শার্পনার-এর জন্ম ইতিহাস: ০২

একলব্যের মতো জিদ, ট্রেনিং, পড়াশুনা, সততা আর ‘উন্নতমানের কামলা’র মতো পরিশ্রম, এই মিলে আজকের আমি ।

আমার জীবনে চাকরী শুরুর প্রথম এবং একমাত্র হাতে লেখা আবেদনপত্র ছিল আমেরিকান বিখ্যাত বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজার-এ ।

সেই সময়ের স্বপ্নের চাকরি ছিল বহুজাতিক কোম্পানিতে । ফাইজার ছিল কোম্পানিগুলোর মধ্যে বর্ণ শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ । ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি হলেও একমাত্র ফাইজারই যে কোন বিভাগে পাশ করা ছাত্রদের আবেদন করার সুযোগ দিত । এই সুযোগটুকুই ছিল আমার একমাত্র সম্বল কারণ আমি ছিলাম ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র । বিজ্ঞান কোনদিনও পড়িনি ।

হাজারের উপরের আবেদনকারীদের থেকে  প্রাথমিক ভাবে বাছাইকৃতদেরকে নিয়ে  একটা বড় রুমে কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে বসানো হয় । এর পর “বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা” শীর্ষক বিষয়ের উপর আলোচনা করতে দেওয়া হয় । এখন মাঝে মাঝে ভাবি ১৯৮৫ সালে  ১০ কোটির কাছাকাছি  জনসংখ্যাও তখন সমস্যা ছিল, আজ ১৮ কোটিও তাই!! জন্মই হয়েছে, সম্পদ হয়নি!  আলোচনা অবশ্যই ইংরেজিতে হতে হবে । মার্কেটিং ম্যানেজার সাহেব একটা চেয়ার নিয়ে চুপচাপ এক পাশে বসে আলোচনা পর্যবেক্ষণ করছিলেন । আমার সম্বল ইংরেজির দক্ষতা এবং ছাত্র জীবনের তুমুল বিতর্কের অভিজ্ঞতা বা ভালো কমুনিকেসান স্কিল । বিজ্ঞানের কিছুই না ।

সবার কথা একবার শুনে এক্সকিউজ মি বলে আমি শুরু করে মিনিট দু’য়েক বলার পর মার্কেটিং ম্যানেজার সাহেব উঠে এসে আমার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “ওদেরকেও একটু বলার সুযোগ দাও।“ বুঝে গেলাম যে এ যাত্রায় হয়তো  বৈতরণী পার পেয়ে গেলাম ।

বাছাই করে ১৫ জনকে ট্রেনিং এর  জন্য মনোনীত করা হোল। এর একজন হতে পেরে স্বপ্নে বুক বাঁধলাম । “আমার শেষ পারানের কড়ি কণ্ঠে নিলেম গান , কণ্ঠে নিলেম, একলা ঘাটে রইব না গো, রইব না পড়ি, শেষ পারানের  কড়ি …।“  বলে বুক বেধে প্রস্তুত হতে শুরু করলাম ।

ট্রেনিঙে এ স্পষ্ট বলে দেওয়া হোল যে, ট্রেনিং-এ বসা মানে চাকরি না । ট্রেনিঙে শেষ পর্যন্ত যারা টিকবে শুধু তারাই চাকরি পাবে। গৌতম বুদ্ধের আদলে কঠিন সংকল্প করে সাধনায় বসে গেলাম দুনিয়ার সব কিছু তালাক দিয়ে ।

দুই মাস একনাগাড়ে সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসেছি আর আমার জানালায় সকাল হতে দেখেছি। নেহায়েত প্রয়োজন ছাড়া সারারাত টেবিল থেকে উঠি নাই । সকালে ট্রেনিং-এ এবং বিকেলে ছুটি হলে সোজা গুলশানে আমার আস্তানায় । মাঝে মাঝে সেগুনবাগিচা থেকে সূর্যসেন হলে এসে হাজিরা দিয়ে গেছি সীটের মালিকানা টিকায়ে রাখতে ।

ট্রেনিংএর দুই মাস আমি মনে হয় দুনিয়ায় ছিলাম না । বন্ধুদের আড্ডার মধ্যমণি এই আমি হঠাৎ হাওয়া। বিরস বদনে সবাই । বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক দলের মহড়ায় আমি নাই । University Library, British Council, Indian Library, Public Library, নীলক্ষেত বই পাড়া, গাইড হাউজ, মহিলা সমিতি মঞ্চ , শিল্পকলা কোথাও আমার টিকির সন্ধান কেউ পায় নি এই দুই মাসের প্রশিক্ষণের সময়ে।  

প্রথম দিন থেকেই বাকি ১৪ জন আমাকে কিছুটা সমাজচ্যুত বা একঘরে করে ফেললো, কারণ আমি মানবিক বিভাগের, সূর্যসেন হলের । ওরা নিজেরা গ্রুপ করে পড়াশুনা করে, গল্প করে, আড্ডা দেয়, চা খায়, আর আমাকে যত্নের সাথে এড়ায়ে চলে । কিন্তু  “তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ, দিতে পারো নি”-র মতো  তাদের অবহেলা আমার ভিতরের আগুণকে আরও একটু উস্কে দিয়েছিল । তাদেরকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে আরও জেদি করে তোলায় ।

আমার অন্যতম যোগ্যতা জিদের পালে বাতাস লাগল । সংকল্প করলাম, ফাইজারকে যদি একজনও নিতে হয় সে হবো আমি! “If it is to be, it is up to me.” কেউ পারলে আমিই পারবো। টনটনে আত্মবিশ্বাসে গড়া ধনুক ভাঙ্গা পণ!

সেল, টিস্যু, অরগ্যান, সিস্টেম, অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, প্যাথলজি, ফার্মাকোলজি , ফার্মাকোকাইনেটিক্স , ফার্মাকোডাইনামিক্স, ইত্যাদি সব বাবার জন্মে না পড়া জিনিস ট্রেনিং-এর বিষয় ।

ওরাল প্রোডাক্টের  ingestion, disintegration, dissolution, distribution,absorption, mode of action, indication, contraindication, side effect, precaution, drug interaction, over dose, excretion ইত্যাদি পরিষ্কার ভাবে জানতে হবে। আরও জানতে হবে প্রতিযোগী কোম্পানির প্রোডাক্টের খুঁটিনাটি, প্রোডাক্টের সাথে তুলনামূলক জ্ঞান, প্যাক সাইজ, মুল্য, সরবারহ ইত্যাদি । 

এবং সেলিং স্কিল । বলা হতো, ডাক্তার রোগ সম্পর্কে তোমার চেয়ে বেশী জানবে কিন্তু তোমাকে প্রোডাক্ট সম্পর্কে ডাক্তারের চেয়ে বেশী জানতে হবে । সে যুগে অনেক আকর্ষণীয় ও অভিজাত পেশা ছিল এটা। আমাদের প্রোডাক্ট ইনফরমেশানের জন্য তারা উদ্গ্রিব থাকতেন । আমরা ট্যুরে যেয়ে যে বাংলোতে থাকতাম অনেক ডাক্তার ও কেমিস্ট ওই বাংলোতেও আসতেন । এখনকার পরিবেশের সাথে কল্পনাও করা যায় না ।

জ্ঞান বিজ্ঞানের বাইরে মুয়ামেলা, মুশাহেদা অর্থাৎ উঠা বসা, চলা, ফেরা, কথা বার্তা, তাকানো থেকে শুরু করে শব্দের চয়ন বিন্যাস, প্রক্ষেপণ, উচ্চারিত শব্দের উঁচু নিচু গ্রাম সহ এমন কিছু ছিল না যা শেখানো হয় নি। ছোট বেলায় বাবার কাছ থেকে এগুলোর অনেক প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পাওয়া ছিল আমার জন্য আশীর্বাদ। উনি ছিলেন কোলকাতায় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বেসামরিক দপ্তরে কর্মরত । তাই আদব লেহাজের কিছু তালিম ছোটবেলায় জুটেছিল ।

কিভাবে বসতে হবে, কিভাবে কথা বলতে হবে, কিভাবে eye to eye contact রাখতে হবে তা তিল তিল করে শেখানো হতো।

এর পর ছিল সেই সীতার অগ্নি পরিক্ষার মতো পরীক্ষা । আমাদের কথোপকথন প্রথমে রেকর্ড করা হতো। এর পর সেই শব্দগুলোর উচ্চারণ বিধি বা ভঙ্গিমা চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বোর্ডে গ্রাফ একে দেখানো হতো যে বক্তব্যের মেজাজ অনুযায়ী কোথায় কণ্ঠ উঁচুতে উঠবে আর কোথায় স্বরগ্রাম খাদে নামবে । আবার কথা রেকর্ড করে সংশোধন করতে হতো । মাঝে মাঝে মনে হতো আমরা মনে হয় সিনেমার মহড়ায় বা কবিতা আবৃতির প্রশিক্ষনালয়ে।

এর পর শুরু হতো কথোপকথনের ভিডিও করা। ভিডিওতে একজন ডাক্তারের চেম্বারে কিভাবে প্রবেশ করতে হবে, কিভাবে বসতে হবে, কিভাবে কথা বলতে হবে, অর্থাৎ Perfect Communication কিভাবে সম্পন্ন হবে তা শেখানো হতো। এই সময়ে দেহ ভঙ্গিমা কেমন হবে অর্থাৎ বসা ও হাত পা রাখবে কিভাবে, কোন পজিশনে থাকবে তা বুঝায়ে দেওয়া হতো। কোন ধরণের বসা, কথা বলা ও দৃষ্টির কি অর্থ হয় তা শেখানো হতো ।

আর পোশাক পরিচ্ছদ তো অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও আয়রন করা থাকতে হবে। কোন উদ্ভট রঙের পোশাক পরিধান করা যাবে না । পায়ের জুতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত তীক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হতো। শেভ না করলে, জামার হাতা ভাজ করলে, জুতা পালিশ করা না থাকলে গোপনে নাম্বার কাটা যেত । পরে একসময় জানায়ে দেওয়া হতো যে অমুক দিন তুমি শেভ করো নাই বা জামার হাতা ভাজ করেছিলে বা তোমার জুতা ময়লা ছিল তাই এতো নম্বর কম পেয়েছ ।

একবার ফিল্ড ট্রেনিঙে আমি আর শহিদুজ্জামান সেলিম (নাট্য ব্যক্তিত্ব) তখনকার পি জি হসপিটালে কাজ করে অফিসে ফিরলে একজন ম্যানেজার  জামার হাতা ভাজ করা দেখে আমাকে ডেকে বললেন, “মিঃ জিলানী, full shirt is full shirt and half shirt is half shirt.” সেই থেকে এই ৩৫ বৎসরে আমি কোন দিন হাফ শার্ট পরিনি। আমার কোন সহকর্মী আমাকে হাফ শার্ট পরিহিত দেখে নি ।

অন্যত্র পাওয়া ওই সময়ের এক মাত্র প্রশিক্ষণের কথা প্রসঙ্গক্রমে বলবো । আমার Islamic Research and Comparative Religion-এর টিচার মাওলানা ফরিদুদ্দিন আত্তার  (এলমে তাসাউফ পড়াতেন)  উনার ব্যাক্তিগত লাইব্রেরি আমাকে ব্যাবহার করতে দিয়েছিলেন। প্রথম দিন উনার সাথে যেয়ে জুতার ফিতা খুলতে দেরি হওয়ায় উনি আমাকে বলেছিলেন,” তুমি তো জুতার ফিতা খুলতেই জীবনে অনেক সময় অপচয় করবা।“

এই কথার প্রভাব এতো গভীর ছিল আমার উপর যে গত ৩৬ বৎসর আমি কোন ফিতাওয়ালা জুতা পরিনি। কত জুতা পসন্দ হয়েছে কিন্তু ফিতার কারণে কিনিনি। সারা জীবন পাম্প শু ব্যাবহার করেছি । হাটার কেডসও ফিতা ছাড়া ছিল । এখন হাটার সময়ে মাঝে মধ্যে ফিতাওয়ালা কেডস পরি । কোন কোন ট্রেনিঙে বলেছি যে জুতার ফিতা না বেধে আমি ৩৫ বৎসরে ৭ মাসের সমান কর্মদিন অতিরিক্ত পেয়েছি অন্যদের তুলনায় যারা ফিতাওয়ালা জুতা পরেছে । (প্রতিদিন ১০ মিনিট X ২৫ দিন  X ১২ মাস X ৩৫ বৎসর)

হাফ শার্ট আর জুতার মহব্বত ত্যাগ করে আমি মনে হয় ঠকিনি!! 

(পরের অংশ শার্পনার-এর জন্ম ইতিহাস: ০৩ এ লিখবো ইনশাল্লাহ)

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *