মহাসাগরকে যেমন চামচে মাপা যায়না, তেমনই স্বামী বিবেকান্দ সম্পর্কে দুই চার পৃষ্ঠায় লিখতে গেলে ধৃষ্টতা মনে হবে।

আমি তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের কষ্ট, ক্লেশ, অগণিত, অসুখ, বিসুখ, বাঁধা, বিপত্তি উপেক্ষা করে কর্তব্য সম্পূর্ণ করার দৃঢ় মানসিকতা এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ীর হাসি হেসে পরপারে পাড়ি জমানোর উপর আলোকপাতের চেষ্টা করবো ।

আজ আধুনিক ভারতের স্বপ্ন- পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের মহা প্রয়াণ দিবস। তাঁর আর একটা পরিচয়, তিনি বাঙালি। সমাজ, ধর্ম, দর্শণে তাঁর ভেঙ্গে-গড়ার প্রভাব ছাড়াও তিনি বাংলা ভাষার এক অনুপম লেখক।

জীবনকে ধ্রুবতারার মতো কোনও লক্ষের দিকে নিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলে আমাদের ইয়াং জেনারেশনের এই লেখাটা ও এই মনিষীর জীবনী এবং রচনাসমূহ যত্নের সাথে পড়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়েছে ।

১৯০২ সালের এই জুলাইয়ের ৪ তারিখে, মাত্র ৩৯ বছর পাঁচ মাস ২৪ দিনের মহার্ঘ্য পরমায়ুর সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাবহার করে স্বামী বিবেকানন্দ ইহধাম ত্যাগ করেন । যে বয়সে অনেকের আক্কেল দাঁত ওঠেনা (রূপকার্থে) সে বয়সে তিনি জাগতিক জীবনের পরিকল্পিত কাজগুলো অভাবনীয় বাঁধা ও ব্যাধি অতিক্রম করে সম্পন্ন করে ‘মরণ রে, তুহুঁ মম শ্যাম সমান’ বলে নশ্বর দেহ রেখে অনন্তের পথে নিরুদ্বেগে হাসিমুখে যাত্রা করলেন !!

আসমুদ্র হিমাচল বিস্তীর্ণ ভারতবর্ষ প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিলেন তিন যুগ নায়ক। মহামতি বুদ্ধ । শ্রী চৈতন্য মহাদেব এবং স্বামী বিবেকানন্দ ।

নরেন্দ্রনাথ দত্ত, ডাক নাম বিলু, কি করে সাধারণ পরিবারে জন্মে ও পারিবারিক সঙ্কটসমূহ কাটায়ে স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে উঠলেন তা এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞান।

শিক্ষা- ১৮৮৪ সালে স্নাতক উত্তীর্ণ হন। আইন পড়তে শুরু করেছিলেন কিন্তু শেষ করেন নাই। জগতের শিক্ষক হিসেবে যেঁ আবির্ভূত হবেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন কি তাঁর! তাঁর মহাসাগরের মতো রচনাবলী পড়লে বিশেষ করে তাঁর ইংরেজির মান দেখলে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায় পাওয়া মার্ক্স-এর মানদণ্ডে তাঁকে মাপতে যাওয়া বোকামি । স্বামীজি প্রবেশিকায় ইংরেজিতে পেয়েছিলেন-৪৭, উচ্চমাধ্যমিকে-৪৬ এবং বি এ-তে ৫৬। তাঁর ইংরেজি লেখা পড়লে নিশ্চয়ই কেউ আমার দেওয়া এই তথ্য বিশ্বাস করতে চাইবেন না।

রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সান্নিধ্য তাঁকে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণে উৎসাহিত করে । রামকৃষ্ণ পরমহংস পরবর্তী কাজের দায়িত্ব এই সুযোগ্য উত্তরসূরির হাতে দিয়ে যান।

স্বামী বিবেকানন্দ মনে করতেন শিক্ষা নতুন কিছু না, তা মানুষের ভিতরেই থাকে, শিক্ষার মধ্যে তাঁর পরিপূর্ণতার প্রকাশ ঘটে । তিনি বিশ্বাস করতেন প্রচলিত শিক্ষা ব্যাবস্থা মানুষকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে সাহায্য করে না, আত্মনির্ভরশীল করেনা, আত্ম মর্যাদাবোধ সম্পন্ন করে না । তিনি শিক্ষাকে সনদের বেশী কিছু মনে করতেন, মানুষের চরিত্র গঠনের মাধ্যম মনে করতেন।

“Educationis not the amount of information we put into your brain and runs riot there, undigested, all your life. We must have life building, man making, and character making assimilation of ideas. If you have assimilated five ideas and made them your life and character, you have more education than any man who has got by heart a whole library.” –Swami Bibekanando

স্বামী বিবেকানন্দ মানুষকে পজিটিভ শিক্ষা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তিনি মনে করতেন নেগেটিভ চিন্তা মানুষকে দুর্বল করে দেয় । আমরা সন্তান্দেরকে যে বকাবকি করি, তাঁর মতে, এটা কোনও ভালো ফল দেয় না ।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব সুভাষ চন্দ্র বোস বলেছিলেন, “আমি বিবেকানন্দ সম্পর্কে না লিখে পারছি না । এমনকি তাঁর সঙ্গে যারা অন্তরঙ্গ হবার বিশেষাধিকার পেয়েছে তাদের মধ্যে খুব অল্প কয়েকজনই তাঁকে বুঝতে পারত বা তাঁর গভীরতা মাপতে পারত । তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল সমৃদ্ধ, সুগভীর, জটিল…ত্যাগে তিনি বেপরোয়া, কর্মে তিনি বিরতিহীন, ভালবাসায় তিনি সীমাহীন, জ্ঞানে তিনি প্রগাঢ় ও বিচিত্রগামী, আবেগে তিনি প্রাণোচ্ছ্বল, আক্রমণে তিনি করুণাহীন তথাপি শিশুর মত সরল, আমাদের পৃথিবীতে তিনি ছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব।“

যুব সমাজকে তিনি তৈরি হতে বলেছেন । দেশের দায়িত্ব নিতে বলেছেন। পরিবর্তন চাইলেই পরিবর্তন এসে পড়ে না । পরিবর্তনমুখী হয়ে উঠতে হয় । তাঁর জন্য চাই প্রস্তুতি । প্রত্যেকটা সিঁড়ি ভেঙ্গে ওঠা চাই । শরীর মন ঠিক করতে বলেছেন। আগে দরকার শক্ত দেহ, সাবলিল মন এবং প্রখর সাধারণ বুদ্ধি এবং কাণ্ডজ্ঞানের প্রয়োগ । তারপর গীতা পাঠ । বিভেদ ঘোচান, অবুদ্ধি ঘোচান, দূরত্ব ঘোচান ।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজগুলর মধ্যে পশ্চিমা দেশে ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শন পরিচিত করা। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে, আধুনিক মোড়কে হাজির করেছেন তিনি। এটা ঠিক,বিবেকানন্দ রচনাবলী না পড়লে ভারতীয় দর্শন গভীর ভাবে বোঝা সম্ভব না। সনাতন ধর্ম জিনিসটা ঠিক কি-সেটাও বিবেকানন্দ পড়েই পরিষ্কার উপলব্ধি করা যায় । তিনি একজন গীতার আধুনিক ভাষ্যকার।

বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আন্ত-ধর্মীও সম্প্রীতি বাড়ানোর চেষ্টা করা। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করা। রামকৃষ্ণ বল্লেন,”তুই সবচেয়ে শক্তিশালী, বুদ্ধিমান । তোর হাতেই মানুষের পরিত্রানণর দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি ।“

১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে ভাষণ দিয়ে অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেন । ১৮৯৪ সালে নিউইয়র্কে বেদান্ত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন । আয়ারল্যান্ডের মিস মারগারেট (ভগিনী নিবেদিতা) ভারতে এসে আধ্যাত্ম সাধনা ও জীবসেবায় জীবন উৎসর্গ করেন । স্বামীজী শুধু বেদান্ত দর্শণ প্রচারই না, তিনি বেদান্ত দর্শণের ব্যাবহারিক প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । শুধু আচার অনুষ্ঠান না, জীব সেবার মধ্য দিয়েও ঈশ্বরকে লাভ করা যায় তাঁর প্রমাণ তিনি করে দেখিয়েছেন ।

তাঁর সেই বিখ্যাত বাণী “বহু রুপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুজিছ ঈশ্বর, জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।“ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ,গান্ধি সুবাষ বসু, ঋষি অরবিন্দু, লোকমান্য তিলক, জগদীশ চন্দ্র বসু, রম্যা রলা প্রমুখেরা স্বামিজির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । ১৮৯৭ সালের পহেলা মে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেন ।

স্বামী বিবেকানন্দ জাতীয় যুব উন্নয়নে অনেক ভুমিকা রাখেন। ১২ই জানুয়ারী, তাঁর জন্ম দিনে ভারতের জাতীয় যুব দিবস পালন করা হয় ।

পৃথিবীর অধঃগতি দেখে স্বামীজী বলেন, আজকের পৃথিবীর যা দরকার তা হোল নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব । মানুষ পাপী হতে পারে না , সে যা, অনন্ত সম্ভবনা ও শক্তির অধিকারী। তাঁকে সংশয় থেকে নিঃসংশয় হতে হবে, তাঁকে ধাপে ধাপে উপরে উঠতে হবে । Work is Religion। To learn is Religion. প্রহরে প্রহরে জাগরন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন চাই । তাঁর বন্ধু মাক্লিওড বলেছেন, “he learned everyday. He was different everyday.”

দেশের মানুষের, সমাজ কাঠামোর সব জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য সবাইকে উদাত্ত আহবান জানায়েছেন। এসো মানুষ হাও। নিজের গণ্ডির থেকে বের হয়ে এসো। আমরা সকলে প্রানপণে ভালো হওয়ার চেষ্টা করি । ……মনে রেখো মানুষ চাই, পশু নয় ।“ তিনি তিন দিক দিয়ে সবাইকে দিক্ষা দিয়েছিলেন ১) কর্ম যোগ ২) ত্যাগ ও সেবার সাধনা ৩) ছুৎমার্গ পরিহার করা ।

স্বামীজী আক্ষেপ করে বলেন, “যে দেশে কোটি কোটি মানুষ মহুয়ার ফল খেয়ে থাকে আর দশ বিশ লাখ সাধু আর ক্রোর দশেক ব্রাহ্মণ ওই গরীবদের রক্ত চুষে খায় আর তাদের উন্নতির কোনও চেষ্টা করে না সে কি দেশ, না নরক? সে কি ধর্ম, না পিচাশ নৃত্ত ?

স্বামীজী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিয়েছিলেন । তাঁর সঙ্গীতের শ্রুতি এতো সূক্ষ্ম ছিল যে, হিমালয়ের পথে রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছে অলকনন্দা নদীর কুলুধনি শুনে তিনি এক অপূর্ব কবিতার ভাষায় বলেছিলেন, “উহা এখন কেদার রাগে প্রবাহিত হইতেছে।“ কণ্ঠ বা যন্ত্রের সুরের বাইরে প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত যে বৈচিত্র্যময় সুরলহরি খেলা করছে তা উপলব্ধি করতে হলে সঙ্গীতের গভীর জ্ঞান প্রয়োজন যার বলে তিনি নদীর কুলুধনির মধ্যের রাগ রাগিণী চিনতে পেরেছিলেন।

আমৃত্যু শোকে দুঃখে ও অপমানে প্রকৃত অস্তিত্ববাদী লেখকের মতো বলেছিলেন, “আবার আমি যখন এখানে ফিরব তখন আমি সমাজের উপর একটা বোমার মতো ফেটে পড়ব , আর সমাজ আমাকে কুকুরের মতো অনুসরণ করবে ।“

গীতার টীকা ভাষ্য নতুন করে রচনা করেন স্বামীজী । সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেন কর্ম যোগের উপর। কর্মের বাইরে তিনি কিছুই বুঝতেন না যা নিজের জীবনের পলে পলে দেখায়ে গিয়েছেন । তাই তো তিনি উচ্চারণ করতে পারেন যে গীতা পড়ার চেয়ে ফুটবল খেলা অনেক ভালো ।

কর্মের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যেখানে বলেন,

“রাখরে ধ্যান, থাক রে ফুলের ডাল ,ছিঁড়ুক বস্ত্র লাগুক ধুলা বালি

কর্ম যজ্ঞে তাঁর সাথে এক হয়ে, ঘর্ম পরুক ঝোরে ।“

বিবেকানন্দ বললেন, “নতুন ভারত বেরুক । বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে , জেলে, মালা, মুচি, মেথরের মধ্য হতে, বেরুক মুদির দোকান থেকে, ভুনাওয়ালার উনুনের পাশ থেকে, বেরুক কারখানা থেকে, হাট থেকে, বাজার থেকে, বেরুক ঝাড় জঙ্গল পাহাড় পর্বত থেকে ।“

বিবেকানন্দ সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন। সে যুগে কলেরা, টাইফয়েডে প্রতি ঘর থেকে এক দুইজন মারা যেত। বিবেকানন্দ একবার মহামারিতে ৩৫ টা মৃতদেহ দাহ করেছিলেন। অসুরের মতো শক্তি না থাকলে এটা পারতেন না । কিন্তু অতিপরিশ্রমে তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ে । রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, “কারো একটা দেহ থাকলে তাঁকে তাঁর মূল্য দিতে হবে । অর্থাৎ তুমি হচ্ছ এক বাক্স ভর্তি মণি মাণিক্য । এগুলোর যত্ন নিতে হবে। কিন্তু কে শোনে কথা? ক্রনিক ইমসমনিয়া ছিল তাঁর। রাত ৩ টায় ঘুম থেকে উঠে যেতেন । মারি হেলকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন,”এই শীতে আমি একদিনও ঠিকমত ঘুমাইনি ।“

বাবার থেকে পাওয়া ডায়াবেটিক ছিল ।কৃষ্ণ মহারাজ বলেন, কলম্বোতে প্রথম তাঁর ডায়াবেটিক ধরা পড়ে এবং ডাক্তার বলেছিলেন, খাবার ঠিকমত খেতে ও মানসিক চাপ এড়াতে। সে যুগে এর ওষুধও আবিষ্কার হয় নি । অ্যালপাথিক, হোমিওপাথিক ও আয়ুর্বেদ সবই করতেন। পরবর্তীতে মায়াবতীতে অবস্থান কালে স্বামী বিরজানন্দকে বলেছিলেন,”আমার থেকে শেখ। শরীরের প্রতি অতো কঠোর হইয়ো না এবং স্বাস্থ্য বিনাশ করো না । অত্যাচার করে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়টাকে আমি শেষ করেছি এবং এখন এর মূল্য দিচ্ছি ।“ ১৮৯৭ সালে আমেরিকা থেকে ফিরে সারা বুলকে লিখলেন,”আমি মৃত প্রায় । জানিনা বিশ্রাম না নিলে ৬ মাসও বাঁচবো কি না ।“

তাঁর রোগসমূহের মধ্যে, মাইগ্রেণ, টনসিলাইটিস,ডিপথেরিয়া, অ্যাজমা, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, লিভার ডিজিস ,গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস, পাকস্থলীতে পানি জমা, ডিসেন্ট্রি , ডাইরিয়া, ডিসপেপসিয়া, পিত্তথলির পাথর, কোমরে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা , নেফ্রাইটিস, কিডনির রোগ, ড্রপসি, অ্যালবুমিনউরিয়া , ব্লাডশট আই, ডান চোখের দৃষ্টি হারানো, নিউরাসথেনিয়া , রাতের খাবারের পর শরীর গরম ওঠা, অতিমাত্রায় অবসাদ, হৃদপিন্ডের সমস্যা ইত্যাদি।

এতো রোগ থাকার পরও মহাযজ্ঞের মতো সল্পায়ু হয়েও এতো কিছু কি করে করলেন ভাবলে অবাক হতে হয়। আমরা যারা সামান্য অসুখে কাতরাই তাঁরা কৈফিয়ত না দিয়ে এখান থেকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা নিতে পারি।

প্রচণ্ড মানসিক শক্তি ছিল স্বামীজীর। তিনি বুঝেছিলেন, যে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন শরীরের অজুহাত দিলে তা শেষ হবে না ।

২৪ জুলাই, ১৮৯৭, স্বামী অক্ষরানন্দকে লিখলেন, I have started with new enthusiasm. One has to die, but why should it be through laziness? It is better to wear out than to rust out.”

ছাত্র অবস্থায় ম্যালেরিয়ায় ভুগেছেন। স্বামী গাম্ভিরানন্দ তাঁর ‘যুগ নায়ক বিবেকানন্দ’ বইতে লিখেন, “ম্যালেরিয়ার জন্য নরেণ কলেজের প্রথম বর্ষে নিয়মিত ক্লাস করতে পারতেন না, যে জন্য সমাপণী পরীক্ষায় যোগ দিতে সমস্যা হয়েছিল ।

স্বামিজির পেটের ব্যাথার কারণে বরানগরের সবাই উদ্বিগ্ন ছিলেন। ব্যাথা উপসমের জন্য ডাক্তার অল্প পরিমাণে আফিম খেতে দিয়েছিলেন বলে আতুল চন্দ্র ঘোষ বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন, এরা এই অতুলনীয় প্রতিভাধর মানুষটাকে শেষ করে ফেলবে।

পাকস্থলীর সমস্যা না কমার কারণে ক্ষেত্রীর মহারাজা বিবেকানন্দের জন্য জাহাজের প্রথম শ্রেণীর টিকিট কেটে পশ্চিমে পাঠালেন । জাহাজ থেকে স্বামীজী লিখলেন, আগে ২০-২৫ বার বাথরুমে যেতে হতো কিন্তু জাহাজে অনেক উপশম হয়েছে। স্বামীজীর পেটের পীড়া পক্ষান্তরে ইন্ডিয়াকে প্রভূত উপকার করেছে। ক্ষেত্রীর মহারাজা ১ম শ্রেণীর টিকেট দিয়েছিলেন বলেই তিনি জাহাজে জামশেদজি টাটা’র সাথে সাক্ষাত করতে পেরেছিলেন এবং টাটাকে বলেছিলেন ইন্ডিয়াতে শিল্পায়ন করার জন্য । জামশেদজি টাটা ম্যাচ আমদানির জন্য জাপান যাচ্ছিলেন একই জাহাজে। স্বামীজী টাটাকে আরও বলেছিলেন যে যুব সমাজের জন্য বিজ্ঞান ও প্রকৌশল শিক্ষা বিস্তার করা দরকার । ফল হচ্ছে, টাটা পরিবারকে Father of Indian Industry বলা হয় ।

বদ্রিনারায়নে স্বামীজির প্রচণ্ড জ্বর আসলো । হৃষীকেশ পৌছার পর সেই ম্যালেরিয়া আবার হাজির । ঘাম এবং শরীর ঠাণ্ডার সাথে নাড়ী ক্ষীণ । এক সাধু একটু মধু ও পিপুল পাতার গুঁড়া খাওালে স্বামীজী ধীরে ধীরে চোখ মেললেন । ১৯০০ সালে, সানফ্রানসিসকোতে স্বামীজির স্নায়ু ভেঙ্গে পড়ে । ব্রম্মানন্দকে লিখলেন,” I really require rest. My disease is called neurasthenia-a disease of the nerves.“

শিকাগোর বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনের বিজয় তাঁর জীবনের শেষ বা শ্রেষ্ঠ কাজ ছিল না । বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করা ।

ইলেন ওয়ালডও কে লিখেছিলেন,” I can not remember how I look. I look and look at myself in the glass, but the moment I turn away, I forget completely what I look like.”কি পরিমাণে মানসিক শক্তি আর কর্তব্যের প্রতি অবিচল থাকলে এমন কথা উচ্চারণ করা যায়!! অনেকে ধারণা করেন ছোট ভাই মহেন্দ্রনাথকে দেখতে লন্ডনে গেলে সেখানে তাঁর মৃদু হার্ট অ্যাটাক হয় ।

নিষ্কাম কর্মের কতো উঁচু বোধে উপনীত হয়েছিলেন যে তিনি পার্থিব সবকিছু থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে ফেলেছিলেন । আর তাই এই কথা উচ্চারণ করতে পারেন, “to me this worldly life is but a play. It will always remain so.So, I don’t care about insults or petty loses; I am a man of action. I see that, people give advice after advice- this one says this, that one says that; again that one threatens and this one frightens.”

প্রচণ্ড কর্মভারের মাশুল তাঁকে কোন কড়িতে দিতে হয়েছিলো তা তাঁর এই বাক্যটা পড়লে বুঝা যায় “two years of my physical anguish have taken away twenty years of my life.”

তাঁর রাশিফল পরীক্ষা করানোর জন্য সিস্টার নিবেদিতকে বকেছিলেন। তিনি ছিলেন কাজের মানুষ, গ্রহ-নক্ষত্র দেখে চলা মানুষ না । নিজের চৈতন্যের থেকে উদ্ভূত দেশ ও সমাজের প্রতি কর্তব্যবোধ ও ঠাকুর রামকৃষ্ণের অর্পিত দায়িত্ব পালন করার তীব্র জ্বালার কারণে দুনিয়ার কোনও কিছুর প্রতি ভ্রূক্ষেপ করতে পারেন নাই । এমন কি নিজের শরীরের প্রতিও না । নিজে দায়িত্ব পালনই করেন নাই, সবাইকে দেখায়ে গেছেন যে কি করে দায়িত্ব পালন করতে হয় । অতি শ্রমে তাঁর ব্যাম করা সুগঠিত সুঠাম দেহের ক্ষয় হয় দ্রুত ।

স্বামীজী কায়রো থেকে ইন্ডিয়া আসার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়লে তাঁকে কারণ জিজ্ঞাসা করা হয় । তিনি বললেন, তিনি তাঁর গুরুভাইদের কাছে থেকে মৃত্যু বরণ করতে চান । এর পর আসলো সেই ভয়ঙ্কর কথা, তিনি বললেন, “আমি জুলাই মাসের ৪ তারিখে মারা যাবো ।“ ১৯০০ সালের ২৬শে নভেম্বার এস এস রুবাতিনু জাহাজে করে স্বামীজী কায়রো থেকে বম্বের উদ্দেশ্য যাত্রা করেন । কায়রোতে তাঁর দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল । কিন্তু তাঁর অকল্পনীয় মানসিক ও শারীরিক শক্তির জন্য কেউ বুঝতে পারে নাই ।

প্রিয় মাতৃভূমির করুণ অবস্থা নিজ চোখে দেখার মানসে কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারিকা ভ্রমণ শুরু করেন । অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন স্বামীজী বৈচিত্র্যময় এই দেশটাকে দেখার জন্য । ট্রেনের তৃতীয় শ্রেণীতে ভ্রমণ করতে পারেন নাই শুধুমাত্র বার বার বাথরুমে যেতে হতো এই কারণে। কতো বিব্রত অবস্থার মধ্যেও তিনি সংকল্প থেকে সরে আসেন নাই ? আমরা যদি একটু আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যাগুলোর সাথে মিলায়ে দেখি তাহলে বুঝতে পারবো কেন কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছাতে পারি না ।

ঢাকার একজন শিষ্য প্রশ্ন করেছিলো, এতো কম বয়স সত্তেও আপনার শরীর কেন ভাঙল ? উত্তরে বলেছিলেন, আমেরিকা থাকা অবস্থায় তাঁর মনেই ছিল না যে তাঁর একটা শরীর আছে!!!

অমরনাথে পাহাড়ে চড়ে হৃদপিণ্ডে প্রবল চাপ পড়েছিল । বেলুর মাঠে ফিরে আসলে তাঁর ডান চোখে একটা লাল দাগ দেখা দিল এবং তিনি ওই চোখের জ্যোতি হারাতে থাকলেন ।

জীবনের অন্তিমে সিস্টার খ্রিস্টিনকে লিখেছিলেন, “my overtaxed nerves make me outrageous now and then. ….trying my best to make myself gentle as a lamb.”

ডাক্তার সুব্রাত সেন বলেন, ডায়াবেটিসের কারণে কিডনির অসুখ হয়েছিল এবং রেনাল ফেইলিউর-এর কারণে তাঁর শরীর কালো হয়ে যাচ্ছিল । তাঁর দুর্বিষহ অবস্থার বর্ণনা নিচের বাক্যগুলোতে পাওয়া যায়ঃ

“My right eye is failing me badly…hard to read or write. I am just under another spell of cataract and asthma….I am forbidden to eat meat, to walk or even to stand up, to read and write.” পা ফুলে গিয়েছিল। হাটতে পারতেন না । মৃত্যুর আগের এক বছর একটুও ভালমতো ঘুমাতে পারেন নাই ।

স্বামীজী মিস ম্যাকলিওডকে বলেছিলেন, আমি কোনদিনও চল্লিশ দেখব না, অর্থাৎ চল্লিশের আগেই তিনি মারা যাবেন।

৪ঠা এপ্রিল সকালে পূজা করলেন । কোনও অসুস্থতার চিহ্ন ছিল না । নাশতা করলেন। স্বামী প্রেমানন্দের সাথে মজা করলেন। বছরের প্রথম ইলিশ এল। এক শিষ্যকে বললেন বছরের প্রথম ইলিশ, পুজ করো।

সকালে হাটতে হাটতে প্রেমানন্দকে বললেন, কেন আমাকে অনুকরন করো? আমার মতো হোয় না। তোমার মতো হাও।“

ভাত, ভাজি, অম্বল দিয়ে সবার সাথে খেলেন। লাইব্রেরি তে তিন ঘণ্টা ধরে পাণিনি থেকে সংস্কৃত ব্যাকারন শেখালেন । বিকাল ৪টায় দুই মেইল হেটে আসলেন । সন্ধ্যায় গঙ্গার অপারেরর দক্ষিণেশ্বর মুখি হয়ে মেডিটেশান করলেন । শরীর গরম অনুভুত হওয়ায় শুয়ে পড়লেন ও জানালা খুলে দিতে বললেন । বাতাস দিতে হবে না, তোমরা আমার পা মালিশ করে দাও । বাচ্চাদের মতো ক্রন্দন করতে লাগলেন ।

ডাক্তার মহেন্দ্র মজুমদার এলেন গঙ্গার ওপার থেকে । দেখলেন হার্ট কাজ করছে না । কৃত্রিম শ্বাসের চেষ্টা করলেন । রাত ১২টায় ডাক্তার ঘোষণা করলেন মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাটাকে ।

স্বামীজী যে মৃত্যুহীন প্রাণ সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর চুলচেরা পাওনা গণ্ডা আদায় করে মাথা উঁচু করে অসীমের পানে যাত্রা করলেন ।

শিখায়ে গেলেন যে জীবনের আয়ু যত বেশী বা কম হউক না কেন কর্তবব্যের প্রতি অটল থাকলে কোনও বাঁধাই সামনে দাঁড়াতে পারে না । সাধারনত যে বয়সে মানুষের পরিপক্কতা বা ম্যাচুরিটি আসার কথা সেই বয়স পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি পার্থিব কাজ সম্পাদন করে অসীমমুখী হলেন ।

অনাগতের জন্য তিনি রেখে গেছেন শরীর মনকে শক্ত করে কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কাররের ঊর্ধে উঠে মানুষের সেবার ভিতর দিয়ে সাম্যের সমাজ গড়ার দিগ নির্দেশনা ।

তাঁর প্রয়াণ দিবসের শিক্ষা এটাই যে মানুষকে ঘৃণা করে দেবালয়ে যেয়ে ঈশ্বর পাওয়া যায় না । ঈশ্বর পাওয়া যায় নিরন্ন, নিপীড়িত, নিগৃহীত মানুষের সেবায়।

“তাইতো তুমি রাজার রাজা হয়ে, তবু আমার হৃদয় লাগি,

ফিরছ কত মনোহরণ বেশে, প্রভু, নিত্য আছো জাগি ।“- রবীন্দ্রনাথ

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্বামীজীকে উদ্দেশ্য করেন রচনা করেছেন এই অনুপম সঙ্গীতটিঃ

“জয় বিবেকানান্দ সন্ন্যাসী বীর চির গৈরিক ধারী

জয় তরুণ যোগী, শ্রী রামকৃষ্ণ ব্রত-সহায়কারি ।

যজ্ঞাহুতির হোমশিখা সম, তুমি তেজিস্বি তাপস পরম

ভারত অরিন্দম নম নম, বিশ্ব মঠ বিহারী ।

মদ গর্বিত বল-দর্পীর দেশে মহাভারতের বাণী

শুনায়ে বিজয়ী ঘুচাইলে স্বাদেশের অপযশ গ্লানি

নব ভারতে আনিলে তুমি নব বেদ

মুছে দিলে জাতি ধর্মের ভেদ

জীবে ঈশ্বরে অভেদ আত্মা জানাইলে হুঙ্কারি ।“

সুরঃ কমল দাস গুপ্ত

শিল্পীঃ কমল দাস গুপ্ত ও যূথিকা রায়

সময় কালঃ সেপ্তেম্বার, ১৯৩৭

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *