আজকাল আমরা অনেক ক্যারিয়ার সচেতন। ক্যারিয়ার গড়ার জন্য অনেক কিছুই করি। কিন্তু যে সাধনা দরকার ছিল সেই সাধনাই করি না। পড়ন্ত বেলায় এসে দোষ দেই ভাগ্যের, বসের, কোম্পানির কালচারের বা খোদ মালিকের।
মানুষ রচিত সব চেয়ে বড় মহাকাব্য বা গ্রন্থ টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথ, গ্যেটে, হোমার, শেক্সপিয়র, মিলটন, বায়রন, কালিদাস, বা জালাউদ্দিন রুমী’র না।
তোমার! তোমার জীবনের মহাকাব্য!!
মহাকালের স্রোতে গা ভাসায়ে অনেক দূরে যাওয়া যাবে তবে তা উজানে না, ভাঁটিতে। বিপর্যয় বা ধ্বংসের মোহনায়। মহাকালের স্রোতে ভেসে ভাঙ্গা গড়ার মধ্য দিয়ে প্রতিদিন নিজেকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে হয়। কালে কালে ম্যাশলোর নিড হায়ারারকি’র চূড়ায় পৌঁছে পরিমাপ করা যায় কি হতে চেয়েছিলাম আর কি হতে পেরেছি।
জীবনকে প্রতিনিয়ত এডিট করো, সংশোধন করো, পরিবর্তন করো, পরিমার্জন কর। নির্দয়ভাবে কাটাকুটি করো। সেই পরিবর্তিত নতুন জীবন হবে তোমার সর্বোত্তম মাস্টারপিস।
টলস্টয়ের অমর সৃষ্টি “ওয়ার এন্ড পিস” লিখতে ৬ বৎসর সময় লেগেছিল। এই লেখা শেষের নেশা টলস্টয়ের শরীর ও মনকে প্রচণ্ডভাবে ভেঙ্গে দেয়। শুরুর দৃশ্য লিখতে এক বৎসর লেগেছিল এবং ১৫ টা ড্রাফ্ট করতে হয়েছিলো। তথ্য উপাদান সংগ্রহের জন্য ১৩ বৎসরের গবেষণা প্রয়োজন হয়েছিলো। সর্বমোট ২১ বার হাতে লিখে কেটে আবার লিখে এক বিস্ময়কর সাহিত্য তৈরি হয়। ৬ ভল্যুমকে কেটে ছেঁটে ৪ ভল্যুমের সীমানায় নিয়ে আসেন।
২০১৫ সালে রেডিওতে ৬০ ঘণ্টার “ওয়ার এন্ড পিস” পাঠের আয়োজন করা হয় যেখানে ওয়াশিংটন, প্যারিস, বেইজিং, নেপাল সহ পৃথিবীর বিভিন্ন যায়গা থেকে পাঠকেরা ৩ মিনিট করে পাঠ করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাশূন্য বা ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশান থেকে সেরগেই ভলকভ নামে একজনও এই পাঠে অংশগ্রহণ করেন।
তখনকার দিনে রাশিয়ার শ্রমিকের দৈনিক মুজুরি ছিল ১০ রুবল। টলস্টয় “ওয়ার এন্ড পিস”’এর প্রতিটা ছাপানো পাতার জন্য ৩০০ রুবল সন্মানি দাবী করেছিলেন। প্রকাশক মিখাইল কাটকভ দিতে চেয়েছিলেন ৫০ রুবল। টলস্টয় রাজী না হওয়ায় প্রকাশক ৩০০ রুবল করে দিতে বাধ্য হন। প্রথম কিস্তির প্রথম ১০ পাতার জন্য টলস্টয় পান ৩০০০ রুবল যা তৎকালীন একজন রাশিয়ান শ্রমিকের প্রায় এক বৎসরের খাটুনীর মুজুরির সমান।
উল্লেখ্য, ওই একই সময় একই পত্রিকায় ফিওদর দস্তয়ভস্কির আর এক অমর সৃষ্টি “ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট” প্রকাশিত হচ্ছিলো।
“গন উইথ দা উইন্ড” লিখতে মারগারেট মিশেলের ১০ বৎসর লেগেছিল। “দা লর্ড অফ দা রিংস” লিখতে জে আর আর টলকিনের ১৮ বৎসর লেগেছিল। “জুরাসিক পার্ক” লিখতে প্রস্তুতির ৫ ও শেষ করতে ৮ সর্বমোট ১৩ বৎসর লেগেছিল!
আমরা কতটুকু সময় ও শ্রম দিয়ে থাকি জীবনের স্বপ্নের যায়গায় পৌঁছাতে? মান্না দে’র সেই বিখ্যাত গান,“পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কি করে এখানে তুমি আসবে?” সেই মান্না দে এক আলাপচারিতায় অজয় চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, একটা গান ২০০ বার গাইলে তবেই না তা পরিবেশনের উপযুক্ত হয়। আর আমরা একটু সারগাম শিখেই রাগ মালকোষ গাইতে দুঃসাহস দেখাই!
প্রফেশনাল নলেজ, ব্যাক্তিত্ত, সফট স্কিলগুলো সহ পেশাজীবনে উন্নতির খুঁটিনাটি রপ্ত করে অপেক্ষা করতে হবে কবে ফলটা পাকবে। আমরা ছটফট করি। কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানোর মতো সেলুনে যেয়ে, টেইলরে যেয়ে, পার্লারে যেয়ে পাকামোর লুক বানানোর চেষ্টা করি।
আর যাই হোক, ম্যাচুরিটি সিজারিয়ান করে হয় না। নরমাল হতে হয়। এর জন্য প্রস্তুতি ও অপেক্ষার কোন বিকল্প আজো তৈরি হয় নি, আর হবেও না। কারণ, একজন মানুষের চোখের দিকে তাকালে তন্ন তন্ন করে তার বত্রিশ নাড়ীর খোঁজ পেয়ে যান কামেল কর্মকর্তা।
আমাদের দেশে সব চেয়ে বেশী যার অভাব তা হচ্ছে একজন প্রফেশনাল লিডার। ভিনদেশীরা আমাদের এখানে চাকরী করে ডলার নিয়ে যাচ্ছে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি। নিজেকে প্রস্তুত করার সময় এখনো চলে যায় নি।
নিজেকে তৈরি কর, এইচ আর, হেড হান্টার তোমার বাসার কলিং বেল বাজাবে।
0 Comments