তোমার পেশাজীবন ধ্বংসের  ৯ কারণ, যা নিদ্রাহীনতার থেকে জন্মে।

আমরা যারা কর্পোরেট জগতে ক্যারিয়ার গড়তে  কর্মমুখর তারা সকালে শুরু করে অফিসের পরেও কাজ করি। কেউ কেউ আবার বাসায় এসেও কাজে মগ্ন হয়ে পড়ি। কেউ বলি, আমার অনেক কাজের চাপ, কেউ বলি আমি ইভিনিং ম্যান তাই রাত যত গভীর হয় আমার কাজের স্পৃহা তত বাড়ে!

পরিশেষে দেখা যায় ৪-৫ ঘণ্টার বেশী ঘুম হয় না। অ্যালার্ম শুনে ধড়ফড় করে উঠে অস্থির ভাবে তৈরি হয়ে অনেক সময় নাস্তা না করে বা দায়সারা ভাবে করে অফিসে দৌড়াই।

“ ফুরায় দিনের কাজ ফুরায় না রাতি,

শিয়রের দ্বীপ হায়, অভিমানে নিভে যায়

নিভিতে চাহে না নয়নেরও বাতি।“-নজরুল

 এমন হলে পরিণামে পরিণতি অনেক আশঙ্কাজনক হতে বাধ্য।

যে অফিসে কাজ করি তার ফ্যাক্টরির মেশিনের বিরাম আছে, বিশ্রাম আছে, ওভারহলিং আছে শুধু নাই আমার ওভারহলিং।

এর পরিণতি যে কত ভয়ঙ্কর তা এই ব্লগটা পুরো পড়লে বুঝা যাবে। হয়তো আমরা কেউ কেউ সাবধান হবো। কারণ যাদের জন্য এই উদয়স্ত পরিশ্রম তাদের জীবনও যদি আমার এই অনিয়মের কারণে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে তাহলে কি দরকার এই গাধার খাটুনি খাঁটা!

আমাদের সারাদিনের কর্ম ক্লান্তির থেকে একটু বিশ্রাম দেয় নিবিড় ঘুম। মনকে পুনর্জীবিত করে। আবেগকে সঠিক যায়গায় নিয়ে আসে।

ব্রেইন  আমাদের জাগ্রত অবস্থায় স্নায়ুর কর্মকাণ্ডের বাই প্রডাক্ত বিষাক্ত প্রোটিনকে বের করে দেয়। পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ঐ বিষাক্ত প্রোটিন শরীরে থেকে যায় এবং এটা চিন্তার স্বাভাবিক গতি বা ধারাকে ব্যাহত করে যা কোন পরিমাণের কাফেইনই ঠিক করতে পারে না যদিও আমরা ব্রান্ডেড  কফিতে মগ্ন হয়ে ঝরঝরে হতে চাই।

ক্রনিক ঘুমের অভাব তথ্যকে সুন্দর করে সন্নিবেশিত করতে বা সাজাতে পারে না, সৃজনশীলতাকে ধ্বংস  করে,   স্ট্রেস লেভেলকে আরও অসহনীয় করে তুলে, স্মৃতির তথ্য সংগ্রহ ও ধরে রাখতে বাঁধা দেয়।

আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এক পরীক্ষায় দেখায় যে ৩০% শতাংশ উত্তরদাতা যা প্রায় ৪০.৬০ মিলিয়ন আমেরিকান কর্মী ৬ ঘণ্টার কম ঘুমাতে পারেন।

ঘুমকে প্রয়োজনীয় যায়গায় ফিরায়ে আনতে নীচের কাজ গুলো করতে পারঃ

১। অনেক দেরি করে বা অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করো না। যখন বিকেল বা সন্ধ্যায় তুমি বেশী কাজ করো তখন তা তোমাকে উত্তেজিত করে ও সতর্ক অবস্থায় নিয়ে আসে যে সময়ে তোমার আরও রিলাক্স হয়ে ঘুমের প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ। ঘুমের আগে কিছু সময় রিলাক্স করে ভালো ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ।

২। বেলা ৩ টার পর  আর কোন কাফ্যেইন না, সে চা বা কফি যাই হউক না কেন। অনেকে নিজেকে চাঙ্গা রাখতে কাফেইন গ্রহণ করে থাকেন। কাফেইন সূস্থ শরীরে ৭ ঘণ্টা পর্যন্ত অবস্থান করে। সুতরাং সন্ধ্যার কাফেইন তোমার ঘুমের ব্যাঘাত  সৃষ্টি করতে পারে।

অ্যালকোহলও তাই। সাময়িক চাঙ্গা রাখলেও মাঝে মাঝে ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এবং শেষ পর্যন্ত তোমাকে শেষ করে ছাড়বে।

৩। সব ধরনের স্ক্রিন, স্মার্ট ফোন, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ ইত্যাদি নিদিষ্ট সময়ের পর বন্ধ করে দাও। ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ থেকে যে “দৃষ্টি শীতল কারী নীল আলো” বিচ্ছুরিত হয় তা মেলাটোনিন লেভেলকে কমিয়ে দেয় ।   মেলাটোনিন এমন এক ধরনের হরমোন যা ঘুমকে ত্বরান্বিত করে। দীর্ঘদিন ধরে অবদমিত মেলাটোনিন লেভেল কিছু ধরনের কান্সার তৈরিতে সহায়তা করে।

সুতরাং অগুলো বন্ধ করে প্রয়োজনে একটা বই খুলে পড়তে থাকো।

৪। দিনের আলোর কাছে থাকো। গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা অফিসের জানালার কাছে থেকে কাজ করে  তারা ৪৬  মিনিট বেশী ঘুমায়, যারা জানালা ছাড়া অন্য যায়গায় থেকে কাজ করে। দিনের আলো মেলাটোনিন নিঃসরণে সহায়তা করে। দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা প্রাকৃতিক আলোতে কাজ করলে ভালো ঘুম হয়।

৫। নিদ্রাহীনতা নিয়ে চিন্তা করা বন্ধ করো। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের স্লিপ মেডিসিন ডিভিশান দেখিয়েছে, কাজের জন্যে ঘুম ত্যাগ করে স্বল্পকালীন উৎপাদনশীলতা পেলেও তোমার নিদ্রাহীনতার অভিশাপে সে প্রোডাক্টিভিটি ধুয়ে মুছে যায়, তোমার মুড নষ্ট করে, ফোকাস নষ্ট করে এবং সবচেয়ে অলক্ষুণে হচ্ছে আগামী দিনের উচ্চস্তরের ব্রেইন ফাংশানকে বাঁধাগ্রস্ত করে।

৬। দুঃশ্চিন্তা উড়ায়ে দাও। ভালো ঘুম হচ্ছে না এই দুঃশ্চিন্তা তোমার ঘুমকে আরও কমায়ে দেবে। বরং ঘুমাতে যাওয়ার আগে তোমার দুঃশ্চিন্তার কারণ একটা প্যাডে বা কাগজে লিখে রাখো। টু ডু লিস্ট করার অভ্যাস থাকলে করা কাজ ক্রস দিয়ে শেষ করো ও করণীয় কাজের লিস্ট লিখে ফেলো। এতে গুরুত্ব পূর্ণ কাজ ভুলে যাওয়ার দুঃশ্চিন্তা থেকে তুমি রেহাই পাবে।

৭। টি ভি বন্ধ করে দাও। টি ভি না দেখে মেডিটেশান করো বা কোন সফট মিউজিক শোনো বা কোরাণ তেলাওয়াত শোনো যা দুঃশ্চিন্তায় উথাল পাথাল না করে ঘুমের দেশে ডুবে যেতে সাহায্য করবে। ঘুমোতে যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে টি ভি বন্ধ করে দাও।

৮। ঘুম ঘুম ভাব আসলে ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করো। নিদিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়ার চেষ্টা করো। এটা না করলে শরীর আপাতত মেনে নিলেও দীর্ঘমেয়াদে বুদ্ধিবৃত্তিক অবক্ষয় এবং অন্য ঝুঁকিগুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকবে।

৯। সর্বোপরি একটা সুন্দর স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তোলো। ঘুম সুন্দর স্বাস্থ্যের অন্যতম একটা প্রধান অনুষঙ্গ। ঘুমকে বাদ দিয়ে যত স্বাস্থ্যবিধি  মানা হোক না কেন কোন বিধানই তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না।

যখন আমরা গভীর ঘুমে তৃপ্ত হই তখন সব কিছুই ভালো লাগে। আমাদের স্বাস্থ্য, মানসিক যোগ্যতা, চিন্তার পরিচ্ছন্নতা, আমাদের বেঁচে থাকার আনন্দ, পজিটিভ জীবন যাপন করার ইচ্ছা সব কিছু নির্ভর করে ভালো  ঘুমের উপর।  

আল্লাহ্‌ তায়ালা পবিত্র কোরানে ঘুমের প্রয়োজনীয়তার জন্য বলেছেন তিনি দিন’কে কাজের জন্য ও  রাত’কে বিশ্রামের জন্য সৃষ্টি করেছেন।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, শিল্প বিপ্লবের পর আমরা দিন রাত একাকার করে ফেলেছি।

Categories: Career Growth

1 Comment

Mehedi Hasan · February 25, 2022 at 5:42 am

একাডেমিক একটি প্রজেক্টে কাজের দরুন গত দু’রাত নিদ্রাহীনতায় কাটছে। এহেন সময়ে এ ধরনের আর্টিকেল পড়ে মনে হচ্ছে এটা আমার জন্যই লেখা হয়েছে! ধন্যবাদ, স্যার। চেষ্টা করব রাতজাগা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে।

Leave a Reply to Mehedi Hasan Cancel reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *