সংগীতের সুরের গতিকে আমরা ‘লয়’ বলি। এই গতিকে শাসন করার জন্য তাল যন্ত্র ব্যবহার করা হয়।
সাধারণত তবলা, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ, ঢোল, খোল, নাগারা (হিন্দু পূরণে বর্ণিত ধুন্ধব, ভেরী), মাদল (নেপালে বেশি প্রচলিত), ধাপ,ছেন্দা (কর্ণাটকি ঘরানার বাদ্য) ডমরু,ঘটম (দক্ষিণ ভারতীয়) ইত্যাদি তাল যন্ত্র সহযোগে কণ্ঠ বা যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করা হয়।

উপমহাদেশীয় শাস্ত্রীয় সংগীত সাধারণত ৩টি লয়ে পরিবেশন করা হয়। বিলম্বিত, মধ্যলয় ও দ্রুত লয়।
রাগের পরিবেশনের সময় নির্বাচন করে রাগের রূপটা ফুটায়ে তোলার জন্য, রাগের কল্পিত মূর্ত রূপ আনার জন্য ধীরে ধীরে ওই রাগের স্বর গুলো আলাপ, বিস্তার করা হয়। ধীরে ধীরে রাগের ভাব ফুটে ওঠে।

ভৈরব রাগ যেমন প্রদোষের আবহ সৃষ্টি করে, তেমনি আসাবরী, টোরি,পুরিয়া ধানেশ্রী সকালের, বৃন্দাবনী সারঙ্গ, ভীমপলশ্রী,পিলু, মুলতানি দুপুরের, পূরবী, মারোয়া দিন শেষের, ভূপালী, ইমন, হাম্বীর, কেদার সন্ধ্যা রাতের, কাফি,খাম্বাজ,বেহাগ,দেশ, তিলককামোদ, বাগেশ্রী, মালকোষ, দূর্গা, দরবারী কানাড়া মধ্য রাতের, কালিঙ্গরা, যোগীয়া শেষ রাত্রের আবেগ-আবহ-আবেশ তৈরী করে।

বিশ্বের মধ্যে আমাদের উপমহাদেশের মার্গীয় সংগীতের বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য এই যে তা সময় অতিক্রান্তের সাথে সাথে মানুষের মনের ভাবাবেগের উপর এক প্রগাঢ় প্রভাব বিস্তার করে। এই জন্যে কোনো কোনো সংগীত মনকে প্রশান্ত করে,আনন্দিত করে, উল্লসিত করে,উদ্বেলিত করে, দুঃখভারাক্রান্ত করে।

তাই ‘বৈজু বাওরা’ সিনেমায় রাগ দরবারী কানাডার ছায়ায় মোহাম্মদ রাফির কণ্ঠে ” ও দুনিয়া কে রাখে ওয়ালে। …” শুনে উদাসী মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে অন্য ভুবনে চলে যায়।

রাগ পরিবেশনের প্রথম ধাপে আলাপ করে রাগের স্বরূপ মূর্ত করে বিলম্বিত তালে বন্দিশ শুরু হয়। এর পর একটু একটু বিস্তার করে বন্দিশকে কাঙ্খিত অনুভূতির জারক রসে সিক্ত করে তান পরিবেশন করা হয়। এরপর লয় পরিবর্তন করে মধ্যে লয়ে বন্দিশ বিস্তার ও তান পরিবেশন করা হয়।

শেষে আসে সেই চরম প্রতীক্ষিত মুহূর্ত। কৃন্তন,গিটকিরি,জমজমা,গমকের কারুকার্যের পর দ্রুত লয়ে ‘তারানা’য় বন্দিশ, তানের পরে ঝালা দিয়ে শেষের দিকে পা বাড়ায় রাগটি।

তখন শুধু ত্রিতালে ধা ধী ধী না, ধা ধী ধী না, না তি তি না, টেতে ধিন ধী না, তালের সঙ্গতের সাথে তবলার সাথে চলে সওয়াল-জবাব। শেষ হয় সব আয়োজনের। স্তব্ধতা নেমে আসে চারিদিকে। তাই বিলম্বিত ও মধ্য লয় আঁকড়ে থাকার অনুশীলন দরকার। রাগের ওই স্বর বিস্তার মীড়ে মীড়ে যে আবেশ-অনুরণন তোলে অন্তরের নিভৃত কন্দরে তা উপভোগ করার মন তৈরী করা প্রয়োজন।

উচ্চাঙ্গ সংগীতের মৌলিক ধারণা না থাকার জন্য আমরা অনেকেই রাত এগারোটার পর BTV’র সুইচ অফ করে দিতাম। কারণ অস্থির দ্রুততার সাথে অভ্যাস্ত জীবনে এতো সময় কৈ আলাপ-বিস্তার শোনার? এ জন্যই আমরা দ্রুত তালের বা বিটের গান শুনেই অবসর কাটিয়েছি কারণ ‘দাঁড়াবার সময়তো নাই।’

সংগীতের এই আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত লয়ের প্রতি অশোভন আকর্ষণ। জগৎ-সংসারেও আমরা দ্রুত লয়ে আনন্দ-সুখ-প্রতিষ্ঠা পেতে উঠে পড়ে লেগেছিলাম। করোনা ভাইরাস-এর মতো অদৃশ্য জীবাণু ঝাকুনি দিয়ে আমাদেরকে সম্বিৎ ফেরাতে শুরু করেছে।

এবার ধীরে-প্রশান্ত মনে আলাপের মধ্য দিয়ে আমরা বিলম্বিত ও মধ্য লয়ের মধ্যে আমাদের জীবনাচারকে তালচক্রে আটকে ফেলি। দ্রুত লয়ের ধা ধী ধী না, ধা ধী ধী না তো দেখলাম, কোনো প্রশান্তি আসে নাই। বরং বহু জীবনের মূল্য দিয়ে এই শিক্ষাই পেলাম যে “অস্থিরতার দেনা শোধ করতে প্রাণও সমর্পণ করতে হয় অনিচ্ছা সত্ত্বেও।”

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *