‘তকদীর’ বা বিধিলিপি দুই প্রকারের। কিছু অখণ্ডনীয় আর কিছু খণ্ডনীয়।

আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যে ‘তকদীর’ বন্টিত হয়ে আসে তার সহচর হয়ে চলা উত্তম সহবত বা আচরণের নমুনা। বহমান জীবনে নানা চড়াই-উৎরাই, মসৃণ-বন্ধুর পথ আমাদের পার হতে হয়। তিক্ত সময় না থাকলে মধুর সময়ের স্বাদ আমরা অনুভব করতে পারতাম না।

নিরবিচ্ছিন্ন সুখ থাকলে তা একসময় একঘেয়ে হয়ে উঠত আমাদের কাছে যেমন স্বর্গীয় সুস্বাদু খাবার ‘মান্না সালওয়া’ খেয়ে একঘেয়েমি লেগেছিল মুসা নবীর উম্মত বনী ইসরাইলদের। এক খাবারে বিরক্ত হয়ে তারা তাদের নবীকে বলেছিল,” মুসা, তোমার আল্লাহকে বল অন্য খাবার দিতে, এই একই খাবার আর কতদিন খাবো?” পরিণতিতে ‘মান্না সালওয়া’ রহিত হয়ে গেলো আর মানুষকে পরিশ্রম করে, চাষাবাদ করে ভিন্ন স্বাদের খাবার খেতে হচ্ছে।

সুখের সময়ের তৃপ্তি উপভোগ করার মতো দুঃখের সময়কে উপভোগ করতে পারলে প্রমাণিত হবে কারো মধ্যে ঈমান তৈরি হয়েছে। কারো মধ্যে ‘উইজডম’ বা আত্মজ্ঞান তৈরি হয়েছে।

‘খণ্ডনীয় তকদীর’ প্রার্থনার মাধ্যমে পরিবর্তন করা যায়। একারনেই আল্লাহ্‌ বলেন, “উদ উ নি, আস্তাজিবলাকুম” অর্থাৎ আমার কাছে প্রার্থনা করো, আমি মনজুর করবো।

স্রষ্টার কাছ থেকে যে ‘তকদীর’ আসে সেটা তো আল্লাহ্‌র তরফ থেকে আসা মেহমান। খাস মেহমান। আমাদের সমাজে শ্রেণী বুঝে মেহমানদের সাথে আচরণ বা মেহমানদারী করা হয়। মেহমানের মর্তবা মেহমানদারীর স্তর নির্ধারণ করে। যে ‘তকদীর’-রুপী মেহমান আল্লাহ্‌র তরফ থেকে আমাদের কাছে আসে তার সাথে বিরূপ বা অসৌজন্যমুলক আচরণ করলে মালিকের কাছ থেকে তো নসীবে ভালো কিছু আসা করা যায় না।

বাদশাহের কাছ থেকে আসা বার্তাবাহকের সাথে করা আচরণই আমার মূল্যায়ন হয়ে বাদশাহের কাছে ফিরে যায় বার্তাবাহকের মাধ্যমে। আমরা জাগতিক কোন পদস্থ বা প্রিয় মানুষের কাছ থেকে আসা বার্তাবাহকের সাথে কেমন আচরণ করি তা সহজেই আমরা বুঝতে পারি। তাহলে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে আসা ‘তকদীর’-রুপ মেহমানের সাথে সুন্দর সৌজন্যমূলক আচরণ করতে পারি না কেন? আর যখন সেই সুন্দর আচরণ করতে পারি না তখন কি আশায় ভালো ‘তকদিরের’ প্রত্যাশা করি?

এজন্যই আল্লাহ্‌ কোরানে পাকে ঘোষণা করেন,” লা এন শাকারতুম, লা আজিদান্নাকুম। অলাইন কাফারতুম ইন্না আজাবি লা শাদিদ। “সুরা ইব্রাহিম, আয়াত-৭।

অর্থাৎ, যদি তুমি তোমাকে দেওয়া নেয়ামতের শোকরগুজারি করো তাহলে আমি তা আরও বাড়ায়ে দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, শোকর না করো, তাহলে জেনে রাখো আমার শাস্তি ভয়ঙ্কর।

তফসিরে জালালাইন এভাবে তফসির করেছে এই আয়াতেরঃ

And  when your Lord proclaimed, (when) He made it known that, “If you are thankful, for My graces, through affirmation of (My) Oneness and obedience (to Me), then assuredly I shall give you more; but if you are thankless, (if) you deny (the truth of) the grace, through disbelief and disobedience, then assuredly I shall chastise you..as is indicated by  (His following words)..My chastisement is indeed severe.”

আল্লাহ্‌র তরফ থেকে আসা মেহমান বা ‘তকদীরের’ সাথে ভালো আচরণ করে আল্লাহ্‌র দেখানো পথে পরিশ্রম করলে নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ তাঁর নেয়ামত বাড়ায়ে দিবেন বে-শুমার।

প্রেরকের কারনেই বার্তাবাহকের সাথে সুন্দর আচরণ করা উচিৎ। বার্তাবাহকের মাধ্যমে প্রেরকের তথা স্রষ্টার সাথে মধুর সম্পর্ক করতে পারলেই মঞ্জিলে মকসূদে পৌঁছানো সহজ হয়ে যায়। তাহলে সেই মহামহিম আমাদেরকে অগণিত সম্পদ সম্ভারে পূর্ণ করে দিবেন।  

আমার এলমে তাসাউফের শিক্ষক মৌলানা ফরিদুদ্দিন আত্তার বলেছিলেন, “মানব মানবীর প্রেম যদি কেউ না বুঝে তাহলে স্রষ্টার সাথে প্রেম বা ফানা ফিল্লাহ থেকে বাঁকা বিল্লাহ কি করে বুঝবে সে?”

মানব মানবীর প্রেমে বিরহী প্রেমিক যক্ষ মেঘকে দুত কল্পনা করে বা বার্তাবাহক মনে করে কেয়াপাতায় প্রেম পত্র লিখে মেঘের মাধ্যমে প্রিয়ার কাছে বিরহ লিপি পাঠানোর আকুল আকুতি জানাচ্ছে। প্রথম আষাঢ়ের পয়মন্ত মেঘ দেখে রামগিরি পাহাড়ে অবস্থানকালে বিরহকাতর শোকে ক্লিষ্ট যক্ষের মনে পড়ে গেলো প্রিয়ার কথা। মেঘকে বার্তাবাহক মনে করে কুরচি ফুলের অর্ঘ্য দিয়ে মেঘকে সম্ভাষণ জানায়ে মেঘের সাথে কথোপকথন শুরু করলো যক্ষ।

মেঘদুতের বাইরে এই বিরহকাতর ছবি নিপুন হাতে এঁকেছেন কাজী নজরুল ইসলামঃ

“যাও মেঘদূত দিও প্রিয়ার হাতে

আমার বিরহ লিপি লেখা কেয়াপাতে।

আমার প্রিয়ার দীর্ঘ-নিঃশ্বাসে

থির হয়ে আছে মেঘ সে দেশের আকাশে

আমার পিয়ার ম্লান মুখ হেরি

ওঠে না চাঁদ আর যে দেশে রাতে।

পাই যে দেশে কুন্তল সুরভী বকুল ফুলে

আমার প্রিয়া কাঁদে এলায়ে কেশ সেই মেঘনা কুলে

স্বর্ণ লতার সম যার ক্ষীণ করে

বারে বারে কঙ্কন চুড়ি খুলে পড়ে

মুকুল বয়সে যথা বরষার ফুলদল

বেদনায় মুরছিয়া আছে আঙিনাতে।  

বার্তাবাহকের প্রতি যদি এমন হয় সাধারণ মানুষের আকুলতা তাহলে সেই পরম স্রষ্টার প্রতি কত অনুরক্ত, কত আনত হওয়া উচিৎ আমাদের!

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *