আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিবস । আজ ঈদ-উল –ফিতর । আজ করনাক্রান্ত ক্লান্ত ধরণী । দীর্ঘ তিন মাস মতো আমরা গৃহবন্দী ।
আমি আজ কবি নজরুলের আজন্ম সংগ্রাম ও দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও রাঙা নীলোৎপল হয়ে ওঠার কিছু খণ্ডিত চিত্র তুলে ধরবো । একজন মানুষ কি ভয়ঙ্কর মানসিক শক্তি থাকলে চরম বিপর্যয়ের মাঝেও বলতে পারেন, “আমি তাই করি ভাই, যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা।” যে মানুষটা বলেন “আমি রুষে উঠি যবে মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক, হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া”, সেই মানুষটাই কিশোরী দোলনের কাছে হার মেনে উচ্চারণ করেন, “হে মোর রাণী, তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে, আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে।“
চুরুলিয়া থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের মঙ্গোলকোট থানার মাথরুন নবীন চন্দ্র ইন্সিটিউট-এ ভর্তির সুত্রে নজরুলের জন্ম তারিখ ১৮৯৯ সালের মে মাসের ২৪ তারিখ। বাংলা ১৩০৬ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসের ১১ তারিখ, বুধবার ।
পেট পূরে আহারের ব্যাবস্থা ছিল না পিতৃগৃহে । গ্রামের মক্তব ছেড়ে মাথরুনে যেয়ে লেটো দলের কাজ করেন ও স্কুলে পড়া শুরু করেন। কিন্তু অভাবের কারণে লেখাপড়া ধরে রাখতে পারেন নাই ।
মাথরুন থেকে ফিরে আসেন রানিগঞ্জ । আসানসোল এ । লেখাপড়া ছেড়ে বেচে থাকার তাগিদে ভেসে বেড়িয়েছেন নজরুল । রানিগঞ্জে বাসুদেবের কবি গানের দলে গান গাওয়া ও ঢোলক বাজানো ছিল উপার্জনের মাধ্যম । গান গাইতে দেখে রেলের গার্ড তাঁর বাড়িতে নজরুলকে ভৃতের কাজ করতে নিয়ে যান । কাজ ছিল রান্না করা, রেলের অফিসে খাবার পৌঁছে দেওয়া ও আসানসোল থেকে গার্ডের জন্য মদ কিনে আনা ।
গার্ডের উপর বিরক্ত হয়ে রাণীগঞ্জে যেয়ে স্টেশানের পাশের রুটির দোকানে চাকরি নেন । কাজ ছিল ময়দা মাখা, রুটি বানানো, রুটি সেঁকা ও রুটি বিক্রি করা । রুটির দোকানে কাজ করলেও সেখানে শোবার জায়গা ছিল না । রাত্রে ঘুমাতেন কাছাকাছি এক তিন তলা বাড়ীর সিঁড়ির নিচে । এই বাড়িতেই থাকতেন দারোগা কাজী রফিযুল্লাহ । কাজী রফিযুল্লাহ তাঁকে ১৯১৪ সালের প্রথমদিকে রাণীগঞ্জ থেকে ৩৫০ কিলো মিটার দূরে ত্রিশালের দরিরাম পুর স্কুলে ৭ম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন । ১৯১৪ সালের শেষদিকে নজরুল আবার নিজের এলাকায় ফিরে যান । এরপর রাণীগঞ্জ হাইস্কুল ও শিয়ারশোল রাজ স্কুলে দেখি নজরুলকে ।
১৯১৭ সালের শেষের দিকে সিদ্ধান্ত নিলেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিবেন । সেনাবাহিনীর চাকরি নিয়ে নজরুল করাচী চলে যান । অন্যান্যদের সাথে নজরুলের সঙ্গী ছিলেন ঢাকার নওাব পরিবারের খাজা হাবিবুল্লাহ ও টাঙ্গাইলের রনদাপ্রশাদ সাহা । একসময় দেখা যায় নজরুলের সহকর্মী হলেও রনদা প্রসাদ সাহা নজরুলের দুর্দিনে সহানুভুতি দেখান নি।
যুদ্ধে যাবার অন্যতম একটা কারণ ছিল বিফল প্রেম ও অভিমান । অনুমান করা হয় সে প্রেমিকা ছিল রানীগঞ্জের এক হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তার কন্যা । যাবার সময় প্রেমিকার একটা চুলের কাঁটা সঙ্গে করে নিয়ে যান এবং করাচীর অবস্থানের আড়াই বছর ধরে তা যত্ন করে রাখেন। কলকাতায় ফিরে আসার পরও সে চুলের কাঁটা নজরুলের ট্রাঙ্কে ছিল । কবি “ব্যাথার দান” উপন্যাস সেই গোপন প্রিয়াকে উৎসর্গ করেন এই বলে, “মানসী আমার, মাথার কাঁটা নিয়েছিলাম বলে ক্ষমা করনি তাই আজ বুকের কাঁটা দিয়ে প্রায়াশ্চিত্ত করলাম।”
১৯২০ সালের মার্চে করাচী থেকে কোলকাতায় ফিরে আসেন এবং বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেসে উঠেছিলেন । এর পর ওঠেন কলেজ স্ট্রিটএ মুজাফফর আহমেদের আস্তানায় । লেখালেখি করেন সাওগাত, মাসিক মহাম্মাদি, মোসলেম ভারত, নবযুগ ইত্যাদি পত্রিকায়।
নজরুলের অর্থকষ্টের সুযোগ নিয়ে আফজালুল হক মাসিক ১০০ টাকার চুক্তিতে নজরুলের সব লেখা দাবী করে বসে ও নজরুলকে দেওঘরে পাঠায় কিন্তু নজরুল তেমন কিছুই লিখতে পারে নাই । আলী আকবর খানও টাকা পাঠায় নি । নিদারুণ অর্থ কষ্টে পবিত্র গঙ্গপদ্ধায়কে নজরুল লিখলেন , “টাকা ফুরিয়ে গেছে। আফজাল কিংবা খাঁ যেন শীগগির টাকা পাঠায় । খোজ নিবি আর বলবি আমার মাঝে মানুষের রক্ত আছে । আজ যদি তারা সাহায্য করে তা ব্যার্থ হবে না – আমি তা সুদে আসলে পূরে দেব ।“ মুজাফফর আহমেদ দেওঘরে এসে বাজার করার টাকা দেন এবং বন্ধুর কাছ থেকে টাকা ধার করে দেনা মিটায়ে নজরুলকে নিয়ে কোলকাতা আসেন ।
নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে ভেঙ্গে গেলে নজরুল দৌলতপুর থেকে বর্ষা বৃষ্টি মাথায় করে রাতের বেলা পায়ে হেটে কান্দির পাড় (কুমিল্লা) বিরেন্দ্র কুমার সেন গুপ্ত দের বাড়িতে চলে আসেন । নজরুল প্রায় তিন সপ্তাহ ছিলেন কান্দিরপাড় । আবারও অর্থকষ্ট । এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে ২০ টাকা কুমিল্লায় পাঠান মুজফফর আহমেদ । এর পর সংস্কৃত কলেজের দর্শনের অধ্যাপক ফকিরদাস বন্দোপোধ্যায় কাছ থেকে ৩০ টাকা ধার করে কুমিল্লা যাত্রা করেন মুজাফফর আহমেদ । অভাবের দরুন “ব্যাথার দান” গ্রন্থের সত্ত্ব বিক্রি করে দিয়েছিলেন মাত্র ১০০ টাকায় ।
১৯২১সালের অক্টবর মাসে কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের এক কিশোরী, আশালতা সেনগুপ্ত ওরফে দোলন কবিকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিলো । কুমিল্লা যাওয়ার টাকা নাই । কিন্তু পকেট শূন্য । “রিক্তের বেদন” ও অন্য দুইটি বইয়ের সত্ত্ব বক্রি করে পেলেন ৪০০ টাকা । কুমিল্লায় দীর্ঘদিন থাকেন নজরুল । ডিসেম্বরে নজরুল কোলকাতায় ফিরে আসেন । ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দিন রাত জেগে লিখে ফেলেন তাঁর অবিস্মরণীয় কবিতা “বিদ্রোহী।”
পয়সা তেমন একটা ছিল না । চৈত্র মাসের ১৫ তারিখে ব্যাথার দানের প্রকাসক আফজালুল হককে লিখলেন,”আজই ২০টি টাকা টেলিগ্রাফ মানিঅর্ডার করে পাঠাবেন । বড্ড বিপদে পড়েছি ।কারো কছে চাইতে লজ্জা হয়।”
দুই রাক্ষুশে অভাবে পর্যদুস্থ কবি। এক অর্থের অভাব ।দুই, স্নেহ মমতা ভালবাসার অভাব । আশালতা ওরফে দোলনে ওরফে প্রমীলায় মগ্ন কবি “দোদুল দুল” কবিতায় প্রেয়সীর চলাফেরার মুগ্ধ প্রকাশ করলেন এভাবে:
“কলস কাঁখ পুকুর যায়, আঁচল চায় চুমায় ধুল
দখিন হাত ঝুলন ঝুল, দোদুল দুল
কাঁকাল ক্ষীণ, মরাল গ্রিব
ভুলায় জড়, ভুলায় জীব
গমন দোল, অতুল তুল
মৃণাল হাত, নয়ন পাত
গালের টোল, চিবুক দোল
সকল কাজ, করায় ভুল
প্রিয়ার মোর কোথায় তুল, কোথায় তুল
স্বরূপ তাঁর, অতুল তুল
রাতুল তুল, কোথায় তুল, দোদুল দুল ।“
কৃষ্ণনগরের বাসায় শাশুড়ি গিরিবালা দেবী ও আসন্ন-প্রসবা স্ত্রী আশালতা সেন গুপ্ত ওরফে দোলন ওরফে প্রমীলা । খুলনা-বাগেরহাট- যশোর- বনগাঁ হয়ে বাসায় এসে সংবাদ পান পুত্র সন্তান জন্মের । প্রথম পুত্রের মৃত্যুতে আঘাত পেয়েছিলেন। এবার প্রশান্তি এলো পুত্র সন্তান জন্মের খবর পেয়ে । কিন্তু ঘরে একটি টাকাও রেখে যান নি তিনি । না চিকিৎসার, না সংসার খরচের । পুত্রের মুখ দেখে চিঠি লিখতে বসলেন খান মুহাম্মাদ মইনুদ্দিনকে, ব্রজ বিহারীবর্মণকে, মুরলীধর বসুকে, আর সুবোধ রায়কে । বিষয় একই । “টাকার বড্ড দরকার । যেমন করে পারো ২৫ টি টাকা টেলিগ্রাম মানি অর্ডার করে পাঠাও।”
১৯২৬ সালের ২০শে ডিসেম্বর ব্রজ বিহারী বর্মণকে লেখেন, “অর্থ চিন্তাই সব চেয়ে বড় । কি করে যে দিন যাচ্ছে আল্লাই জানেন । তোমার প্রেরিত ১৫ টাকা পেয়েছি । ২৫ টাকা চেয়েছিলুম । আরও যদি পাঠাতে পারো আমার এই দুর্দিনে, বড়ো উপকৃত হব ।“
কালি কলমের মুরলিধরকে লেখা চিঠির কিছু অংশ, “…… সব জায়গায় ১০ টাকা দেয় আমার কবিতার জন্য । একথা ওদের বোলো । গান দুটি পেয়েই যদি ওরা টাকাটা দেয় তাহলে আমার খুব উপকারে লাগে ।”
৩০শে ডিসেম্বর সওগত পত্রিকার নাসিরুদ্দিনকে লেখেন,” আমি আজ দেউলিয়া হয়ে যেন জীবনের জোয়ার-ভাটা দেখছি শুধু …… । যদি কষ্ট না হয় তাহলে গোটা বিশেক টাকা পাঠালে বড়ো উপকৃত হতুম।”
এই অভাবের মধ্যেই বাংলায় গজল লিখতে শুরু করেন। গল্প দিয়ে করাচী থেকে সাহিত্য জীবন শুরু । এরপর কবিতা । কবিতার কল্পলোক ছেড়ে কবি ধীরে ধীরে গানের জগতে পা বাড়ালেন । অভাব তাঁর অন্যতম একটা কারণ ছিল । তীব্র অনটনে পড়ে হুগলী ছেড়ে কৃষ্ণনগরে বাসা বাধতে বাধ্য হন । কলকাতার আলবার্ট হলে ‘সাহায্য রজনী’ আয়োজন করা হলে নাসিরুদ্দিন টিকিট ছেপে কয়েকজনকে বিক্রি করতে দেন । কেউ কেউ টাকা অথবা টিকিট -বই কিছুই জমা দেন নাই !! যে যেমন করে পেরছে কবিকে স্বার্থে বাবহার করেছে । সেজন্যই কবির কণ্ঠে গুমরে ওঠে “ চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচে…”
কৃষ্ণনগরে দেনায় ডুবে ব্রজ বিহারী বর্মণকে লেখেন “বাজার খরচের পর্যন্ত পয়সা নাই। টাকা না পাঠালে বড়ো বিপদে পড়ব । বহু দেনা করেছি । আর টাকা ধার পাওয়া যাবে না এখানে ।”
আফজালুল হক ও কবি বেনজীর আহমেদ কবির অভাবের সুযোগ নিয়ে অপমানজনক শর্তে ক্রিতদাসের মতো বেধে ফেলেন । প্রতি মাসে ১০০ টাকা দিবেন তারা বিনিময়ে নজরুল তাঁর তাবত লেখা প্রকাশ করার একছত্র অধিকার দিবেন ।
১৯৩০ সালের ৭ই মে কবি পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে মারা যায় । পুত্রের মৃতদেহ সমাহিত করতে ১৩০ টাকা দরকার ছিল কিন্তু কেউই এগিয়ে আসে নি । পরিচিতদের মধ্যে শুধু ডি এম লাইব্রারি ৩৫ টাকা দেয় ।
কবরের জায়গা কেনা, কাফনের কাপড় কেনা, অন্যান্য আনুসাঙ্গিক জিনিসপত্র কেনা । বুলবুল গাড়িতে চড়তে ভালবাসত । কবির ইচ্ছে ছেলের শবদেহ গাড়িতে করে গোরস্থানে নিয়ে যাবেন । কিন্তু টাকা কই ? আগের দিন সন্ধ্যায় বুলবুল মারা যায় । পরদিন প্রায় দুপুরে মৃতদেহ বাসা থেকে নামান হয় । “ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি…”
কবিতা থেকে সরে কবি গানের জগতে ডুবলেন । প্রতিটা গানের সত্ত্ব ২০ টাকায় বিক্রি করতেন । প্রতিটা গানের বিক্রি বাবদ পেতেন শতকরা ২.৫০ টাকা ।
নানা জনের ধার শোধ করার জন্য একজন উকিলের কাছ থেকে বই আর রেকর্ডের সত্ত্ব বিক্রি করে ৪০০০ টাকা ধার করায় নিয়মিত আয়ের পথও বন্ধ ছিল ।
এইচ এম ভি’র সোম বাবুর সাথে কথা বলে নজরুল টাকা চাইলে তিনি ২০ টাকা দেন । নজরুল এইচ এম ভি’র কর্মচারী দশরথের হাতে টাকাটা দিয়ে বল্লেন, “দশরথ, শিগগীর যাও, টাকা কয়টা বাড়িতে দিয়ে এসো । বুঝলে, টাকা নিয়ে তুমি গেলেই তবে বাজারে পাঠানো হবে।”
কবিদের অনেক কবিতাই হয় কল্পনাপ্রসূত । নজরুল “দারিদ্র” কবিতা লিখেছিলেন নিজের জীবনের দুঃসহ দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে ।
“ হে দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান …।
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি ; বাণী ক্ষুরধার
বীণা মোর শাপে তব হোল তরবার!…।
দারিদ্র অসহ,
পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ
আমার দুয়ার ধরি ! কে বাজাবে বাঁশি
কথা পাব আনন্দিত-সুন্দরের হাসি ?
বাথা বিষে নীলকণ্ঠ হয়ে নজরুল যে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি রেখে গেছেন, আমাদের দৈনন্দিন জীবন তো সে সঙ্কটের ধারে কাছেও না । এই দিনে নজরুলকে স্মরণ করা সার্থক হবে যদি আমরা তাঁর মানবতার দর্শন ধারণ করি ও চর্চা করি, যদি তাঁর প্রখর আত্মসন্মানবোধ জাগাতে পারি জীবনে, যদি তাঁর নির্মোহ দৃষ্টিতে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতে পারি চৈতন্যের গভীরে, যদি তাঁর অমলিন ভালোবাসায় জারিত করতে পারি সমাজ সংসার।
যদি তার মতো সমস্ত বৈরিতাকে হাসিমুখে বরণ করে লক্ষে অটল থেকে সামনের দিকে চলতে থাকি তাহলেই নজরুলের জীবন থেকে নেওয়া শিক্ষা সার্থক হবে।
1 Comment
সামি · May 26, 2020 at 11:28 pm
এই লেখাটির লেখক কে জানতে পারি?