আজকাল ডিজিটাল মিডিয়ায় হর হামেশাই দেখি কারো কারো নামের শেষে একজন ‘গুরু’ শব্দটা জুড়ে দিয়েছে। যে দিয়েছে সেও মজা পায় আর যার নামের সাথে দিয়েছে সেও পুলক অনুভব করে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এই শব্দের ব্যাবহার যে কত স্পর্শকাতর, কত গুরুভার সেটা জানলে আমার বিশ্বাস অনেকেই এই কাজটা করতেন না । তবে, কেউ কেউ তো অবশ্যই এই শব্দের যোগ্য। তাদের আমি স্যালুট জানাই।

আমি যা কিছু লিখছি তা দায়িত্ব নিয়েই লিখছি। ৩৩ বৎসর ধরে কর্পোরেটের কত যে কাহিনী দেখেছি , জেনেছি তাঁর ইয়ত্তা নেই। সেই বাস্তবতার নিরিখেই আমি কথা বলছি। বই থেকে বা গুগল থেকে বা ইউটিউব থেকে না ।

এদেশের  কর্পোরেটের মাটি বাতাসে লালিত হয়ে, চোখে দেখে, পরিস্থিতির সাক্ষী হয়েই আমি এই কথাগুলো বলছি। আমি জানি এদেশে এন্ট্রি  থেকে মাঝ পর্যায়ে যারা কাজ করেন তারা কোন কালচারে কাজ করে । ‘কর্পোরেট কালচার’ শব্দটাই মুখে মুখে, আকাশে বাতাসে ভাসে, এর বাস্তব উপস্থিতি অনেক করুণ।

চাকুরী জীবনে মেন্টর বা গুরু হতে গেলে তোমার জীবনের শুরুতে কাজগুলো এতো নিখুঁত ভাবে করতে হবে যে, যে কোন পরিস্থিতিতে, যে কোন  ইন্ডাস্ট্রিতে, যে কোন পজিশানে, এমন কি যে কোন দেশে তুমি স্বাচ্ছন্দে,  সাবলীল ভাবে টীম চালাতে পারবে। এর  জন্য যেমন দরকার কাজ শেখা, তেমনই দরকার সার্বিক অর্থনীতি ও ব্যাবসা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান।

টীম হাতে পেলে যেটা প্রথমে তোমার করা দরকার তা হচ্ছে তাদের প্রত্যেককে আলাদা ভাবে চেনা। তাদের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক, শিক্ষাগত, পেশাগত সহ সব রকমের তথ্য সংগ্রহ করা।

কাজঃ টীম মেম্বরদের নিজ নিজ কাজের অগ্রগতি দেখে পেশাজীবীর মতো তোমার সময় বণ্টন করো। প্রতি মাসে তোমার ২৫ টা দিন তুমি কিভাবে ব্যায় করবে, কার সাথে কতটুকু কাজ করবে তার প্ল্যান করো। হুকুম দিয়ে,ঝাড়ি দিয়ে, মোবাইল ফোনে মনিটর করে তুমি বেশীদিন টীম ধরে রাখতে পারবা না ।

কাউকে ভালো লাগলে তাঁর সাথে বেশী সময়, আর কাউকে ভালো না লাগলে  তাকে কৌশলে এড়ায়ে গেলে তোমার সার্বিক সাফল্য ব্যাহত হবে। কারো সাথে কাজ করতে গেলে, তার কাজের দক্ষতা ও যোগ্যতা পর্যবেক্ষণ করো। তার ভালো অর্জনগুলোকে প্রশংসা করো । আমরা প্রশংসা করতে বড়ই কৃপণ । প্রশংসা করলে তার মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়া হবে, বায়োকেমিক্যাল পরিবর্তন হবে তা তাকে আরও ভালো কাজ করতে উৎসাহিত করবে।

এবার তার কোন দুর্বলতা তোমার চোখে পড়লে তাকে একাকী এমন ভাবে উপাস্থাপন করো যাতে সে আহত না হয় । আমাদের দেশের মানুষের মানসিক অবস্থা অন্য দেশের মতো না । আমরা কোন সমালোচনা বা পরামর্শ সাধারনত ভালভাবে নেই না । তাকে বল যে, এই দুর্বলতাটুকু কাটায়ে উঠতে পারলে সে তোমার চেয়েও অনেক ভালো করতে পারবে জীবনে।  প্রয়োজনে তাকে সাহায্যের  প্রতিশ্রুতি দাও । নিদিষ্ট বিরতিতে তাঁর উন্নতি নিয়ে কথা বল, তাঁর প্রসংসা করো। হ্যা, কিছু মানুষ আছে যারা কোনভাবেই কথা শুনবে না। তাদের কথা আলাদা এবং তাদের চিকিৎসাও আলাদা।

টপ ম্যানেজমেন্টের কাছে তাদের কথা বল। তাতেও তোমার সহকর্মীরা উৎসাহিত বোধ করবে। অবশ্য বিশেষ কারণে কেউ কেউ নিজের সহকর্মীর কথা টপ ম্যানেজমেন্টের কাছে বলতে চায় না। এটা তার অযোগ্যতার লক্ষণ।

ক্যারিয়ারঃ টিমের কোন কলিগের সাথে কাজ করার পর তার সাথে বসে তার কাজের অগ্রগতি, এই প্রতিষ্ঠান বা  ইন্ডাস্ট্রিতে তার পেশাজীবনের উন্নতির সম্ভাবনা নিয়ে কিছুক্ষন কথা বল। কিছু কোচিং, কাউন্সেলিং করো । তাঁর ব্যাক্তিগত, পারিবারিক বিষয়ে যতটুকু সম্ভব জানো এবং কোন সহযোগিতা লাগলে করো। মনে রেখো, একজন মানুষের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন মানসিক সাপোর্ট। এটার বেশী অভাব আমাদের দেশে।

ব্যাক্তিগত উন্নয়নঃ একজন দলনেতা বা মেন্টর বা গুরুর দায়িত্ব শুধু টিমের লক্ষ্য অর্জন না। এর পাশাপাশি টিমের সহকর্মীদেরকে ব্যাক্তিগত গুণাবলী ও যোগ্যতায় গড়ে তোলাও তার নৈতিক দায়িত্ব । ধর্মীয় দিক দিয়েও এর গুরুত্ব অপরিসীম । “তোমাকে তোমার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।“  তোমার দায়িত্তের সাথে ‘হক্কুল ইবাদ’ জড়িত।

সূরা আল ইমরানে আল্লাহ্‌ বলেন,” কুলিল্লা হুম্মা মালিকিল মূলক, তু’তিল মূলক মানতাশাউ, ও তাঞ্জিউল মূলক মেম্মান্তাশাউ…।“ বল সমস্ত সম্রাজ্যের মালিক আল্লাহ্‌, যাকে ইচ্ছা রাজত্ব/ক্ষমতা দেন, আবার যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ত/ ক্ষমতা কেড়ে নেন।“ সুতরাং তোমার এই পদ স্থায়ী কিছুই না। একে যত্ন করে আমানতের হেফাজত করো।

দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশে এর উল্টা চিত্র বেশী দেখা যায়। টিমের মধ্যে কোন সহকর্মী যদি বেশী যোগ্যতাসম্পন্ন হয় তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই দলনেতা নানা বাহানায় তার পিছনে লেগে তার  ক্যারিয়ারের বারোটা বাজানোর  প্ল্যান করেন। শেষ পর্যন্ত সে চাকরী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। পরিণতিতে হয়তো  সে ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে, ভালো কোন মেন্টর বা গুরুর হাতে পড়লে তার জীবনটা সুন্দর হয়। নইলে নানা ঘাটে নাও ভিড়াতে ভিড়াতে একটা সম্ভাবনাময় প্রতিভার অপচয় হয়।

এটা হওয়ারও  কারণ আছে।  দলনেতা যদি  নিজেকে ঠিক মতো তৈরি করে উঁচু পদে বসতেন তাহলে টিমের সব ধরণের সহকর্মীকে পরিচালনা করতে দক্ষ হতেন। অনেক ক্ষেত্রে শুধু কাজ দেখে প্রোমোশন দেওয়াতে এই সমস্যা হয়। একজন টীম মেম্বার হিসেবে ভালো হতে পারে, একার কাজ একা ভালো করতে পারে কিন্তু দলনেতা হলে তো সবার কাজ একত্র করে নিতে হবে। সেই দক্ষতা সবার থাকে না বা সেই দক্ষতা তৈরি হওয়ার আগেই যে কোন ভাবে প্রোমোশন হওয়াতে সে তালগোল পাকিয়ে ফেলে।

আমাদের দেশে ম্যানেজমেন্টের এই জায়গায় যে কত অপচয় হচ্ছে তা কেউ মালিক পক্ষকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় না । এটা সমগ্র দেশের অপচয়। মাঝখান দিয়ে বলা হয় যে আমাদের দেশে এখনকার প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা কাজের না, কাজ করতে চায় না । কেউ সাধারনত গভীরে যেয়ে দেখে না যে কেন তারা কাজের না বা কাজ করতে পারে না ।

টীম মেম্বারদের ঠিকমত তৈরি না করার পিছনে আরও কিছু হিডেন এজেন্ডা আছে। আগামিতে সেটা নিয়ে আলোচনা করবো।

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *