‘তাও’ একটা চীন দেশীয় শব্দ। অর্থঃ পথ। ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে লাউ জূ ‘তাওইজম’ নামে এই দর্শণ প্রচার করেন। প্রথমদিকে চীনের গ্রামাঞ্চলে প্রচারিত ও প্রসারিত হলেও শেষপর্যন্ত সমগ্র চীনে পরিব্যাপ্ত হওয়ায় ট্যাং রাজবংশের রাজত্বকালে এই ধর্ম-দর্শণকে চীনের রাষ্ট্রীয় ধর্ম-দর্শণ হিসেবে অনুমদন দেয়া হয়।

এই ধর্ম-দর্শণের তিন অন্যতম স্তম্ভের একটা হচ্ছে Detachment বা নির্মোহ অবস্থা। অর্থাৎ জাগতিক কোনো বিষয়-আশয়ের উপর নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি।
এটা এই মতবাদের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত যে,”জীবন এক অবিরাম ধারা ও গতিতে নিরন্তর বয়ে চলেছে এক রূপ থেকে অন্য রূপে।”

সমস্যাটা তখনই হয় যখন এই স্বতঃস্ফূর্ত প্রাকৃতিক চলার ধারাকে রুদ্ধ করা বা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হয়। সুস্থির সামঞ্জস্য ধরে রাখা যায় এই ‘তাও’ অনুসরণ করার মাধ্যমে। তা হচ্ছে:বহমান জীবন স্রোতের ধারার সাথে যুদ্ধ না করে সমাহিত, সমাধিস্থ হয়ে নির্বিকার ভেসে যাওয়া।

“কালের মন্দিরা যে সদা বাজে, ডাইনে বায়ে দুই হাতে,
সুপ্তি ছুটে নৃত্য উঠে, নিত্য নতুন সংঘাতে।
বাজে ফুলে বাজে কাঁটায়, আলোছায়ায় জোয়ার ভাটায়,
প্রাণের মাঝে ঐযে বাজে, দুঃখে সুখে শঙ্কাতে।”

এ দর্শণ সর্ব অবস্থায় আপন গতির প্রতি নির্বিকার থাকতে বললেও কর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দেয় না।

জীবনে চলতে বলে কিন্ত জীবনের সাবলীল গতিকে বাধাগ্রস্থ করতে, প্রতিবন্ধকতা তৈরী করতে বা ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচার করতে বা বিরুদ্ধাচরণ করতে নিষেধ করে।
তাহলেই যাপিত জীবন হবে উদ্বেগ শুন্য। অনাবিল আনন্দে ভরপুর।

কাশ্মীরের ডাল লেকে নৌকায় বসে বিকেলে এক ঝাঁক বলাকাকে দিগন্তে উড়ে যেতে দেখলেন রবীন্দ্রনাথ। মনের মধ্যে ফিজিক্স’এর ‘গতি-সূত্রের’ এক ভাবের উদয় হলো। সেই নাভি পদ্মমূল থেকে জন্ম নিলো ‘বলাকা’ কাব্য।

সমস্ত চরাচরের তরু লতার মধ্যে দেখলেন ‘গতির’ এক অদৃশ্য জীবন প্রবাহ আর লিখে ফেললেন সেই অমর গান :

“ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা,
আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু, গন্ধভরে, তন্দ্রা হারা।
আমি সদাই অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি,
আমার চলা নবীন পাতায়,আমার চলা ফুলের ধারা।
……………………………………………………………….
আমার চলা যায়না বলা, আলোর পানে প্রাণের চলা।
আকাশ বোঝে আনন্দ তার, বোঝে নিশার নীরব তাঁরা। “

আমরা বন্ধনহীন, নিরাসক্ত ভাবে জীবনে চললে আকাশ বুঝবে, বেদনায় নীল হওয়া উত্তরাকাশের নীল নক্ষত্র বুঝবে আর বুঝবে সেই মহান স্রষ্টা যিনি আমাদের জন্য জেগে আছেন তন্দ্রা-নিদ্রা হারা।
“লা তা খুজহু সিনাতুউ ওলা নাউম।”-সূরা বাকারা, আয়াত ২৫৫

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *