আল্লাহ্‌ সুবহানাল্লাহতায়ালা ও প্রিয় নবী (সঃ)’র মধ্যের কথোপকথন আমরা কি জানি?

আমরা বেশী জানি পূর্ণেন্দু পত্রীর “কথোপকথন”।

“দেখ অনন্তকাল ঝিঁঝিঁ পোকার মতো

আমরা কথা বলছি

অথচ কোন কথাই শেষ হোল না এখনও।“ কথোপকথন, পূর্ণেন্দু পত্রী

বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে আমরা তিন জন কথা বলি। আমি বা আপনি, আল্লাহ্‌ ও তাঁর প্রিয় হাবীবের কথোপকথন উচ্চারণ করি অনেক বার।

আমরা জানি প্লেটোর “দা ডায়ালগ” বা কথোপকথন যেখানে মুখ্য চরিত্র সক্রেটিসের জবানে ৩৫টা  প্রকৃত জ্ঞানের জবানী আছে যার একটা হচ্ছেঃ “The unexamined life is not worth living.” অর্থাৎ যে জীবন কঠিন কঠোর বাস্তবতায় পরীক্ষিত না সে জীবন যাপনের যোগ্য না।

আজ পবিত্র শব এ মেরাজ।

ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, অনেক তাৎপর্যপূর্ণ এই লায়লাতুল মেরাজ।  

ইসলামের চরম দুর্দিনে প্রিয় নবিকে সাহস দিতে ও অভূতপূর্ব মোজেজা দিয়ে সন্মানিত করতে আল্লাহ্‌ রব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় হাবিবকে কাছে ডেকে নেন।

নবীজিকে ধাপে ধাপে তৈরি করার মতো এই মেরাজ তিনটা ধাপে সঙ্ঘটিত হয় যার গভীর তাৎপর্য রয়েছে যে কোন কিছুই তাৎক্ষণিকভাবে ঘটে না।

প্রথমে মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস। বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে সিদরাতুল মুনতাহা। সিদরাতুল মুনতাহা থেকে আরশে আজিম পর্যন্ত।   

বোরাকঃ মক্কা থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত এক মাসের পথ নিমিষেই পার হয়ে যান নবীজী এই বোরাকে আরহন করে । পথে তূর পাহাড়ে নামায আদায় করেন যেখানে হযরত মুসা (আঃ) আল্লাহ্‌র সাথে কথা বলেছিলেন ও তাওরাত গ্রন্থ পেয়েছিলেন। যদিও সে দেখার মাঝখানে অন্তরাল ছিল। অন্তরাল সত্ত্বেও শুধু নুরের তাজাল্লীতে তূর পাহাড় পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

এর পর নবীজী “বায়তুল লাহামে” নামায আদায় করেন। আরবিতে “বায়তুন” অর্থ  ঘর এবং লাহাম একজন মানুষের নাম। অর্থাৎ “লাহামের ঘর” যেখানে হযরত ঈসা (আঃ) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ধীরে ধীরে এই শব্দ বাইতুল লাহাম থেকে “বেথেলহেম” হয়ে গেছে ইংরেজিতে।

বোরাক হযরত ইব্রাহিমেরও বাহন ছিল। তিনি সিরিয়ায় বিবি সারাকে নিয়ে থাকতেন। মক্কায় থাকতেন পুত্র ইসমাইলকে সাথে নিয়ে বিবি হাজেরা। উভয় যায়গায় দ্রুত যাতায়াত করার জন্য আল্লাহ্‌ তাঁকে বোরাকের নিয়ামত দিয়ে ধন্য করেন। কোন একটা প্রিয় শখ আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে কুরবানি করার প্রতিদানে আল্লাহ্‌ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে এই দ্রুত গতির বাহনের নিয়ামত দিয়ে পুরস্কৃত করেন করেন। বায়ুর গতির সিংহাসনও আর একটা নিয়ামত।  

তুরস্কে ছেলে সন্তান হলে তাঁর নামকরন করা হয় বোরাক। বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, পোল্যান্ড ও তুরস্কে বোরাক একটা “পদবী।“  অনেকে বিশেষ কিছু অর্জনের পর সামাজিক মর্যাদাপূর্ণ এই পদবী বা উপাধিতে ভূষিত হন।

লিবিয়ায় বিমান বহরের নাম “এয়ার বোরাক” ও ইন্দনেশিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া এয়ার লাইন “বোরাক”।

রাফায়েল সাবাতানির উপন্যাস “ দি সী হক” এর এক জলদস্যুর নাম “বোরাক”।

আমাদের ঢাকা শহরে একটা পরিবহনের নাম “বোরাক”

বাইতুল মুকাদ্দাসে সকল নবী ও রসূলের উপস্থিতিতে নবী করীম (সঃ) এর ইমামতি নামায আদায় করেন সবাই। নবীদের ইমামতি করার মধ্য দিয়ে নবিজীর উপাধি হয় “ইমামুল মুরসালিন।“

মসজিদুল আকসা থেকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত হযরত জিবরাঈল আমীন সঙ্গী ছিলেন।এর পর তাঁর প্রবেশের অনুমতি ছিল না। জিবরাঈল (আঃ) নবীজিকে বল্লেন, এবার আপনার যাওয়ার পালা, আমার আর যাওয়ার অনুমতি নাই। এই কথাও প্রমাণ করে নবীজির মর্যাদা!

দুনিয়ার আকাশ অতিক্রম করার সময় নবীজী তাজা ও পচা গোসত দেখতে পান। কিছু মানুষের তাজা গোসত রেখে পচা গোসত খাওয়া দেখে তিনি প্রশ্ন করে জিবাইল আমিনের কাছ থেকে জানতে পারেন যে হারাম খাওয়ার পাপে আজ তারা এই পচা গোসত খাচ্ছে। আমরাতো হরহামেশাই খেয়ে যাচ্ছি হারাম টাকায় কেনা হালাল খাবার!

কিছু মানুষের নিজের পাজরের গোসত খাওয়া দেখে তিনি জানতে পারেন এটা তাদের গীবতের কারণে হচ্ছে। গীবত যে জেনার চেয়েও জঘন্য তা হাদিসে পরিষ্কার করে ঘোষণা করা হয়েছে।  

নবীজী ৭ম আকাশে সাদা ও কালো কাপড় পরিহিত মানুষ দেখতে পান। সাদা পবিত্রতার প্রতীক। কালো অপবিত্রতার। সাদা কাপড় পরিহিতরা বায়তুল মামুর পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন তাদের পুণ্যের কল্যাণে।

রফরফঃ নবীজী সিদরাতুলতুল মুনতাহা থেকে আরশে আজিম পর্যন্ত ভ্রমণ করেন রফরফে। সেখানে তিনি আল্লাহ্‌র দিদার লাভ করেন। ৫০ থেকে কমায়ে ৫ ওয়াক্ত ফরজ নামায নিয়ে আসেন উম্মতের জন্য শ্রেষ্ঠ তোহফা হিসেবে। নবীজী আল্লাহ্‌র দিদার লাভ করেছেন আর তাঁর উম্মতের দিদারের জন্য বলেন “আসসালাতু মিরাজুল মুমেনিন” অর্থাৎ নামায মুমিনদের মেরাজ। বান্দা আল্লাহ্‌র সবচেয়ে নিকটবর্তী থাকে তখন যখন সে সেজদায় থাকে। এর মর্ম উপলব্ধি করলে আমাদের সেজদা আরও প্রলম্বিত হতে পারতো!  

আল্লাহ্‌র দরবারে উপস্থিত হয়ে নবীজী আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে বলেনঃ التَّحِيَّاتُ لِلّٰهِ وَالصَّلَوَاتُ وَالطَّيِّبَاتُ، আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি, ওয়াস সালাওয়াতু, ওয়াত- তাইয়্যিবাতু অর্থাৎ আমাদের সব শান্তি শ্রদ্ধা, আমাদের সব নামাজ এবং সকল প্রকার পবিত্রতা একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে।

উত্তরে আল্লাহ্‌ বলেনঃ اَلسَّلَامُ عَلَيْكَ أَيُّهَا النَّبِيُّ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ আস-সালামু আলাইকা, আইয়্যুহান নাবিয়্যু, ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ, অর্থাৎ হে নবি, আপনার প্রতি সালাম, আপনার উপর আল্লাহর রহমত এবং অনুগ্রহ বর্ষিত হউক ।

নবীজী রহমাতুল্লিল আলামিন নিজের উপর আল্লাহ্‌র রহমত ও অনুগ্রহ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না তাই বল্লেন, ا اَلسَّلَامُ عَلَيْنَا وَ عَلٰى عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ، আস-সালামু আলাইনা, ওয়া ‘আলা ‘ইবাদিল্লাহিস-সালিহীন। অর্থাৎ আমাদের ও আল্লাহর নেক বান্দাদের ওপর আল্লাহর রহমত এবং অনুগ্রহ বর্ষিত হউক।

উভয়ের কথোপকথন শুনে ফেরেশতাকুল সমস্বরে উচ্চারণ করলেন, أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا اللهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَ رَسُوْلُهُ‎ আশহাদু আল-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু। অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা এবং রাসুল।

সিদরাতুলতুল মুনতাহা বা শেষ কুল গাছ এত বিশাল যে এর একটা পাতার ছায়ায় সমস্ত মানবকুল আশ্রয় পেতে পারতো। এখানে দুইটা নহর প্রবাহমানঃ সালসাবিল হাউজে কাউসার ও হাউজে রহমত। এই হাউজে কাউসার থেকে পানি পান করাবেন নবীজী ইয়াওমাল কেয়ামতে। “ইন্না আতাইনা কাল কাউসার”- এটাও ছিল অন্য এক প্রসঙ্গে নবীজিকে দেওয়া আল্লাহ্‌র এক বিশাল সান্তনা।

মেরাজ থেকে নবীজী আমাদের জন্য আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে আসেন তা হচ্ছেঃ

১। এক আল্লাহ্‌র ওহদানিয়াত ২। পিতা-মাতার প্রতি সদব্যবহার ৩। আত্মীয়র অধিকার আদায় করা ৪। মিসকিন ও পথ-সন্তানদের অধিকার আদায় করা। ৫। অপচয় না করা “ ইন্নাল মুবাজ্জেরিনা কানু এখুয়ানিশশায়াতিন।“ ৬। কৃপণতা ত্যাগ করা ৭। সন্তান হত্যা না করা  ৮। ব্যাভিচার না করা  ৯। মানব হত্যা না করা  ১০। এতিমের সম্পদের কাছেও না যাওয়া।  ১১। ওজনে বা মাপে ঠিক দেওয়া।  ১২। প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা পূর্ণ করা।  ১৩। যে বিষয়ে জ্ঞান নাই তা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা।  ১৪। পৃথিবীতে মাটির উপর গর্বভরে না চলা।

এর মধ্যে “এক আল্লাহ্‌র ওহদানিয়াত” “পৃথিবীতে মাটির উপর গর্বভরে না চলা” ও বড়জোর “যে বিষয়ে জ্ঞান নাই তা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করা” এই দুই বা তিনটা যা ১৪-২১% ছাড়া বাকি সবগুলো মানুষের অধিকার সম্পর্কিত।

আমরা যদি আমাদের আমল সমূহ শুধু মেরাজের রাত্রে নফল নামাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এই রাত্রে আমাদের জন্য যে আদেশ নাজিল হয়েছে তার উপর আমল করার চেষ্টা করতাম তাহলে ব্যাক্তি, পরিবার, সমাজ তথা সমগ্র বিশ্ব জাহানের অনেক কল্যাণ হতো।

আমরা মানুষের লেখা কথোপকথন নিয়ে মশগুল কিন্তু মহান রব্বুল আলামিন ও তাঁর প্রিয় হাবীবের মাঝের কথপকথনের কথা বিশেষ একটা জানি না অথচ প্রতি দুই রাকাত বিশিষ্ট নামাজে একবার ও তিন বা চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজে দুই বার তাশাহুদ পাঠ করি।

আল্লাহ্‌ আমাদেরকে মেরাজের রাতে নাজিলকৃত আদেশ সমূহের উপর আমল করার তৌফিক এনায়েত করুন। আমীন।  

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *