ফুল নেবো না অশ্রু নেবো,

ভেবে হই আকুল।

আজ প্রেমিক কবি, বিরহী কবি, অভিমানী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৪তম প্রয়াণ দিবস।

বিদ্রোহী কবি হিসেবে তাঁকে আমরা বেশী চিনি কিন্তু বিদ্রোহী এমন এক অন্তর্গত আবেগ যা বিশেষ ক্ষণে ব্যাবরিত হয়, সব সময় না । কিন্তু তার গান, তা সে প্রেমের, বিরহের, দেশাত্মবোধক, ধর্মীয়, উদ্দীপনার যাই হউক না কেন প্রতিনিয়ত গাওয়া হয়, বাজানো হয়।

আটপৌরে করে, বারোয়ারী করে, ঘরোয়া করে যদি কবি নজরুলকে আমরা দেখতে চাই তাহলে তাঁর এই সত্ত্বাকে আঁকড়ে ধরেই পাবো । বিদ্রোহী সত্ত্বা অনেক উঁচু দরের কিন্তু মহার্ঘ্য মণি মানিক্য খচিত অলঙ্কার কালে ভদ্রে আভরণ হিসেবে  পরা হয় কিন্তু আটপৌরে গহনাগুলোতেই মানায় বেশী।

অতৃপ্ত প্রেম আর জঠর জ্বালা নজরুলকে গ্রামোফোন কোম্পানির কাছে বন্দী হতে বাধ্য করেছিলো। প্রেম ভালবাসা প্রত্যাখানের মর্ম জ্বালা, কাঙাল মনের আকুল আকুতি গান হয়ে, সুর হয়ে ইথারে আকাশে উন্মাদের মতো, উদ্ভ্রান্তের মতো হাহাকার করে ছুটে বেড়িয়েছে । ভালোবাসা না পেয়ে, প্রেমে বিফল হয়ে অভিমানী কবি গানে গানে তাঁর অশ্রুমালা গেথে গেছেন । গানের  সুরেই কবি বলেছেন  “সবাই তৃষ্ণা মিটায় নদীর জলে, কি তৃষা জাগে সে নদীর হিয়া তলে, বেদনার মহাসাগরের কাছে করো, করো সন্ধান…ভালোবাসো মোর গান।“

‘চাঁদ আর পারাবার’ এক হয় নি। নজরুল পান নাই কাতর মিনতি করে চাওয়া প্রিয়তমাকে । কেউ অবেলায়  ফিরে এলেও, “এলে অবেলায় পথিক বেভুল, বিধেছে কাটা নাহি যবে ফুল, ……।।হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কুড়াই ঝরা ফুল একেলা আমি’ বলে সরে এসেছেন।

নজরুলের গোপন প্রিয়াদের দেওয়া কঠোর আঘাত সঙ্গীতের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত । তাদের অবদানে এতো সমৃদ্ধ সঙ্গীত পেয়েছি আমরা। আর রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে কবরে নজরুল!!

মাত্র ৮ বৎসর বয়সে মায়ের থেকে আলাদা কিশোর নজরুল । মায়ের আদর ভালোবাসা, স্নেহ মমতা কি তা পান নাই । অনশন ভাঙ্গাতে তাঁর মা জেলের গেটে গেলেও নজরুল মা’ এর সাথে দেখা করেন নাই । এটাই প্রমাণ করে কত অভিমানী, কত ক্ষুদিত ছিল তাঁর অন্তরাত্মা !

দুরন্ত  কৈশোরেই ভালবাসা হীন নির্মম জীবন আর কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে দেখেছেন সমাজের কুৎসিত, নিষ্ঠুর চেহারা। কিশোর শ্রমিক হিসেবে জীবন শুরু করতে হওয়ায় চারদিকের মানুষেরা তাঁকে ব্যাবহারই করেছে। ঠকিয়েছে । আপনভোলা মানুষটা স্বার্থ বুঝতেন না বলে সবাই তাঁকে ব্যাবহার করেছে। কোন এক মরমিয়ার কাছে খুঁজেছেন একটু সান্ত্বনা, একটু প্রেম ভালোবাসা।

বাল্য কৈশোর যৌবনে জঠর জ্বালায় জর্জরিত জীবনের বেলাভূমিতে স্নেহ, মায়া, মমতা,ভালবাসার কাঙাল হয়ে দ্বার  থেকে দ্বারান্তরে অভিমানে ফুঁসেছেন। নাগাল পান নাই মমতার, স্নেহের হাতের ।

কিন্তু পেয়েছেন আঘাত আর বঞ্চনা । সেই বঞ্চনার সাংগীতিক প্রকাশ আমাদের বহু বর্ণীল নজরুল সঙ্গীতে।

হাই স্কুলে পড়ার সময় এক তন্বী- কিশোরীর প্রেমে মুগ্ধ হন। সে ছিল হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে। বেশীদিন টিকে নাই সে প্রেম । সে প্রেমিকার একটা মাথার কাটা সৃতির কৌটায় ভরে নিয়ে করাচী যান চাকরী করতে।

কুমিল্লার সৈয়দা খানম, (নার্গিস) ছিল নজরুলের আর এক  আর্তনাদের  নাম। কুমিল্লার দৌলতপুর গ্রামের নিশুতি নিস্তব্দ পুকুর পাড়ে প্রাণ উজাড় করে বাঁশি বাজালেন। ওই বাঁশিই ছিল তার মনের কথা বলার সহচর । সকালে নার্গিস কবিকে বলল ,”কাল রাতে আপনি বাঁশি বাজায়েছিলেন? আমি শুনেছি ।“ মুগ্ধতা সমর্পণে  রূপ নেয় । সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে ভালবাসেন নজরুল ।

সেটা সেই ১৯২১ সাল। বিয়ে করে আপন করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন । বিয়ে হোল। কিন্তু এক অদৃশ্য অবমাননাকর শর্তের জন্য নজরুল বিয়ে বাড়ি ছেড়ে জোছনা রাতে কাদা মাটি মাড়িয়ে সারা রাত হেটে কুমিল্লায় ফিরে আসেন । ১৬টা  বছর কেটে গেলেও নজরুল তার প্রেম ভুলতে পারেন নাই। নার্গিস চিঠি লিখলে উত্তরে নজরুল লিখলেন সেই অমর বেদনা বিধুর গান,

” যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই, কেন মনে রাখো তারে, ভুলে যাও, তারে ভুলে যাও একেবারে…।

দয়া করো, দয়া করো, আর আমারে লইয়া খেলনা নিঠুর খেলা, শত কাঁদিলেও ফিরিবেনা আর শুভ লগনের বেলা…।“

কুমিল্লায় অসুস্থ নজরুলের সেবার দায়িত্ব পড়ে কিশোরী আশালতা সেনগুপ্ত (দুলি)’র উপর । নজরুল নাম দেন প্রমীলা সেনগুপ্ত। প্রমিলাকে বিয়ে করেন নজরুল । ‘বিজয়িনী’ কবিতায় আমরা দেখি তাঁর প্রেমের প্রকাশ।

“হে মোর রাণী, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে,

আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণ তলে এসে ………”

বিদ্রোহী কবি সম্পূর্ণ সমর্পণ করলেন নিজেকে । কিন্তু সে প্রেম জমাট বাধেনি । সামাজিক কারণে প্রমিলার মা’ গিরিবালা দেবী’কে মেয়ের সাথে থাকতে হয়েছে। একটা নব দম্পতীর সাথে একজন শাশুড়ি ২৪ ঘণ্টা থাকলে  এবং সংসারের খুঁটিনাটিতে নাক গলালে সে সংসার সুন্দর হয়ে উঠতে পারে  নাই । তাঁর পরও নজরুলের সন্তানদের মা, হঠাৎ করে পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে গেলে নজরুল অনেক চেষ্টা করেছিলেন সুস্থ করতে কিন্তু হয় নি ।

তাঁকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন আর একটা অমর গান । বিচক্ষণ সঙ্গীতজ্ঞ নজরুল কিছু ক্ষেত্রে প্রথমে রাগের স্বরলিপি লিখতেন এরপর কথা বসাতেন । এখানেও তাই । লিখলেন,

” তুমি আমার সকাল বেলার সুর, হৃদয় অলস উদাশ করা তন্দ্রা ভারাতুর……

অরুন তুমি, তরুণ তুমি, করুন তারও চেয়ে, হাসির দেশের তুমি যেন বিষাদ লোকের মেয়ে,

তুমি ইন্দ্র সভার মৌন বীণা নীরব নূপুর …”

ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের গণিতের তুখোড় ছাত্রী ফজিলাতুন্নেছাকে গভীর ভাবে ভালো বেসেছিলেন কিন্তু সাড়া পান নি । তার বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেন জানতেন কিন্তু কোন সাহায্য করতে পারেন নাই  । সঞ্চয়িতা উৎসর্গ করতে চাইলে অনুমতি মেলেনি ।  গভীর অনুরাগ একান্তই গোপন ছিল । প্রেম ছিল একতরফা ।

নজরুলের নিজের লেখা চিঠির এই অংশগুলো পড়লে বোঝা যায় কি মর্মবেদনায় কাতর ছিলেন তিনি ।  “বন্ধু, তুমি আমার চোখের জলের মোতিহার। বাদল রাতের বুকের বন্ধু।  আকাশের সবচেয়ে দুরের যে তারাটির  দিপ্তি চোখের জলকণার মতো ঝিলমিল  করবে, মনো করো , সেই তারাটি আমি, আমার নামেই তার নামকরন করো, কেমন?

…।। আঘাত করার একটা সীমা আছে , যেটাকে  অতিক্রম করলে  আঘাত অসুন্দর হয়ে আসে আর তক্ষুনি তার নাম হয় অবমাননা। ছেলেবেলা থেকেই পথে পথে মানুষ আমি। যে স্নেহে, যে প্রেমে বুক ভরে ওঠে কানায় কানায় , তা কখনো কোথাও পাইনি ।    …ক ফোটা চোখের জল দিয়ে এক ফোটা রক্ত হয়, তোমাদের বিজ্ঞান বলতে পারে?  যেদিন আমি ওই দুরের তাঁরার দেশে চলে যাবো, সেদিন তাঁকে বোলো, এই চিঠি রেখে সে যেন দু’ ফোটা অশ্রুর দর্পণ দেয়, শুধু আমার নামে । হয়তো আমি সেদিন খুশিতে উল্কা  ফুল হয়ে তার নোটন খোঁপায় ঝরে পড়বো ……ফুলের কাঁটা ভুলে গিয়ে তার উরধে ফুলের কথাই যেন সে মনে রাখে ……কিটসকে স্বপ্নে দেখছি । তার পাশে দাঁড়িয়ে ফানিব্রাউন পাথরের মতো ।

ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রের মেয়ে উমা মৈত্র ওরফে নোটন । নোটন খোপার কথা অনেক গানেই পাবো আমরা । নোটনকে গান শেখাতেন নজরুলের বন্ধু  দীলিপ কুমার রায়। সেই সুত্রে নজরুলও গান শেখাতে শুরু করলেন । প্রেমে পড়লেন । শিউলিমালা গল্পে যে দাবা খেলার গল্প আছে তা এই নোটনকে  কেন্দ্র করেই । এই নোটনই ঐ গল্পের শিউলি । ‘চক্রবাক’ কাব্যটা নোটনের  বাবার নামে উৎসর্গ করেন নজরুল। প্রথম দিন গান শেখায়ে বর্ধমান হাউসে ফিরে নজরুল রচনা করেন একটা বিখ্যাত গান,

“ আমার কোন কুলে আজ ভিড়ল তরী এ কোন সোনার গায়, আমার ভাটির তরী আবার কেন উজান যেতে চায় ………………………।।

ওগো সোনার দেশের সোনার মেয়ে, তুমি হবে কি মোর নায়ের নেয়ে, ভাঙ্গা তরী চল বেয়ে রাঙা অলকায়।“

কিন্তু কোন রাঙা অলকায়, কোন স্বপ্নলোকে ভেড়ে নাই সে তরী। তিরিশের পরের কবিদের মধ্যের অন্যতম কবি বুদ্ধদেব বসুর সাথে বিয়ে হয় উমা মৈত্রের ।

চট্টগ্রামে হাবিবুল্লা বাহারের বাড়িতে আতিথেয়টা নিয়েছিলেন কবি। ছিলেন শামসুন্নাহারের সান্নিধ্যে। এখানে বসেই রচনা করেন ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’র

“সব আগে আমি আসি, তোমারে চাহিয়া জেগেছি নিশীথ,

গিয়াছি গো ভালোবাসি

তোমার পাতায় লিখিলাম আমি প্রথম প্রণয় লেখা,

এইটুকু হোক সান্ত্বনা মোর, হোক বা না হোক দেখা।  

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু, আর আমি জাগিবনা

কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিব না।

নিশ্চল নিশ্চুপ,

আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ ।“

এই দীর্ঘশ্বাস বিজড়িত লাইনগুলো ।

‘কর্ণফুলী’ ‘শীতের সিন্ধু’ ‘ওগো  ও চক্রবাকী’ ‘বাদল রাতের পাখি’র মতো অসঙ্খ্যা রচনার মধ্যে নজরুলের ক্ষুধিত মনের হাহাকার গুমরে ফেরে ।

নার্গিসকে লেখা চিঠির কিয়দংশ প্রমাণ করে কি বেদনায় মুষড়ে পড়েছিলেন কবি ।

কল্যাণীয়েষু,

পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি এক বারিধারায় প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার । এই মেঘদুত বিরহী যক্ষের বাণী  বহন করে নিয়ে গিয়েছিলো কালিদাসের যুগে, রেবা নদীর তীরে, মালবিকার দেশে, তাঁর প্রিয়ার কাছে। এই মেঘপুঞ্জের আশীর্বাণী  আমার জীবনে এনে দেয় চরম বেদনার সঞ্চার । এই আষাঢ় আমায় কল্পনার স্বর্গলোক থেকে টেনে ভাসিয়ে দিয়েছে বেদনার অনন্ত স্রোতে ।

আমার অন্তর্যামী জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত , কি অসীম বেদনা । কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি, তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি । তুমি এই আগুনের পরশমাণিক  না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না । আমি ‘ধুমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না ……।।“

শুধু ব্য্যাথিত না, মথিত অন্তর নিবেদিত হোল সঙ্গীত নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও তার মধ্যে নিজের মনের তিক্ত গরল উগরে দেওয়া।

হযরত আমীর খসরুর পরে সঙ্গীত নিয়ে এত প্রগাঢ় প্রভাব আর কেউ হয়তো করেন নাই।

উস্তাদ, পথচারী, ভিখারি,মাঝি মাল্লা, রাখাল,রাস্তার কাওয়াল, বেদে সবার কাছ থেকে গোগ্রাসে নিয়েছেন সুর আর তা  ফেরত দিয়েছেন অপরূপ কোন রুপে।   

চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপে বেড়াতে যেয়ে নিয়েছেন ভাটিয়ালী সাম্পানের গান।

কি নিঃশঙ্ক ও দুঃসাহসী ছিলেন নজরুল সঙ্গীত রচনায় তা নীচের এই গানটার রচনা শৈলী দেখলে উপলব্ধি করা যায় ঃ

“সন্ধ্যামালতি যবে ফুল বনে ঝুরে,

কে আসি বাজায় বাঁশি ভৈরবী সুরে”

প্রথম লাইন সন্ধ্যা বেলার রাগ সন্ধ্যামালতি’র  স্বরে তৈরি, দ্বিতীয় লাইন সকালের রাগ ভৈরবী’র স্বরে । এক আশ্চর্য্য মুনশিয়ানায় দুই সময়ের রাগকে এক সুতোয় বেঁধে এক অপরূপ গান রচনা করলেন । 

অনেকগুলো রাগ সৃষ্টি করেন নজরুল এবং কোশেশ করেছেন ওই রাগের গানে রাগের নামের শব্দটা ব্যাবহার করতে। যেমনঃ

রাগ দোলন চাঁপা । গানটা হচ্ছে, “ দোলন চাঁপা বনে দোলে, দোল পূর্ণিমা রাতে চাঁদের সাথে।“ রাগ সন্ধ্যামালতি আর গান,” শোন সন্ধ্যামালতি বালিকা তপতি।“ রাগ উদাসী- ভৈরবী, আর গান, “সতী হারা উদাসী ভৈরব কাঁদে ।“ রাগ নীলাম্বরী আর গান, “ নীলাম্বরী সাড়ি পরি নীল যমুনায় কে যায়, কে যায়।“ রাগ দেবযানী, আর গান “দেবযানীর মনে প্রথম প্রীতির কলি জাগে” রাগ মীনাক্ষী, আর গান “চপল আঁখির ভাষায় হে মীনাক্ষী কয়ে যাও”  রাগ অরুণ রঞ্জনী আর গান “হাসে আকাশে, শুকতারা হাসে, অরুণ রঞ্জনী ঊষার পাশে “ রাগ নির্ঝরিণী, আর গান “রুম ঝুম ঝুম ঝুম কে বাঁজায়”  রাগ রুপমঞ্জরি, আর গান “পায়েলা বোলে রিনিঝিনি নাচে রূপ মঞ্জরী শ্রী রাধার সঙ্গিনী’ রাগ বনকুন্তলা, আর গান “ বন কুন্তল এলায়ে বন শবরী ঝুরে “ ইত্যাদি ইত্যাদি ।

একাধিক রাগের সংমিশ্রণে নজরুল জন্ম দিয়েছেন অপূর্ব কিছু গান। যেমনঃ জয় জয়ন্তি ও খাম্বাজ মিলে “ছাড়িতে পরাণ নাহি চায়” বেহাগ তিলক কামোদ খাম্বাজ মিলে “ কেন কাঁদে পরাণ কি বেদনায় কারে কহি “ কালাংড়া বসন্ত হিন্দোল মিলে “আজ দোল পূর্ণিমাতে দুলবি তোরা আয়” সিন্ধু কাফি খাম্বাজ মিলে”আজি এ কুসুম হার সহি কেমনে” ইত্যাদি ।

নজরুল যে এ বিস্ময়কর সঙ্গীত স্রষ্টা ছিলেন তা এই একটা মাত্র গান বিশ্লেষণ করলে অনুমান করা যায় । রাগ বেহাগ-তিলক-কামোদ-খাম্বাজের মিলনে তৈরি “কেন কাঁদে পরাণ কি বেদনায় কারে কহি। সদা কাঁপে ভিরু হিয়া রহি, সে থাকে নীল নভে আমি নয়ন জল সায়রে”  এর প্রথম চরণে  রাগ তিলক কামোদের ছায়া, দ্বিতীয় চরনে রাগ বেহাগ,তৃতীয় চরণে উর্দু গজলের আমেজ। শেষের দিকে আবার বেহাগ এবং খাম্বাজ রাগ এসে মিলেছে।  

পারশ্যের গজল্ কে  নজরুল বাংলা গানে অনাস্বাদিতপূর্ব ভাবে প্রয়োগ করেছেন। মালিক মজুর  সবার কাছে সমান ভাবে প্রিয় হোল নজরুলের গজল। অভিজাতের ঘর থেকেও শোনা গেল ,”বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল “  কিষানের মুখ থেকেও  ভেসে এল, “কে বিদেশী বন উদাসী বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে, সুর সোহাগে তন্দ্রা লাগে কুসুম বাগের গুল বদনে…”

ইসলামী গানে ‘কাফের’ উপাধি পাওয়া নজরুল আনলেন এমন এক অভিনবত্ব যে এখন “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে” না শুনলে ঈদ শুরু হয় না ।

রাগ ভৈরবীতে, “আল্লাহ্‌ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়” ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর “ বাগেশ্রীতে “বক্ষে আমার কাবার ছবি চোখে মহাম্মাদ রসূল “ ভীমপলশ্রীতে “মোহাম্মাদ  মোস্তফা  সল্লে আলা” ইত্যাদি।

খেয়াল ও রাগপ্রধান গান নজরুলের অকল্পনীয় কৃতিত্ব ।

জয়জয়ন্তী রাগে “ মেঘ মেদুর বরষায়  কোথা  তুমি, ফুল বিছায়ে কাঁদে বন ভুমি…”  আহির ভৈরবে “অরুণ কান্তি কে গো যোগী ভিখারি” খাম্বাজে “ কুহু কুহু কুহু কোয়ে লিয়া, কুহরিল মহুয়া বনে “ কেদারায় “আজো কাঁদে কাননে কোয়ে লিয়া, চম্পা কুঞ্জে আজো গুঞ্জে ভোমরা “  দরবারি কানাড়ায় “ ওর নিশীথ সমাধি ভাঙ্গিয়ো না “

হারানো রাগ রাগিণী পুনরুদ্ধার নজরুলের এক অবিস্মরণীয় অবদান। প্রথমে রাগের নাম, পরে গানের প্রথম কলিঃ রাগ বসন্ত মুখারি,’ বসন্ত মুখর আজি’ রাগ আনন্দি,’দুর বেনুকুঞ্জে মুরালি মুহু মুহু’ রাগ শিব রঞ্জনী ‘হে পার্থ সারথি বাজাও বাজাও পাঞ্ছজন্য শঙ্খ’ রাগ লংকদহন সারঙ ‘অগ্নিগিরি ঘুমন্ত উঠিল জাগিয়া’ রাগ পটমঞ্জরী ‘আমি পথ মঞ্জরী ফুটেছি আঁধার রাতে’ রাগ কর্নাটি সামন্ত,’ কাবেরি নদী জলে কে গো বালিকা’ রাগ নারায়ণী ‘নারায়ণী ঊষা খেলে হেসে’ রাগ সিংহেন্দ্র মধ্যমা ‘ পরদেশী মেঘ যাওরে ফিরে, বলিও  আমার পরদেশীরে’

অসংখ্য প্রেম বিরহের গান নজরুল লিখেছেন যা তাঁর কলিজার রক্তের অক্ষরে লেখা। দুই এক পাতার লেখায় নজরুলের গানের আলোচনা শেষ করা সম্ভব না । শুধু এইটুকু বলবো যে নজরুল যদি গল্প, কবিতা, উপন্যাস লিখতেন তাহলে মহকালের মাদুরে বেশীক্ষণ বসতে পারতেন না। সঙ্গীতে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য অক্ষয় হয়ে রইবে নজরুল অনন্তকাল।

আর নজরুলকে গল্প কবিতা থেকে গানের রাজ্যে অভিষেক করায়েছিল সেই সব নারীরা যাদের কেছে একটু প্রেম ভালোবাসার কাঙাল হয়ে ফিরেছেন কিন্তু আঘাত আর যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই পান নি । স্কুল জীবনের অনামিকা প্রেমিকা, নার্গিস, নোটন, প্রমীলা, ফজিলাতুন্নেসা, শামসুন্নহার, আঙ্গুর বালা, কানন দেবী প্রমুখের কাছে বাংলা গান অকুণ্ঠভাবে ঋণী ।

নজরুলের আকুল আর্তনাদের  দুই একটা উদাহরণ দেওয়া যাকঃ

নিশি নিঝুম ঘুম নাহি আসে, হে প্রিয় কথা তুমি দূর প্রবাসে।……………।।

ফুরায় দিনের কাজ, ফুরায় না রাতি,

শিয়রের দীপ হায়, অভিমানে নিভে যায়

নিভিতে চাহেনা মোর নয়নের বাতি…”

“যখন আমার গান ফুরাবে তখন এস ফিরে

ভাঙবে সভা, বসব একা রেবা- নদীর তীরে ।…………………

ঘুমাই যদি কাছে থেকো হাত খানি মোর হাতে রেখো

জেগে যখন খুঁজবো তোমায় আকুল অশ্রু নীরে …।“

“কবি সবার কথা কইলে এবার নিজের কথা কহ

কেন নিখিল ভুবন অভিমানের আগুন দিয়ে দহ।

কে তোমারে হানল হেলা কবি?

সুরে সুরে আঁক কি গো সেই  বেদনার ছবি।

কার বিরহ রক্ত ঝরায় বক্ষে অহরহ।

কোন ছন্দময়ির ছন্দ দোলে তোমার গানে গানে,

তোমার সুরের স্রোত বয়ে যায় কাহার প্রেমের টানে …”

“জাগো জাগো রে মুছাফির হয়ে আসে নিশি ভোর

ডাকে সুদূর পথের বাঁশি ছাড় মুছাফির খানা তোর

পেয়েছিলি আশয় শুধু পাসনি হেথায় স্নেহ নীড়

হেথায় শুধু বাজে বাঁশি উদাস সুর ভৈরবীর ।“

নজরুলের মুখ নিঃসৃত শব্দ গুলো থেকে তাঁর মনের গহিনের গভীর বেদনা উপলব্ধি করা যায়। নীচের হাহাকার নজরুলকে অনাগত সময়েও চিরস্মরণীয় করে রাখবে।

‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি- আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম- সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *