“পূজারী আমার পুজঁলো আমায় পূঁজা ষোড়শ উপাচারে,
পূজারীকে চিনলাম না মা, পূজা ধূমের অন্ধকারে। “
দোলনচাঁপা, কাজী নজরুল ইসলাম

এই প্রেমের কবিতা ব্যবহারের প্রাসঙ্গিকতা এজন্যে যে, হোমানলে যখন পরিবেশ ধূমায়িত হয়ে ওঠে তখন বাহ্যিক দৃষ্টিতে কিছুই দেখা যায় না। অন্তর্দৃষ্টি দরকার। তৃতীয় নয়ন দরকার।

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার মহিষাশূর বধের মধ্যদিয়ে অকল্যাণ অমঙ্গল রোধে নারী শক্তির মহিমা কীর্তন করা হয়েছে। সৃষ্টি, সংগ্রাম ও বিজয়ের উপাখ্যান দূর্গা পূজার পরতে পরতে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর এই তিন দেবতা-নির্গত তেজঃ- জ্যোতি থেকে দেবী দুর্গার আকার প্রকাশ পায় যা সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় এই ত্রিগুণে সমৃদ্ধ। বিষ্ণুর পালনী শক্তি বৈষ্ণবী, ব্রহ্মার সৃষ্টি শক্তি ব্রাহ্মণী ও মহাদেবের ধংশের শক্তি শিবানী রূপে দেবী প্রকাশিত।

সাধারণ মানুষ দর্শণের মতো কঠিন বিষয় বোঝে না বিধায় পৌরাণিক কাহিনীর মধ্য দিয়ে তাদেরকে দর্শণ-রহস্য বোঝানো হয়।

দেবী সর্বোৎকৃষ্ঠা বলে ‘জয়ন্তী’, জন্ম-মৃত্যু বিনাশিনী বলে ‘মঙ্গলা’,প্রলয়কালে জগৎকে গ্রাস করেন বলে ‘কালী’, সুখদান করেন বলে ‘ভদ্রকালী’, সৃষ্টির কারণকে রক্ষা করেন বলে ‘কপালিনী’, তাঁকে অনেক দুঃখে পাওয়া যায় বলে ‘দূর্গা।’

মহিষাসুর কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ মদ ও মৎস্যৈর্য্য এই ষড়রিপুর রূপক সাকার উপস্থিতি। আমাদের দেহ দূর্গ স্বরূপ। ক্ষিতি- অপঃ-তেজঃ-মরুৎ ও ব্যোম এই পঞ্চভূতে দেহ নির্মিত। ষড়রিপু (মহিষাসুর) আক্রমণ করে প্রাণশক্তিকে। দুর্গতিনাশ করেন দেবী দূর্গা।

মন্ত্রোচ্চারণে বলা হচ্ছে, “যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতাঃ,
নমস্তসৈ নমস্তসৈ নমস্তসৈনমঃ নমঃ।” দেবী সর্বত্র মাতৃরূপে বিরাজমান। দেবী মাতৃ-পিতৃ শক্তি,শান্তি রূপে, বিদ্যা রূপে বিরাজমান।

বরপ্রাপ্ত মহিষাসুরকে কোনো পুরুষ দেবতা বধ করতে পারবে না বিধায় সব দেবতার শক্তি সমূহ একত্রিত করে দেবী দুর্গার সৃষ্টি।
শত শত বৎসর ধরে পুরুষেরা দুর্গতিনাশিনীর পূজা করে আসছেন কিন্তু ঘরে দুর্গার যে প্রতিরূপ নারীশক্তি আছে তাকে স্বীকৃতি দিতে কুন্ঠিত।
পরিস্থিতি বিবেচনা করে নিজেকে নানা অবতারে রূপান্তরিত করেছেন দেবী দূর্গা যা প্রত্যাহিক জীবনে বিম্বিত হয় ঘরের নারীশক্তির মধ্যে যারা প্রতিনিয়ত পরিস্থিতির প্রয়োজনে নিজেকে নানা রূপে উপস্থাপন করেন কিন্তু স্বীকৃতি মেলে না !

দূর্গা যেমন শরীর ও মন উভয় দিক দিয়ে প্রচন্ডভাবে শক্ত তেমনই ঘরের নারীদের মাঝেও দৈহিক ও মানসিক শক্তির উপস্থিতি আছে কিন্তু স্বীকৃতির অভাবে ‘কুণ্ডলিনী’ শক্তির মতো তা দৃষ্টির আড়ালে রয়ে যায়।

সবার সহযোগিতার মাধ্যমে দেবী যুদ্ধে বিজয়িনী হয়েছিলেন। দেবতারা সবাই তাদের শক্তি ও বিশ্বাস দুর্গার উপর রেখেছিলেন, তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন। প্রত্যাহিক জীবনে একজন নারী যদি পসিটিভ ও উৎসাহদাতা মানুষ দ্বারা পরিবৃত্ত থাকেন তাহলে বিজয়ের কোন অসীমে নারী পৌঁছাতে পারে তা অকল্পনীয়।
দেবীর সামনে ভয় ছিল কিন্তু তিনি ভয় না পেয়ে সাহসের সাথে ভয়ের মুখোমুখি হয়েছেন। এমনকি একটা সিংহকে পর্যন্ত বসে এনেছেন। নারীদের কর্মকে ভয় দ্বারা পরিমাপ না করে তাদের বরং চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখী হতে ও বিজয়িনী হতে উৎসাহিত করা উচিত।

দেবী দুর্গার মধ্যে হিংস্রতা ও সহানুভূতি সমভাবে বিরাজমান। ধ্বংস ও সৃষ্টির সবব্যসাচী গুন্। সংসারের নারীদের মাঝেও এই গুন্ বিদ্যমান।

আসল ব্যাপার হচ্ছে নারীর মধ্যের এই গুণাবলীর স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। মানুষের অবচেতন মন ফটোকপি মেশিনের মতো, যা দেওয়া হবে তারই কপি হবে। তুমি দুর্বল, তুমি পারবে না ইত্যাদি শুনতে শুনতে নারীর মাঝের সুপ্ত শক্তিগুলো ডানা মেলতে পারে নাই।

পুরাকালে পৃথিবীর নানা অঞ্চলে নারীরা প্রাধাণ্য পেয়েছিলো কিন্তু ধীরে ধীরে তা অবলুপ্ত। তুলনীয় না হলেও এখনো গারোদের মধ্যে নারীরা অনেক ক্ষমতা পেয়ে থাকে সংসারের ছোট মেয়ে ‘নকমা’ উপাধিতে সম্পদের উত্তরাধিকার পায় বাবা মা’কে দেখাশুনার জন্য।

তিব্বতীয় হিমালয়ের ‘মোসও’ সমাজেও নারীদের কতৃত্ব মেনে চলা হয়। ইন্দোনেশিয়ার ‘মিনানকাবূ’ সমাজেও নারী শক্তির প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। কোস্টারিকা, পানামার ব্রিব্রি, কেনিয়ার ‘উমোজা’ সমাজে নারীদের শক্তিকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

কিন্তু যে আয়োজনে,যে জনসংখ্যার মধ্যে দেবীদুর্গার পূঁজা করা হয় সেই অনুপাতে তো নারী শক্তির মূল্যায়ন হয় না। মাটির তৈরী দেবীর কাছে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করে মঙ্গল কামনা করা হয় আর বিসর্জনের পর ঘরের রক্ত মাংসের নারীকে নিগৃহীত হতে হয় !

দার্শনিক কার্ল মার্কস মাতৃতন্ত্র থেকে পুরুষতন্ত্রে উত্তরণকে উল্লেখ করেছেন, “স্ত্রী জাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়। “

নারীর এই শক্তিকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম,
“জ্ঞানের লক্ষী, গানের লক্ষী, শস্য লক্ষী নারী,
সুষমা লক্ষী, নারীই ফিরিছে রূপে রূপে সঞ্চারী।
পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা, তপ্ত রৌদ্রদাহ
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি সাহস, নিশীথে হয়েছে বধূ
পুরুষ এসেছে মরু তৃষা লয়ে, নারী যোগায়েছে মধু।”

কিন্তু তার বিনিময়ে সে কি কিছু পেয়েছে ? ধীরে ধীরে তার পাওয়ার জায়গা সংকুচিত হয়ে এসেছে।
কেন ?

(তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের ছাত্র হিসেবে আমি চেষ্ঠা করেছি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী দেবী দুর্গার পূঁজা, “দূর্গাপূঁজা” যা আমাদের সমাজে মহা ধুমধামে পালন করা হয়, সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতে। প্রেক্ষাপট এতো বিশাল যে স্বল্প পরিসরে ও স্বল্প সময়ে এটা তুলে ধরা সম্ভব না। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মাচাররের একটা ক্ষুদ্র অংশের উপর আলোকপাত করতে চেষ্টা করেছি। কোথাও ভুল হলে আমাকে দেখায়ে দিলে আমি শিখবো এবং সংশোধন করে নেবো। )

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *