নামাজ মুমিনের মে’রাজ। সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত জিব্রাইল আমিনের প্রবেশাধিকার ছিল। এরও পরে আরশে আজিমে আল্লাহ্‌র দিদার লাভ করেছিলেন নবীজী (সা)।
পূর্ণাঙ্গ নামাজ মাটির মানুষকে মে’রাজের মর্তবা দান করে। যে মর্তবা ফেরেশতারও উপরে। এর থেকে নামাজের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। সেজদারত অবস্থায় বান্দা আল্লাহ্‌র সবচেয়ে নিকটবর্তী থাকে। আশ্চর্য্যের বিষয়, সেই সেজদা মাত্র মাথা ঠুকে উঠে আশায় পরিণত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে।

আল ফাতহুর রব্বানি কিতাবে বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী (র) বলেন,” খাঁচার পাখী যেমন করে বের হওয়ার জন্য ছটফট করে, তুমিও তেমনই মসজিদে গেলে বের হওয়ার জন্য ছটফট করো। “ হযরত জাবের (রা) থেকে বর্ণিত,” বান্দা ও কুফরির মধ্যে পার্থক্য হলো “তারকুচ্ছালাত” (নামাজ ছেড়ে দেওয়া) । “(মুসলিম)

নামাজ আদায়ে প্রয়োজন স্রষ্টার দয়ার প্রতি কৃতজ্ঞ হয়ে বিনয়াবনত হওয়া, একাগ্রতা ও মহব্বতের সঙ্গে সপ্তাঙ্গে সেজদা করা। নামাজীর অন্তর হবে আল্লাহ্‌র কাছে জবাবদিহিতার ভয়ে প্রকম্পিত, যা সুরা মুমেনুনে বলা হয়েছে “আল্লাজিনা ফি সালাতিহিম খাশিউন” অর্থাৎ যারা নামাজে বিনয়নম্র।

রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, “নামাজের সময় আল্লাহ্‌ বান্দার প্রতি সর্বক্ষণ দৃষ্টি নিবন্ধ রাখেন, যতক্ষণ না নামাজি অন্যদিকে ভ্রুক্ষেপ করে। যখন সে অন্যদিকে ভ্রুক্ষেপ করে, তখন আল্লাহ্‌ তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন। “(আহমদ, নাসায়ি, আবু দাউদ)
ঊর্ধ্বতন কারো সামনে আমরা ভয়ে থরথর, বিনয়ে বিগলিত হই, আর কুল মাখলুকের স্রষ্টা, রহমতের নেয়ামতের দরিয়ায় আপ্লুতকারী স্রষ্টার সামনে সেজদা করি না, আর করলেও তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করি নামাজ। অথচ এ নামাজে দীর্ঘ একাগ্রতায় নবীজির কদম মবারক ফুলে গেছে, অনড় স্তম্ভ মনে করে মাথার উপর বসতে উদ্যত হছে উড়ন্ত পাখিরা!

হযরত আলী’র (রা) তীরবিদ্ধ যন্ত্রণাময় পা থেকে তীর খোলা হয়েছে নামাজে নিমগ্ন অবস্থায়।বর্তমান কালের অধিকাংশ নামাজের অন্তসারশূন্যতা পর্যালোচনা করলে ‘মুমিনের মে’রাজ না হওয়ার নিগুঢ় অর্থ অনুধাবন করা সম্ভব।

নামাজের অন্তরঙ্গ ও বহিঃরঙ্গের শর্তগুলোর নিবিড় অনুশিলন মানুষকে মে’রাজে’র সমস্তরে পৌঁছে দিতে পারে। পারে অন্যায় ও অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখতে। “ইন্নাস সালাতা তানহা আনিল ফাহসায়ে অল মুনকার।“ নিশ্চয়ই নামাজ অন্যায় ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে। তাহলে অঙ্ক মিলে না কেন??

মসজিদ, মুসল্লি ও নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বেড়েই চলেছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাইনারি হিসেবে বেড়ে চলেছে অন্যায় আর অশ্লীল কাজ। অসুখটা কোথায়?
উত্তর একটাই, যেভাবে নামাজ আদায় করতে বলা হয়েছে সেভাবে নামাজ আদায় করা ও শরিয়তের আদেশ নিষেধের চুলচেরা পাবন্দি করা। নামাজ হতে পারে জান্নাতের চাবি। নামাজ পড়া সত্তেও উপরল্লেখিত অবস্থা অর্জিত না হওয়ার অর্থ নামাজে ত্রুটি।

বহিঃরঙ্গের মধ্যে রয়েছেঃ১। শরীরের পবিত্রতা ২। পোশাক ও নামাজের স্থানের পবিত্রতা ৩। রুযীর পবিত্রতা (হালাল রুযী ছাড়া নামাজ কবুল হয় না) ।
অন্তরঙ্গের মধ্যে রয়েছেঃ১। ইলম বা জ্ঞান ২। ইলম অনুযায়ী আমল বা কর্ম ৩। অন্তরের পবিত্রতা ৪। তাওয়াককুল বা আল্লাহ্‌র উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতা।
সাধারনত বহিঃরঙ্গের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় শর্ত পূরণ হয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। তৃতীয় বা রুযীর শর্তের ব্যাপারে আমরা উদাসীন । কেন এই তৃতীয় শর্ত??

আমরা যে শক্তিবলে রুকু সেজদা করি সেই শক্তির উৎস ভাত, রুটি। এই কার্বো হাইড্রেটের থেকে তৈরি হয় গ্লুকোজ। আমাদের দেহের কোষের মাইটোকোনড্রিয়াতে তৈরি হয় এ টি পি বা এডিনোসিন ট্রাইফসফেট। এই অরগানিক মলিকিউল কোষের যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ টি পি কে ”এনার্জি কারেন্সি অফ দা সেল” ও বলে।
এই ভাত রুটিই আমাদেরকে সমস্ত শক্তি সরবরাহ করে যার দ্বারা আমরা যাবতীয় কর্ম করে থাকি।

এবার এই ভাত রুটির উৎস খোঁজার দরকার। ভাত রুটির পিছনে আছে টাকা। আর এই টাকার পিছনে আছে চাকরী, ব্যাবসা বা কৃষি সহ সব উৎপাদন।
এই চাকরী যদি ঠিকমত না করে, কম কাজ করে নির্ধারিত বেতন নেওয়া হয় তাহলে তা হবে বে-হালাল। তার উপর হবে বান্দার হক বা হক্কুল ইবাদ খেয়ানত করা যা আল্লাহও ক্ষমা করতে পারবেন না বলে দিয়েছেন।

ব্যাবসায় যদি আইন, নীতি নৈতিকতা না মেনে, মানুষকে ঠকায়ে, মানুষের হক নষ্ট করে করা হয়ে থাকে তবে তাও হবে বে-হালাল।
কৃষি থেকে শুরু করে সর্বত্র যদি নীতি নৈতিকতার বাইরে যেয়ে উপার্জন করা হয় তবে তাও হবে বে-হালাল।

এবার এই বেহালাল অর্থ দিয়ে কেনা ভাত রুটি খেয়ে আল্লাহ্‌র সামনে জায়নামাজে দাড়ায়ে যে রুকু সেজদা করা হবে সেই রুকু সেজদাতো পবিত্র হতে পারে না। যেখানে আল্লাহ্‌ বলেন, “ তোমরা পবিত্র জিনিষ ভক্ষণ করো” সেখানে অপবিত্র খাবার খেয়ে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করলে সেই প্রার্থনাতো কবুল হবে না!

এটাই হচ্ছে রুযীর পবিত্রতা হওয়ার শর্তের পিছনের বিজ্ঞান।

সব স্তরের শর্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন করা অত্যান্ত মর্যাদাপূর্ণ কিন্তু কষ্টসাধ্য। ক্রমাগত চর্চার মধ্যদিয়ে নামাজের অন্তর্নিহিত পূর্ণতা প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তা হবে জান্নতের চাবি, অন্যায় অশ্লীলতা দূরকারী এবং মুমিনের মে’রাজ।

“ইয়াকানাবুদু অইয়া কানাসতাইন” আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি- এ অর্থ বোঝার পর সে অনুযায়ী আমল না করে দুনিয়ার প্রভাবশালীদের ও উপায় উপকরণের চিন্তা করলে সে নামাজ তো সত্যিকারের নামাজ হবে না অধিকন্ত ইমাম গাযযালি’র মতে তা শিরকের পর্যায়ে পড়ে যাবে।

উচ্চারিত আয়াতের অর্থ উপলব্ধি করে অর্থ অনুযায়ী আমল করতে হবে। এলেম বিহীন শুধু ভক্তির আমলে বিভ্রান্তির আশঙ্কা বেশী থাকে। সুতরাং অর্থপূর্ণ এলেম অল্প হলেও তা নিয়ে আন্তরিক নামাজ অনেক মুখস্ত এলেম নিয়ে নামাজের চেয়ে বেশী প্রভাবশালী।
আল্লাহ্‌কে সেজদা‌ করে, আত্মসমর্পণ করে, আল্লাহ্‌র উপর নির্ভর না করে নিজেই নিজের ভালো মন্দ, সুখ দুঃখের ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত হলে, ত্রস্ত হলে, উদ্গ্রিব হলে, ব্যাকুল হলে, অস্থির হলে সেজদা বা সমর্পণে কি লাভ?

সম্পূর্ণ সমর্পণে যে অনাবিল আনন্দ, নির্বিকার প্রশান্তচিত্ততা, পরম প্রেমে উদ্বেলিত অন্তরাত্মা, তা অহর্নিশ পাগলের মতো পরশপাথর খুঁজে ব্যাপৃত থেকে অর্জন সম্ভব না।
স্রষ্টা ও সৃষ্টির কর্মের একটা ভেদরেখা আছে। মানুষ কর্ম করতে পারে, কর্ম করা তার দায়িত্ব, কিন্তু ভাগ্যের ব্যপারে ব্যাকুল হতে পারে না। কারণ সেটা স্রষ্টার কাজ। সৃষ্টি যদি স্রষ্টার সীমায় নাক গলাতে শুরু করে তা চরম ধৃষ্টতা ও সীমালঙ্ঘন। আর আল্লাহ্‌ সীমা লঙ্ঘঙ্কারিদেরকে পছন্দ করেন না।

পূত পবিত্র হয়ে স্রষ্টার উপর ভার দিয়ে নিষ্ক্রান্তের মতো নির্ভয়ে চলাই ‘তাওয়াক্কুল’। “তাওয়াককুল অর্থ কর্মহীনতা না বরং কর্মসংকুল ।“

এ অবস্থায় বান্দা নামাজে বিলীন হয়ে এক দেহাতীত নির্লিপ্ত, নিঃশঙ্ক অবস্থায় থাকে। নামাজের মাধ্যমে মে’রাজের মোকামে পৌছা সম্ভব কিন্তু শর্ত হচ্ছে আল্লাহকে চেনা, মানা ও অন্তর–বহিঃরঙ্গের অনুষ্ঠানের হক আদায় করা। নামাজের হক আদায় না করে প্রতিদান চাওয়া বা নামাজের কাছে বেহেস্তের চাবি চাওয়া বোকামিরই নামান্তর।

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *