমাদেরকে এই রমজান পর্যন্ত হায়াত দারাজ করেছেন এর জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে শুকরিয়া।

ডিজিটাল মিডিয়ার কল্যাণে আমরা রমজান সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারি। অনেক ভাই বোনেরা অনেক অনেক সুন্দর আল্লাহ্‌র কালাম, হাদিস ও আউলিয়ায়ে কেরামদের বাণী পোস্ট করেন সেখান থেকে আমরা জানতে ও শিখতে পারি।

সমস্যা হচ্ছে যত বেশী বেশী আনুষ্ঠানিকতা হচ্ছে, যত বেশী মসজিদ ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে, যত বেশী ওয়াজ ও বয়ান হচ্ছে, খুতবা হচ্ছ, যত বেশী শিক্ষিত হচ্ছি আমরা তত বেশী ধর্মীয় বিধান পালন থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। নীতি নৈতিকতা মূল্যবোধ থেকে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে।

সমাজে অন্যায় অনাচার বেড়েই চলছে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সাথে অপরাধ প্রবণতা যদি ‘লিনিয়ার’ হয় তাহলে তো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও শিক্ষা কম থাকাই ভালো!

আমার ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে সমস্যাটার মুলে রয়েছে খুশু খুজুর সাথে, তাওয়াক্কুলের সাথে আমল না করা। এলেম যার থাকে তাকে আলেম বলা যায়, যেমন জ্ঞান থাকে জ্ঞানী বলা যায়। কিন্তু সেই জ্ঞান যা বলে সেই অনুযায়ী আমল বা কর্ম না করলে ঐ জ্ঞানের কোন মুল্যই নেই বরং জ্ঞান থেকে সে অনুযায়ী নিজে আমল না করা ও অন্যকে আমল করতে উৎসাহী না করার অপরাধে কাল কেয়ামতের মাঠে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। 

বাঙালি মুসলমান হিসেবে আরবি ভাষা আমাদের জন্য একটা প্রতিবন্ধকতা এটা প্রকট সত্য। তবে ইহকালিন ও পরকালিন জীবন সুন্দর করার জন্য যে জ্ঞান অত্যাবশ্যকীয় সে জ্ঞান আহরণ না করা বোকামির লক্ষ্মণ। 

পেশা জীবনের জন্য আমরা এক্সেল, পাওয়ার পয়েন্ট, গ্রাফিক্স, আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, রোবটিক্স, আইওটি, ব্লকচেইন শেখার জন্য হন্যে হয়ে যাই কিন্তু দিনের শেষের শান্তি সফলতা ও ইহজীবনের শেষের অনন্ত জীবনের অন্তহীন শান্তির জন্য আমরা সে ভাষা, সে জ্ঞান অর্জন করতে বিমুখ অথচ পবিত্র কোরানের প্রথম শব্দ, প্রথম আয়াতেই ছিল জ্ঞান অর্জনের তাগিত।         “একরা বে এসমে রব্বেকাললাজি খালাক……”  পড়ো সেই প্রভুর নামে যে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন…। আমরা জানি কিন্তু পড়ি না। 

ফরজ ইবাদতগুলর মধ্যে নামায অন্যতম প্রধান ইবাদত। আমরা সেই নামাজের প্রতি তেমন যত্নবান না। নামাজের বেলায়ও স্পষ্ট ঘোষণা এসেছে, “ ইন্নাস সলাতা তানহা আনেল ফাহসায়ে অনেল মুনকার” নিশ্চয়ই নামায অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে দূরে রাখে। যখন অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে আমরা দূরে থাকছি না তাহলে দেখতে হবে কোন একটায় গণ্ডগোল আছে। হয় আমার মধ্যে না হয় নামাজে। অবশ্যই আল্লাহ্‌র ঘোষিত বিধান নামাজে সমস্যা না, সমস্যা আমার আমলে। নামায ঠিক হলে সব কিছু ঠিক হয়ে যেতো। 

আর একটা কথা, আমরা অনেকেই ভাবি এক দিকে ইবাদত ও অন্য দিকে অপরাধ করে গেলে ব্যাল্যান্স হয়ে যাবে। দুঃখিত, ব্যাপারটা তা না। অন্যায় জেনে সেই অন্যায় করে ইবাদতের দোহাইতে মাফ পাওয়ার কল্পনা করা আল্লাহ্‌র সাথে ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই না। 

আমরা সিয়াম বা রোজাতে ছিলাম। রোজা শুধু দৈহিক না। মনোদৈহিক। সাইকো-সোমাটিক। দেহের রোজায় রোজা সম্পূর্ণ হয় না। নফসের রোজা রাখতে হবে। নফসে আম্মারাকে  রোজার মাধ্যমে কব্জা করতে পারলে বা বশে আনতে পারার মধ্যেই বাহাদুরি। অন্যথায় অনর্থক উপবাস। 

আজ প্রথম রোজায় বিপদে পড়ে এক অফিসে গিয়েছিলাম একটা সমস্যা নিয়ে। সমস্ত কাগজ পত্র ১০০% ঠিক তারপরও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বাহানা শুরু করলেন। এটা লাগবে ওটা লাগবে। আমি অপলক নেত্রে তার চকচকে আমার চেয়ে লম্বা দাঁড়ির দিকে তাকায়ে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। আরও কি লাগবে তা লিখতে গেলে উনি নিজ হাতে লিখে স্পীডব্রেকার আমার হাতে ধরায়ে দিলেন। আমি বিনয়ের সাথে তার মোবাইল নাম্বার চাইলে তিনি নিখুত ভাবে লিখে দিলেন। আমি তার এসেম মবারক (নাম) জানতে চাইলে তিনি  তাও লিখে দিলেন। এবার তার এজাজত চাইলাম আমি কখন তাকে কল করতে পারি। উনি সুগন্ধিযুক্ত হাসি দিয়ে বল্লেন, ইফতারের পর। (সেই অফিসের একজন বড় সাহেব আমার স্নেহের। তাকে না বলে আমি নিজেই গিয়েছিলাম। এবার তাকে বলা ছাড়া পথ দেখছি না।) 

যে আমি সারা জীবন হাজার হাজার মানুষকে সেবা দিয়ে এসেছি, উপার্জনের আগে খেয়াল করেছি এ টাকা হালাল কি না, সেই আমি আজ প্রথম রোজায় আমার সন্তানের বয়সী শ্মশ্রুমণ্ডিত ব্যক্তির অফিস থেকে ইশারা নিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এলাম,  যার বা যাদের বেতন আমাদের টাকায় হয়। 

এমন সালাত, সিয়াম বা নামাজ রোজা  হলে তো নামাজ কথা রাখবে না, রোজা ওয়াদা পালন করতে বাধ্য না। 

নবিজীর মাদানি জীবনের একটা উদাহরণ দিয়ে আজ শেষ করবোঃ 

মোহাজেররা মদিনায় এলে নবীজী (সঃ) হযরত আব্দুর রহমান ইবন আওফ (রাঃ) ও হযরত সাআদ ইবন রবি’র মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক গড়ে দেন। হযরত সাআদ আব্দুর রহমান (রাঃ)-কে বল্লেন, ”আনসারদের মধ্যে আমি সবচেয়ে ধনী। আপনি আমার সম্পদের অর্ধেক গ্রহণ করুন। আমার দুই জন স্ত্রী আছেন। আপনি তাদেরকে দেখুন। আপনার যাকে পছন্দ হয় আমাকে বলুন আমি তাকে তালাক দেব এবং আপনি তাকে বিবাহ করবেন।” 

একদিন তার গায়ে হলুদের চিহ্ন দেখে নবীজী জানতে চাইলে আব্দুর রহমান (রাঃ) বল্লেন, হে আল্লাহ্‌র রসূল আমি বিবাহ করেছি। নবীজী শুনেই প্রথম প্রশ্ন করলেন, মোহরানা কত দিয়েছ? 

এমন ছিল রসূলের (সঃ) জামানার মুসলমানের নবীর (সঃ)প্রতি আনুগত্য, আন্তরিকতা ও ত্যাগের নমুনা। 

আজ আমরা মসজিদের শহরে বাস করে যে পঙ্কিলতায় ধীরে ধীরে ডুবছি তার শেষ কোথায়? 

ইবাদতের অন্তর্নিহিত অর্থ ও দর্শন উপলব্ধি করে যদি আমরা আমাদের দৈনন্দিন ইবাদত করি ও পারিবারিক, সামাজিক জীবনে তার প্রতিফলন ঘটাই তাহলে সেই ইবাদত আমাদের ইহ ও পারলৌকিক জীবনের সুখ, শান্তি ও সফলতার চাবিকাঠি হয়ে উঠবে।       

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *