আমার প্রিয় জিনিস কোরবানি করতে যেয়ে আল্লাহর প্রিয় জিনিসকে যেন কোরবানি দিতে উদ্যত না হই!
‘কোরবান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ “উৎসর্গ”। আল্লাহর আদেশে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবান করতে উদ্যত হলে আল্লাহর কুদরতে ইসমাইলের পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয় এবং এর পর থেকে এই প্রথা ইসলামেও অঙ্গীভূত হয় । বিস্তারিত বিবরণ সবার জানা ।
আমাদের ভূখণ্ডে কোরবানির ক্ষেত্রে, বিশেষ করে গরু কোরবানির ক্ষেত্রে, আদিতে কিছু জটিলতা ছিল । কোরবানির পশু হিসেবে গরু সহজলভ্য, অন্যদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে গরু ধর্মীয় দিক দিয়ে পবিত্র তাই স্পর্শকাতর। পশু কোরবানি করতে যেয়ে ধর্মীয় উন্মাদনায় এক সময়ে মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে তরবারি। মানুষ কোরবানি হয়ে গেছে। সে অন্ধ সময় আমরা পার হয়ে এসেছি ।
কিছু সমাজ সংস্কারক চেষ্টা করেন মতানৈক্য দূর করে সমাজে শান্তি ও সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখতে । আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনক স্যার সৈয়দ আহমেদ এই লক্ষ্যে এক সময় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে গরু কোরবানি নিষেধ করেছিলেন । আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ‘হেকমতের’ সাথে দ্বীনের প্রচারের আদেশ দিয়েছেন। এই ‘হেকমত’ অর্জন অনেক কঠিন এবং তা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত চুপ থাকা উত্তম। আল্লাহ্ কোরআনে ঘোষণা করেনঃ
উদ উ ইলা সাবিলে রব্বিকা বেল হেকমাতে অল মাওয়েজাতেল হাসানাতে ও জাদেল হুম বেল্লাতি হেয়া আহ্সানু।
“আপন পালনকর্তার পথের প্রতি আহ্বান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন পছন্দযুক্ত পন্থায়।“ সূরা : নাহল, আয়াত -১২৫
এখানে ‘বেল হেকমাতে’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ । পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে কথা বলা উত্তম। ভালো কথা বলতে জানা কোনও কৃতিত্ব না, কৃতিত্ব পরবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে উত্তম কথা বলা যা উদ্দিষ্ট ফল বয়ে আনে । আজকাল যে উদ্ভটভাবে, উৎকটভাবে ধর্মীয় আলোচনা করেন কেউ কেউ যা শুনলে পিছনের মানুষও ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী ।
আজ থেকে ১৩২ বৎসর আগে, ১২৯৫ সালের এই শ্রাবণের ১লা তারিখে টাঙ্গাইলের ‘আহমোদী’ পত্রিকায় ‘বিষাদ সিন্ধু’ খ্যাত লেখক মীর মোশাররফ হোসেন “গকুল নির্মূল আশঙ্কা” নামে একটা প্রবন্ধ লেখেন। তিনি ছিলেন উদারপন্থী এবং হিন্দু- মুসলিম সম্পর্ক সমন্বয়কারী । সমাজের শান্তি শৃঙ্খলার জন্য তিনি একটু ‘হেকমতের’ সাথে নরম পথে হেঁটেছিলেন । পরিস্থিতি এমন ঘোলাটে হয়ে ওঠে যে ভাদ্রের ২ তারিখে এই অপরাধে মীর মোশাররফকে ‘কাফের’ ও ‘স্ত্রী হারাম’ এই ফতোয়া দেওয়া হয় । টাঙ্গাইলের মুন্সেফ কোর্টে মানহানির মামলা পর্যন্ত গড়ায় । লম্বা ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে সমঝোতার মাধ্যমে ।
উপরের প্রসঙ্গটা এনেছি এ কারণে যে সেই কোরবানি এখন নির্ঝঞ্ঝাটে আনন্দ মুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয় । কোরবানি ধর্মীয় অনুষঙ্গ পেরিয়ে সমাজের এক অপরিহার্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে । নিজের বাইরে হকদাররাও, আত্মীয় ও দরিদ্র মানুষ উন্মূখ হয়ে চেয়ে থাকে কখন কোরবানির গোস্ত পাওয়া যাবে । সেই অনাড়ম্বর কোরবানি আজ আড়ম্বর ও জাঁকজমক পূর্ণ, লোক দেখানোর প্রতিযোগীতায় পরিণত হয়েছে ।
এবারের কোরবানি এক বিশেষ ব্যাতিক্রম নিয়ে হাজির হয়েছে । করোনার কারণে সার্বিক ভাবে বিপর্যস্ত সমগ্র পৃথিবী। অনেকের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হয়েছে । যারা গত বৎসর কোরবানি দিয়েছিলেন, গোস্ত বণ্টন করেছিলেন আজ তাঁরা কোরবানি দিতে পারছেন না। আজ তাদের ছোট ছোট বাচ্চারা কোরবানি দেখতে পারবে না। তাঁরা কোরবানির গোস্ত বিলাতে ও খেতে পারবে না । খাওয়ার জন্য না, হঠাৎ করে,অপ্রত্যাশিতভাবে সামর্থহীন হওয়ার দীর্ঘশ্বাস ও অসহায়ত্বে গ্রাস করা এক বোবা কাঁন্না তাদেরকে তাড়িয়ে ফিরবে ।
আমাদের দেশ এখন গরু সরবরাহে স্বয়ংসম্পূর্ণ । বাইরে থেকে আমদানি করতে হয় না । আমাদের দেশের খামারিরা, বেকার যুবকেরা উদ্যোগ নিয়ে এই শিল্পটাকে গড়ে তুলেছে । হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে, বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা দীর্ঘ এক বৎসর অপেক্ষায় ছিল এই কোরবানির গরুর হাটের জন্য । তাদের সারা বৎসরের বিনিয়োগ থেকে উপার্জন আসবে এই আশায় । কিন্ত এবার বড়ো একটা অংশের কোরবানি না হওয়ার আশঙ্কায় গরুর হাটে ধ্বস নেমেছে । খামারিদের, বেপারীদের দীর্ঘশ্বাসে হাট বাজারের বাতাস ভারি হয়ে উঠছে। আজ তাঁরা বিপদ্গ্রস্থ । অর্থনীতির ডিম্যান্ড অ্যান্ড সাপ্পলাই অনুযায়ী দাম কমে যাওয়া ঠিক আছে। কিন্ত কি পরিস্থিতিতে এটা ঘটেছে , কি উদ্দেশ্যে গরুগুলো কেনা হবে তা যদি বিবেচনা করি তাহলে অর্থনীতির ওই ধ্রুপদী সংজ্ঞা ধোপে টিকবে না ।
মানুষগুলোর সারা বৎসরের অমানুষিক পরিশ্রম, অর্থ বিনিয়োগ সব কিছু ভেস্তে যেতে বসেছে । এর ফল হিসেবে যদি এই মানুষগুলো বিপদে পড়ে বা কোনও ভুল হয়ে যায় তাঁর জন্যে তো আমরাই কিছুটা হলেও দায়ী থাকব । আমাদের পশু কোরবানি করার জন্য যারা সারা বৎসর উদয়স্ত পরিশ্রম করে সব কিছুর আঞ্জাম দিচ্ছে তাদেরে কাঁদায়ে কোন প্রভুকে হাসাচ্ছি আমরা? বার্গেইন বা দরদাম করা ঠিক আছে কিন্ত তা যেন এমন পর্যায়ে না যায় যেখানে বিক্রেতার অসহায়ত্বের বিনিময়ে কোরবানির পশু কেনা হয়। দীর্ঘ দিনের পালিত প্রিয় পশুর গলার দড়ি ও চোখের পানি যদি একসাথে ছেড়ে দেয় তাহলে ওই পশুর সাথে নিভৃত চরণে ভিরু পায়ে আশা দীর্ঘশ্বাস কি কোরবানির পূর্ণতা দিতে পারবে?
মানচিত্রের অন্য অংশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা তো ধর্মীয় উৎসবের সময় একে অন্যকে সাহায্য করে । পাশে দাঁড়ায় । আমরা এমন কেন ? আমাদের উন্নত আদর্শগুলো বাক্সবন্দী করে আমরা যুগ যুগ ধরে ইট পাথরের ইমারতে যেয়ে স্রষ্টাকে খুঁজি, তাঁর কাছে মাফ চাই । কিন্ত যে অসহায় মানুষের উপর জুলুম করলাম তাঁর কাছে মাফ চাই না ! এই খামারিরা, কৃষকেরা, নতুন উদ্দ্যোক্তারা যদি দাঁড়াতে না পারে তাহলে সামনের বৎসর কারা সরবরাহ করবে কোরবানির পশু?
কোরবানি করতে না পারার দলে এবার আরও অনেক মানুষ যোগ হয়েছে । করোনার সাথে ভয়াবহ বন্যায় দেশের এক বিশাল এলাকা জলমগ্ন। মানুষের জীবন বিপর্যস্ত, বিপন্ন। এমন অবস্থায় যারা সামর্থ্যবান তাঁরা কোরবানি করবেন অবশ্যই । কিন্ত খেয়াল রাখতে হবে এই সমাজের বিশাল এক জনগোষ্ঠীর চরম দুর্দিনে কোরবানি যেন কোনভাবে কারো উপর প্রত্যাক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জুলুম হয়ে না যায়। মানুষের দীর্ঘশ্বাস যেন না উথলে ওঠে। মাস্ক দিয়ে করোনা ঠেকানো যাবে কিন্ত দীর্ঘশ্বাস ঠেকানোর মাস্ক আজো অব্দি আবিষ্কার হয় নাই ।
আমাদের ধর্মের বিধান এমন যে যদি দিতে না পারো তাহলে সুস্বাদু তরকারীর সুঘ্রাণ যেন প্রতিবেশীর নাকে না যায় । অন্যথায় প্রয়োজনে ঝোলের পানি একটু বেশী দিও যাতে প্রতিবেশী বা জাঞ্ছাকারিকে একটু দিতে পারো ।
যে প্রতিবেশীর সাথে বিগত কোরবানিতে গোস্ত আদান প্রদান হয় নাই এবারে অর্থনৈতিক কারণে কোরবানি করতে না পারা সেই টনটনে আত্ম মর্যাদা সম্পন্ন প্রতিবেশীকে যদি খুশী মনেও গোস্ত দিতে যাই সেই আপাত সুন্দর সামাজিক সদাচার মানুষটাকে মানসিক ভাবে আহত করতে পারে । সবার জন্য না হলেও কারো কারো জন্য এই সতর্কতা অতীব প্রয়োজনীয় ।
আমার খোশ নসীবের কারণে আহ্লাদিত হয়ে অগণিত বদনসীবকে উপেক্ষা করা ইসলাম শেখায় নাই । কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়ঃ
“কারো আঁখি-জলে কারো ঝাড়ে কিরে জ্বলিবে দীপ?
দুজনার হবে বুলন্দ-নসিব, লাখে লাখে হবে বদনসিব?
এ নহে বিধান ইসলামের ।“
নিজেদের দরিদ্র আত্মীয়, সমাজের পিছে পড়া মানুষেরা, কোরবানির পশু সরবরাহ করা অগণিত কৃষক -খামারি-বেপারি-নতুন উদ্যোগতা , করোনার কারণে আর্থ-সামাজিক ভাবে আপাত স্থান চ্যুত হওয়া মধ্যবিত্ত এবং সর্বশেষে অথৈ বন্যার কারণে অসহায় অগণিত মানুষের অবচেতনের কথা মাথায় নিয়ে যদি আমরা কোরবানি করি তাহলে আল্লাহ্ মনে হয় অনেক বেশী সন্তষ্ট হবে।
নিজের প্রিয় বস্ত আল্লাহর নামে কোরবানি করতে যেয়ে যদি কোন মানুষের মনে আঘাত লাগে তবে ‘সে আঘাত লাগে কাবার গায়’ । বাবা মায়ের কাছে সন্তান যতটা প্রিয়, আল্লাহর কাছে তাঁর বান্দা তাঁর চেয়েও বেশী প্রিয় । আমার প্রিয় জিনিস কোরবানি করতে যেয়ে আল্লাহর প্রিয় জিনিসকে যেন কোরবানি দিতে উদ্যত না হই!
0 Comments