“ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,

এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ।

শের শাহ সুরী সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করেন ও পারশ্যে নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেন । ৪০ জন সৈন্য ও স্ত্রী সহ হুমায়ুন পাহাড় পর্বত ডিঙ্গায়ে ইরানে যাত্রা করেন । তাদেরকে মাথার হেলমেট-এর খোলের মধ্যে ঘোড়ার  মাংস সিদ্ধ করে মাসাধিক কাল খেয়ে থাকতে হয়েছে । 

দীর্ঘ ১৫ বৎসর পর সম্রাট হুমায়ুন ইরানের সাফাভি  রাজবংশের সহায়তায়  মোঘল সম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে রওয়ানা হন । বৈরাম খাঁ’র সেনাপতিত্বে সিরহিন্দের যুদ্ধে সিকান্দার শাহ্ শুরিকে পরাজিত করে হুমায়ুন আবার  মোগল সম্রাট হিসেবে মুকুট ধারণ করেন । ধৈর্য্য আর পরিশ্রমে সংকটকে সম্ভাবনায় রুপান্তরিত করেন সম্রাট হুমায়ূন ।

আমরা দেখতে পাচ্ছি কি হচ্ছে দিনের পর দিন । অর্থনীতি স্থবির । নতুন চাকরি হচ্ছে  না। অনেক চাকরিজীবী চাকরী হারাচ্ছেন । সব ধরণের ব্যাবসায়ী  হাত গুটায়ে বসে আছেন । অগণিত অনিয়মিত কর্মীর কাজ নেই । দিনে দিনে ঢাকা ছাড়ার প্রবণতা বাড়ছে । অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ , সন্তানের শিক্ষা সহ নিশ্চিত জীবনে প্রলয় ঘটে গেছে, যাচ্ছে । ‘আমি সকল নিয়ে বসে আছি, সর্বনাশের আশায়’-র মত বসে বসে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই । এমন পরিস্থিতিতে অস্থির হওয়া, উদ্বেগাকুল হওয়া স্বাভাবিক। 

কিন্ত  উদ্বেগ একটা জীবন্ত-কবর । এটা কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারে না। কঠিন ধকলের মুলে আছে এই উদ্বেগ । ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিক, ব্যাক পেইন, গ্যাস্ট্রিক সহ নানা শারীরিক  মানসিক রোগের সূত্রপাত হয় উদ্বেগ থেকে। রাগ এবং হতাশা বাড়ে । উদ্বেগ বা ভয়ের অনেকাংশই কাল্পনিক ।

“What can not be cured, must be endured.” নিদান যেহেতু নেই, নিয়তি মেনে শান্ত থাকার চেষ্টা করা দরকার।  পড়াশুনা, নিজেকে তৈরি করা, আগামী দিন গুলোর জন্য পরিকল্পনা করা, প্রার্থনা করা, যোগ ব্যায়াম করা, মেডিটেশান করা, দিনলিপি লেখা,ভালো কোনও মুভি দেখা,গান শোনা সহ যে  কোনও কাজে মগ্ন হয়ে যাওয়াই সময়কে কাজের মধ্য দিয়ে কাজে লাগানো ।

মনকে ফাঁকা রাখা যাবে না। স্রষ্টার আশীর্বাদ গণনা করে শেষ করতে পারব না আমরা । ভালো থাকার অসংখ্য উপাদান আছে চারিদিকে ছড়ায়ে । সবকিছু স্রষ্টার মর্জির উপর ছেড়ে দিয়ে হালকা হওয়াই উত্তম বিকল্প । জীবনটা স্রষ্টার উপহার, যেখানে সৌভাগ্য ও উত্থান পতনের সম্মীলন ক্ষেত্র । জীবন কল্পনাক্ষেত্র না, জীবন কঠিন বাস্তবতার জমিন । জীবন কে আমরা  স্বর্গ ও নরক যে কোনও একটা বানাতে পারি ।

জীবন অনেক স্বল্পায়ু । দুঃশ্চিন্তা করে জীবন অপচয়  করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না । জীবনকে  ভালবাসলে  উদ্বিগ্ন হওয়া চলবে না । উদ্বেগকে ঝেড়ে ফেলা উচিৎ ।  এক করোনা রক্তক্ষরণ করছে, অন্যদিকে উদবেগাকুল হলে ক্ষরণ দ্বিগুণ হবে । 

তীক্ষ্ণ দুধারী ছুরির উভয় পার্শে যদি খাটি মধুর প্রলেপও থাকে তবুও ক্ষুধার্ত থেকে হলেও জিহ্বা অক্ষত রাখা বুদ্ধিমানের লক্ষণ ।

রাত যত গভীর হবে, নিকষ কালো হবে, সকাল তত দ্রুত হবে । তীব্রতম গর্ভযন্ত্রণা সন্তানের তীব্র চিৎকারের বার্তাবাহক । সমস্ত দুর্ভাবনা, শঙ্কা সেই মহামহিম স্রষ্টার উপর ছেড়ে দিয়ে দ্রুততম সময়ে নির্ভার হওয়া অনেক মঙ্গলের । আমাকে নিয়ে ভাবনা তো তাঁর, আমার না । সমর্পণের কি নিশ্চিন্ত প্রকাশই না পেয়েছে প্রেমের কবিতার এই দুইটা ছত্রে :

“এবার আমায় সপে দিলাম তোমার চরণ তলে,

তুমি শুধু মুখ তুলে চাও, বলুক যে যা বলে ।“

আমি শুধু আমার কাজ করে যাই । তুমি তোমার যা ইচ্ছে তাই করে যাও । কারণ তুমি পবিত্র কোরআনে বলেছঃ নাহনু আকরাবু ইলায়হে মেন হাবলেল উরিদ। সূরা কাফ, আয়াত-১৬ ।

“আমি তাঁর গ্রিবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী ।” হিজরতের সময় রাসুলুল্লাহ (সঃ) হযরত আবু বকরকে বললেন,” আল্লাহ্ আমাদের সাথে আছেন ।” হযরত মুসা (আঃ ) বনি ইসরাইলকে বলেছিলেন, “আমার পালনকর্তা আমার সঙ্গে আছেন ।” আমি কেন তাহলে তাঁর চিন্তা মাথায় নিয়ে উদবেগাকুল হবো ? এটা কি ঈমানের দুর্বলতা না ? এটা কি অনধিকার চর্চা না ? সূক্ষ্ম অর্থে এটা কি আবদ হয়ে সীমালঙ্ঘন করে মাবূদের সীমানায় অনুপ্রবেশ না ?  

প্রলয়ের তাণ্ডব যখন চলে তখন ভয়ার্ত বিভ্রান্তি নিয়ে মানুষ উদবেগাকুল হয় সাধারনত । কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না উত্তাল তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ ফেনিল সুমুদ্র প্রয়োজন একজন দক্ষ নাবিক তৈরি করতে ।

“যদি মাতে মহাকাল, উদ্দাম জটাজাল, ঝড়ে হয়ে লুণ্ঠিত, ঢেউ ওঠে উত্তাল,

হোয়ো না কো কুণ্ঠিত, তালে তার দিও তাল- জয় জয় জয়গান গাইয়ো ।” এমন দুর্যোগের রাত্রিতে সুমুদ্র পাড়ি দিতে নামলেই তার দক্ষ নাবিক হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা।

শান্ত সমাহিত সুমুদ্রে অবহেলে হেলেদুলে ‘ভুবন ভ্রমিয়া শেষে আমি এসেছি তোমারি দেশে’র মত রোমান্টিক যাত্রা বিদেশিনীর কটাক্ষের তির্যক খর-শর বিদ্ধ করতে পারে নাবিকের হৃদয় তন্ত্রি কিন্তু দক্ষ নাবিকের তকমা দেবে না ।

এখন পৃথিবীতে ৮২ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত । অর্থাৎ প্রতি ৯ জনে একজন অনাহারী । পৃথিবীর ২১০ কোটি মানুষ বিশুদ্ধ পানি পায়  না । আমরা কল ছেড়ে ২০ মিনি পর পর হাত  ধুই । ৫ বার অজু করি । বাইরের শাঁক সবজি ফল মুল পানিতে ভিজায়ে রেখে ধুই । বাইরের কাপড়  চোপড় ঘরে এসেই সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলি । সৌভাগ্য, নেয়ামতের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না যা আমরা প্রতিনিয়ত ভোগ করে যাচ্ছি ।

আমাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছু সৌভাগ্যকে  ধ্রুব সত্য বলে কল্পনা করে শেষ মুহূর্তে তা করতলগত না হওয়ায় কপাল চাপড়ে ঈশ্বরকে দোষ দেই ।

১৮৫৭ সালের ১১ই মে, সিপাহী বিদ্রোহের রেশ ধরে যখন দিল্লীতে অস্থিরতা, হাঙ্গামা শুরু হোল, শহর ভরা উত্তেজনা, অরাজকতা, নৃশংসতা, অভাব আর উৎকট দারিদ্রের সময়ে উর্দু সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি আসাদুল্লাহ খান গালিব, যাকে ‘তুতিয়ে হিন্দ’ বা হিন্দুস্থানের তোতা পাখি বলা হয়, প্রাচীন ফারসিতে দিনলিপি লেখা শুরু করেছিলেন যাতে হঠাৎ কেউ বুঝতে না পারে তিনি কি লিখছেন ।

নাম দিয়েছিলেন দস্তাম্বু- অর্থাৎ এক গুচ্ছ ফুল । গালিব এক জায়গায় লিখেছিলেন, “যতটুকু লিখলাম তাতে প্রাণ শুখিয়ে যাচ্ছে, যা লিখলাম না তাতে আত্মা পীড়িত হচ্ছে ।” তার মানে গালিব অনেক কিছুই লিখতে পারেন নাই । অভাবের তাড়নায় রামপুরের নবাবের কাছে বার বার কাতর মিনতি জানিয়েও মাসিক একশত টাকা ছাড়া আর কিছুই পান নি ।

নাদির শাহের লুণ্ঠনের বিভীষিকা না দেখলেও তার ‘সুযোগ্য উত্তরসূরি’ আহমেদ শাহ্ আবদালীর দিল্লী লুণ্ঠন ও  নৃশংস ধ্বংসের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায়  কিংবদন্তী উর্দু কবি মীর তকি মীর লিখলেন  ‘জিক্র-ই-মীর’ ।

মীরের ভাষায়, “ ধনরত্ন লুট করতে  আবদালী এতো লোককে হত্যা করেছিলেন যে মৃতদেহ পচে দিল্লীর কুপ-তড়াগ বিষিয়ে আবদালীর ছাউনিতে কলেরা শুরু হয়েছিল । লুণ্ঠিত ধনরত্ন নিয়ে তড়িঘড়ি করে আবদালী পালিয়েছিলেন । লুটের মাল নিতে ২৮০০০ পশু ও শকট প্রয়োজন হয়েছিল । সেনারা লুটের  মাল ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে নিজেরা পায়ে হেটে গিয়েছিল । …রাজধানীর চতুর্দিকের বহুদুর পর্যন্ত গ্রামগুলকে এমন নিঃশেষ সর্বস্বান্ত করে ফেলেছিল যে ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে দু মুঠো অন্নের জন্য হাহাকার পড়ে গিয়েছিল । হাটে বাজারে খাদ্য ছিল না । বাদশাজাদীরা পর্যন্ত দুইদিন তিনদিন ধরে অনাহারে থেকেছেন কখনো কখনো …।”

যুগে যুগে এমন বিষাদময় ঘটনা ঘটেছে।  আমরা শুনেছি।  ছাপার অক্ষরে পড়েছি।  এবার সেই ভাগ্যবান আমরা যারা ইতিহাসের চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে রইলাম।  আগামী প্রজন্ম যখন করোনার কাহিনী পড়বে,তখন তাদের কর্ণ কূহরে  প্রতিধ্বনিত হবে প্রজন্মান্তরে  শোনা গল্প গুলো। শতবর্ষের ব্যাবধানে আসা মহামারীর সাক্ষী হওয়া কম সৌভাগ্যের না !

 (লেখাটা একটা বিশেষ শ্রেণীর পাঠককে উদ্দেশ্য করে লেখা। সবাই আলোচ্য বিষয়ের আওতাধীন নাও আসতে পারেন ।)

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *