করনাক্রান্ত করোটি কোটি ভাবনার ধুম্রজালে আচ্ছন্ন ।
চাকরী, ব্যাবসা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ নৈমিত্তিক হাজারো অনুসঙ্গে অনিশ্চিতের করাল থাবা যখন আমাদেরকে ম্রিয়মাণ করে রেখেছে অহর্নিশি, তখন প্রতিদিনের সংক্ৰমণ আর মৃত্যুর সংবাদ উদ্বেগকে আরও উসকে দিচ্ছে ।

সম্পন্ন ও ক্ষমতাশালীদের অসহায় মৃত্যু আমাদের অস্তিত্বের স্তম্ভ ধরে প্রবলবেগে ঝাকুনি দিচ্ছে । এক আহত শঙ্কা “সংক্রমণ ও মৃত্যু আমার থেকে কতো দূরে ?” কুরে কুরে খাচ্ছে পলে অণুপলে।

মহামারীর এই মুহূর্তে বেঁচে থাকাটাই সবার আরাধ্য । উন্নতি, প্রগতি, সফল হওয়া বা বিজয় অর্জন না । অর্জন আর সফলতার সাথে যত তুলনা করব তত হতাশা আঁকড়ে ধরবে । এখন সময় প্রথমে নিভৃতে বসে মনস্থির করা যে এটা অস্বাভাবিক সময়, এখন আগের প্রত্যাহিকতার মতো কিছুই চলবে না । মনকে তৈরি করতে বিফল হলে উৎকণ্ঠা বাড়বে যা শেষ পর্যন্ত দেহ মনকে বিপর্যস্ত করে ফেলবে । এই দশা কেটে গেলে আমারা সবাই জেগে উঠবো পূর্ণমাত্রায় জীবন জীবিকার সন্ধানে। তখন দরকার হবে শক্তি, উদ্যম, সাহস, অনুপ্রেরণা । ‘সঙ্কটের বিহবলতা’ যদি এখন আমাদেরকে দুর্বল করে দেয় তাহলে করোনা- পরবর্তী যজ্ঞে আমাদের উপস্থিতি ও অর্জন হবে ম্লাণ , অনুল্লেখ্য ।

দুশ্চিন্তা করলে শরীর দ্রুতই রোগ ও ক্ষয়ের দিকে, জরা জীর্ণতার অভিমুখে ধাবিত হয় । পক্ষান্তরে শুভ ও সুন্দর চিন্তা জীবনকে সতেজ ও প্রফুল্ল রাখে । প্রয়োজনের সময়ের জন্য প্রস্তূত রাখে । যেহেতু এ সঙ্কটকাল আমার তৈরি না এবং এর প্রতিরোধে আমি অসহায় সেহেতু নির্বিকার থাকার চেষ্টা করাই উত্তম,যদিও নির্বিকার থাকা কঠিন সাধনার। চিন্তার পরিবর্তন না করে খাদ্যাভ্যাস উন্নত করলেও তা শরীরের কোনও উপকারে আসবে না । স্বামী বিবেকানন্দ সঙ্কট কালকে সম্বোধন করে বলেছিলেন, “when danger is inevitable, it is better give up something for noble cause” . এর বেশী কিছুই করার নাই আমাদের ।

আমাদের প্রতিটা চিন্তা একটা ‘কারণ’ এবং প্রতিটা অবস্থা একটা ‘কার্য্য ’। কার্য্য -কারনের এই সমীকরণে দেখা যায় আমাদের খারাপ শারীরিক অবস্থার পিছনে একটা কারণ থাকে আর তা হল ‘উদ্বেগ- উৎকণ্ঠা- দুশ্চিন্তা।‘

যদি আমরা ভীত বা রাগান্বিত হই তাহলে আমাদের ব্রেনের হাইপোথ্যালামাস দেহকে সেই ভাবে প্রস্তূত করতে থাকে । হৃদপিণ্ড মাংসপেশীতে রক্ত সরবরাহ করার জন্য নিজের কাজের গতি বাড়ায়ে দেয় । রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা বাড়াতে আমরা নিঃশ্বাস দ্রুত নিতে শুরু করি । সতর্কতার প্রস্তূতি হিশেবে অতিরিক্ত হরমোন নিঃসরণ হতে থাকে । আবেগ উৎকণ্ঠা শরীর বৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম । ফলশ্রূতিতে মনোদৈহিক বৈকল্য ।

আমাদের দৈনন্দিন কাজগুলোকে দুইভাগে ভাগ করা হয় : ১) Controllable যা নিজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ২) Uncontrollable যা নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে । আমি রাস্তা দিয়ে সাবধানে হাটতে পারি। সন্তর্পণে ফুটপাথ দিয়ে চলতে পারি এটা আমার নিয়ন্ত্রণে কিন্ত তা সত্ত্বেও যদি কোনও ড্রাইভার আমার গায়ের উপর দিয়ে গাড়ি উঠায়ে দেয় সেটা কিন্ত আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ।

যেখানে আমাদের নিয়ন্ত্রণ আছে যেখানে আমরা সতর্ক হতে পারি, সচেতন হতে পারি এবং আমাদের কাজের মানকে উন্নত করার চিন্তা করতে পারি। কিন্ত যার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নাই সেখানে সচেতন, সতর্ক হয়েও কোন লাভ নেই । আমাদের করণীয় কাজের মানোন্নয়নেরও কিছু নেই । সেখানে বাস্তবতাকে সহজে মেনে নিয়ে নিজের মতো করে সামনে এগুনো বুদ্ধিমানের কাজ । আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরের ঘটনায় উদ্ভুত সংকটে পরিস্থিতির বিবেচনায় সাধ্যের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে ।

এই বাটখারায় যদি ‘করোনা’কে মাপি তাহলে দেখব যে করোনার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নাই । যার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে, অস্থির হয়ে কোনও লাভ নেই বরং ক্ষতি আছে । দুশ্চিন্তা করে শরীর ও মন দুর্বল করে ফেল্লে করোনা পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ করা সম্ভব হবে না । এখন সময় শক্তি সঞ্চয় করার । শক্তির অপচয়ের সময় এটা না । এখন প্রয়োজন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া ।

আগেই আলোচনা করেছি যে এখন সফল হওয়া বা উন্নতি করার সময় না । এখন বেঁচে থাকার সময় । আমরা দেখব যে হাতের কাছে যে রসদ বা সম্পদ আছে তা দিয়ে কতো সুন্দর ভাবে বর্তমান সময়টা পার করা যায় ।

আমরা যদি আমাদের কাছে যে যে সম্পদ ও নেয়ামত রয়েছে তার যদি হিসাব নেই তাহলে দেখব যে আমরা অনেক অনেক সম্পদে সম্পদশালী । আমাদের শরীর এখনো সুস্থ, আমাদের অনেকের পরিবার পরিজনেরা এখনো সুস্থ । আমরা এখনো তিন বেলা পেট পূরে খেতে পারছি । আমাদের ঘরে টেলিভিশন আছে, আমরা নিয়মিত দুনিয়ার সব খবর পাচ্ছি । আমাদের হাতে মোবাইল ফোন আছে, আমরা সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে পারছি । মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট আছে, আমরা দুনিয়াকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরছি । পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের সেবা এখনো সঠিকভাবে পেয়ে যাচ্ছি ।ব্যাঙ্ক ও বাজার এখনো দুয়ার বন্ধ করেনি।

হোম কয়ারেনটাইনের কারণে অ্যালার্ম ছাড়া সকালে ঘুম থেকে উঠছি । দীর্ঘদিন ধরে যে দেহ ঘড়ির ছন্দ পতন হয়েছিল তা আবার সংশোধন হচ্ছে । সারকার্ডিয়ান সাইকেল ঠিক হচ্ছে আবার । অগণিত পাখির কল-কাকলী শুনে ঘুম ভাঙ্গে।নগর সভ্যতার নির্যাতনে নির্বাসনে যাওয়া সবুজ আবার ফিরে এসেছে। সকালের সোনার রোদ চারিদিক উদ্ভাসিত করে মন প্রাণ উজ্জ্বল করে তুলে । আমরা প্রান খুলে গেয়ে উঠতে পারি রবীন্দ্রনাথ থেকে:

“আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরবো গানে ।
সুরের আবীর হানব হাওয়ায়, নাচের আবীর হাওয়ায় হানে।” (চলবে)

(লেখাটা একটা বিশেষ শ্রেণীর পাঠককে উদ্দেশ্য করে লেখা। সবাই আলোচ্য বিষয়ের আওতাধীন নাও আসতে পারেন ।)

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *