“কাল রাতে-ফাল্গুনের রাতের আঁধারে যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ মরিবার হল তার সাধ……”- জীবনান্দ দাশ

আমরা চমকে যেতে ভুলে গেছি।

পূর্ণিমার চাঁদ বা জবাই করা মানুষের “লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া” দেখেও নির্বিকার।

আসলে আমাদের স্নায়ু ভোতা হয়ে গেছে। স্থুল চিন্তা ও কর্ম করতে করতে চৈতন্যের শাণিত ধার ক্ষয়ে গেছে।
মহসিন খানের আত্মহত্যা ভাইরাল হওয়ায় অনেকের লেখায় ‘প্রচলিত লাইফ স্টাইল’, জীবনের অনিত্যতা, ধর্ম থেকে দূরে সরে যাওয়া, পারিবারিক বন্ধন ভেঙ্গে যাওয়া সহ নানা প্রসঙ্গ এসেছে।

কিন্তু সরকারী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০১টা ছেলে মেয়ের আত্মহত্যা সবার নজর এড়ায়ে গেলো!

মহসিন খান একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষ। নিজে গুলি না করলেও মাহেদ্রক্ষণে মহাকাল গুলি করতে ভুল করতো না।

মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, অনার্স পড়া ছেলে মেয়েরা কেন আত্মহত্যা করবে? ২০২০ সালে এদের আত্মহত্যার সংখ্যা ছিল ৭৯ জন। ২৮% বেশী এক বছরেই।

৫০টা পত্রিকা ঘেঁটে “আঁচল” নামের প্রতিষ্ঠানটি এই তথ্য দিয়েছে যা ২৯শে জানুয়ারির প্রথম আলো পত্রিকায় এসেছে। পত্রিকায় আসে নাই, অন্যান্য কলেজ ও কম শিক্ষিতদের হিসেব এখানে নাই।

২০-২৫ বৎসরের ছাত্র ছাত্রীদের আত্ম হত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে আর্থিক, পড়াশুনা নিয়ে হতাশা, পারিবারিক সহিংসতা, অভিমান ইত্যাদি।

১০১ টা মা জানেন গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান জন্ম দেওয়া পর্যন্ত কি নির্মম যন্ত্রণা সইতে হয়েছে। সন্তানকে স্কুলে দেওয়া পর্যন্ত কত বিনিদ্র রাত গেছে তা পৃথিবীর মানুষেরা টের পায় নি, এমন কি টের পেতে দেয় নি সেই সন্তানের জন্মদাতা পিতাকে, শুধু তাকে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেওয়ার আশায়!

তারপর, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। বলা সহজ কিন্তু ঐ পথ পরিক্রমাটা কেমন ছিল তা শুধু ভুক্তভুগী মা বাবাই জানেন। সন্তানকে তার সাফল্যের সিংহদ্বারে পৌঁছানোর জন্য কি অমানবিক কষ্ট করেছেন তা বর্ণনাতীত।

সংসার, সমাজ, দেশ তথা সমগ্র পৃথিবী থেকে ১০১টা স্বপ্ন বিলীন হয়ে গেলো! আমরা টেরই পেলাম না।

চক্রবৃদ্ধিহারে আমরা স্বপ্ন দেখি, উচ্চাভিলাষী হই। আমার দাদার স্বপ্ন, বাবার স্বপ্ন সব কিছুর টার্গেট আমার ঘাড়ে দিয়ে, পিঠে এক বোঝা বই আর নুডুলস চাপিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় বিজয়ের বরমাল্য ছিনিয়ে আনতে।

আমরা আল্লাহ্‌র কাছে মুনাজাতে বলি, ”রব্বানা ওলা তুহাম্মেল না, মা লা তা কাতালানা বিহি…।“ অর্থাৎ, হে আমাদের রব, আমাদের ঘাড়ে এমন বোঝা চাপিও না যা বইবার সাধ্য আমাদের নাই!!

অন্যদিকে মুনাজাত শেষে আমরা গণহারে অসাধ্য সাধন করতে মৃত্যু উপত্যাকায় ছুটছি।

শিল্প বিপ্লবের ফসলের পরীক্ষাগার আমরা। যত নতুন পুরাতন হাবিজাবি তৈরি হচ্ছে তা চটকদার, মনোরঞ্জনকারী বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদেরকে গেলানোর পাঁয়তারা চলছে। আগামী ৫-১০-১৫-২০ বৎসর কি কি গেলানো হবে তারও পরিকল্পনা পরীক্ষাগারে মজুদ আছে। এ ধারার ধারাপাত শেষ হবে না যতদিন না আমরা নিজেরা কিছু উদ্ভাবন করে পশ্চিমাদের গেলাতে বাধ্য করবো।

“আর্থিক অনটন, উত্তেজনা ও উদ্বেগ- সবই বহন করতে হয়েছে একা একা। শেষ মুহূর্তে যা করলেন তারও প্রস্তুতি ও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সম্পূর্ণ নিজে। নিজের জীবনভর অনুসন্ধনের চরম জবাবটি পাওয়ার জন্যই কি মরিবার হল তার সাধ?”-আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (সংস্কৃতির ভাঙা সেতু)

আমাদের পরিবার-সমাজ-সংস্কৃতির শিক্ষাগুলো গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলে আমরা আধুনিক হই। রুটি চাপাটি নুডুলস হয়ে এখন আমরা পাস্তাতে এসে পস্তাচ্ছি।

আমরা সবটুকু শ্রম দিয়ে, সংসার, সমাজকে বঞ্চিত করে অর্থ উপার্জন করেই যাবো ঐ জঞ্জাল জোগাড় করতে। এখনতো বেশী শিক্ষিত হলে চুরি বাটপারিটা আরও সুচারু, আরও সুন্দর করে করতে পারি আমরা ঐ ভোগ বিলাসের উপকরণ সংগ্রহ করতে।

আমরা আমাদের অতীত ভুলে গেছি। জঞ্জাল জোগাড় করে আধুনিক হচ্ছি। তার মূল্যও দিচ্ছি দিনে দিনে। সক্রেটিসের একটা বচন শুনেছিলাম বাবার কাছ থেকে, “How many things I can do without!” অর্থাৎ, কত কিছু ছাড়াই তো আমার দিন বেশ চলে যায়!

কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমরা এভাবে ভাবি না। আমরা আরও চাই। আরও। এখনই সমাধানের পথে না এলে এ মড়ক বন্ধ করা কঠিন হবে।

এই চাওয়ায় পরিবর্তন আনতে পারলে জীবনদর্শন পালটাবে। বিষাক্ত সমাজ ধীরে ধীরে নিউট্রাল হবে।

শাস্ত্রীয় শিল্পীরা যেমন তেহাই দিয়ে পরিবেশনা শেষ করেন, আমিও অনেক ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শেষ করি কারণ কনটেন্ট ও কমুনিকেশান।

রবীন্দ্রনাথের উপনিষদ-মন্থিত-দর্শন সসীমের সীমা পেরিয়ে অসীমের পথে ডাকে এবং ভাষার কারণে সহজবোধ্য।

সবাই যখন ভোগের জঞ্জাল জোগাড়ে মুখর তখন রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করছেনঃ

“প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ। ………
আরও আলো আরও আলো, এই নয়নে প্রভু ঢালো………

আরো বেদনা আরো বেদনা, প্রভু, দাও মোরে আরও চেতনা
দ্বার ছুটায়ে বাঁধা টুটায়ে, মোরে করো ত্রাণ, মোরে করো ত্রাণ।“……

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *