তামাক হারামের ‘ফতওয়া’।

আজ তামাক মুক্ত দিবস। এ বছরের স্লোগান, “তামাক ছাড়ার সংকল্প”।

তামাকের ভালো মন্দ তাৎপর্য নিয়ে অন্যরা লিখবেন। বিখ্যাত নাট্যকার জে বি ষ পর্যন্ত বলেছিলেন, “একটা সিগারেট হল কাগজে মোড়ানো কিছু তামাক যার এক প্রান্তে থাকে আগুন এবং অপর প্রান্তে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলা এক বোকা।“ এর পরও কি আমাদের অনেকের সম্বিৎ ফিরেছে?

আমি লিখছি অনেকের অজানা গল্প।

কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করে রাজা ফারদিনান্দ ও রাণী ইসাবেলার দরবারে ফিরে আসেন। আসার সময় সেখানকার পশু পাখী, ফল মূল ও অনেক জিনিস নিয়ে আসেন যা ইউরোপ খণ্ডে দুর্লভ ছিল। এর সব কিছু ছিল উপকারী। শুধু দুইটা জিনিস তিনি নিয়ে আসেন যা তখন থেকে শুরু করে অনন্ত কাল পর্যন্ত মানুষের ক্ষতির কারণ।

একটা হচ্ছে সিফিলিস, অন্যটা তামাক।

-সিফিলিস ট্রিপোনেমা প্যালিডাম নামক এক ধরণের জীবাণু দ্বারা সংঘটিত ভয়ঙ্কর আসুখ যা বিশেষ বয়সের খারাপ চরিত্রের মানুষের হয়ে থাকে। এক সময় গাছ গাছড়া থেকে শুরু করে মার্কারি পর্যন্ত ব্যাবহার করা হতো সিফিলিস নিরাময়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিং পেনিসিলিন আবিষ্কার করার পর থেকে এই রোগের চিকিৎসা অনেক সহজ হয়েছে এবং মৃত্যুহার কমেছে।

-তামাক মহামারীর মতো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ তামাকে আসক্ত হয়ে পড়ে। অনেক দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা তৈরি করলেও মানুষ এই তামাকের নেশা এখনও সম্পূর্ণ ভাবে ছাড়তে পারে নি।

অন্য কিছুর জন্য না হলেও তামাকের জন্য মানুষ কিয়ামত তক কলম্বাসকে মনে রাখবে।

ইরান আন্তর্জাতিক বাজারে তামাকের জন্য বিখ্যাত ছিল। এমন কিছু ধরণের তামাক ইরানে উৎপাদিত হতো যা পৃথিবীর অন্য কোথাও উৎপন্ন হতো না।

২০ শে মার্চ, ১৮৯০ সালে ইরানের শাহ্‌ নাসির উদ্দিন শাহ্‌  এক ব্রিটিশ কোম্পানিকে দেশে উৎপাদিত সমস্ত তামাক বিক্রি ও রফতানীর একচেটিয়া অধিকার দিলে ব্যবসায়ী ও ধর্মীয় নেতাদের নেতৃতে তেহরান, তাবরিজে বয়কট ও ধর্মঘট পালিত হয়।

“তুর্কমানচাই সন্ধি” চুক্তির কথা মনে করায়ে দিয়ে রাশিয়া তামাক চুক্তি থেকে ইরানকে বিরত থাকতে বলে কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে প্রায় দেউলিয়া ইরানের এই চুক্তির অর্থের দরকার ছিল।   

১৮৯১ সালে আলী আকবর নামের একজন ধর্মীয় নেতাকে শাহ্‌ এই চুক্তির বিরোধিতা করে আন্দোলন করার অপরাধে বহিষ্কার করেন। আলী আকবর দেখা করেন তখনকার পৃথিবীর অনেক বড় প্রভাবশালী ইসলামী চিন্তাবিদ, প্যান ইসলামিক ধারণার প্রবক্তা জামাল উদ দিন আফগানীর সাথে।  শাহের উপদেষ্টা তখন জামাল উদ দিন আফগানী। প্রতিবাদকারীরা আফগানীর সমর্থন লাভ করে। জামাল উদ দিন আফগানী মীর্জা হাসান সিরাজি নামে একজন শিয়া ধর্মীয় নেতার মারফৎ শাহ্‌কে বোঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু কোন ফল হল না।  

১৮৯১ সালের  ডিসেম্বর মাসে   আয়াতুল্লা হাসান আল শিরাজি ধুমপান নিষদ্ধ করে ‘ফতওয়া’ জারি করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, ধূমপান করা দ্বাদশ ইমাম “ইমাম মেহেদী”র (মোহাম্মাদ ইবনে হাসান আসল নাম) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সমান অপরাধ হবে। এই ‘ফতওয়া’ দাবানলের মতো কাজ করে।

ইরানের ঊলামা সম্প্রদায় ইসলামী স্কুল মাদ্রাসা চালাতো, যাকাত সহ নানা দান সদকার বিশাল অংকের অর্থের দেখাশুনা করতো । অনেক ওয়াকফ করা জমিতে তামাকের চাষ হতো, যে জমি ঊলামা সম্প্রদায়ের নেতৃতে পরিচালিত হতো।  এই চুক্তি অনুযায়ী ওয়াকফ করা জমির আবাদ ও অর্থসমাগম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। নিজেদের স্বার্থেই ঊলামারা চাষী ও বড়ো ব্যবসায়ীদেরকে সাথে নিয়ে এই আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে।  

১৮৯১ সালে কাশাণ অঞ্চলের প্রভাবশালী চাষী মাহমুদ জাঈম এই আইনের প্রতিবাদ স্বরূপ অন্য চাষিদের একত্র করে তাদের সমস্ত উৎপাদিত তামাক পুড়িয়ে ফেলে।  

আন্দোলন সিরাজ, তেহরান, তাবরিজে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

‘ফতওয়া’র আগে ধূমপান এতো ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল যে মানুষ মসজিদের মধ্যেও ধূমপান করতো। ইরানীরা রুটি ত্যাগ করতে রাজী থাকতো কিন্তু ধূমপান না। রমজানে ইফতার করেই যে কাজটা তারা করতো তা ছিল ধূমপান করা। ‘ফতওয়া’ এতো প্রভাব ফেলেছিল যে শাহের হারেমের নারীরা ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিলো। শাহের নফর চাকরেরা তাঁর জন্য তামাক প্রস্তুত করতে অস্বীকার করতো।   

রাশিয়ার হস্তক্ষেপে শাহ্‌ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন।

১৮৯২ সালের জানুয়ারি মাসে শাহ্‌ ফরমান বাতিল করে দেন।

কি অদ্ভুত! এতো আদরের ধূমপান যা খাদ্যের চেয়েও প্রিয় ছিল কখনো কখনো তা একটা ‘ফতওয়া’য় নিষিদ্ধ বা হারাম হয়ে গেলো!!

তামাক নিয়ে একটা কবিতাংশ দিয়ে শেষ করছিঃ

“ওরা বুঝি আমাদের আর সিগারেট খেতে দেবে না;

প্রাণখুলে হস্ত প্রশস্ত করে, ধোঁয়া উড়ানো যাবে না।

চেপে ধরেছে ওরা  আমাদের, ওষ্ঠ দুটি শক্ত করে;

নিঃশ্বাস হতে নিকোটিন সরিয়ে, চলতে হবে কষ্ট করে।“

                                           মুরছালিন উচ্ছ্বাস

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *