শিক্ষা দিবসে জগতের সকল আদর্শ শিক্ষকদেরকে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা।

ইহজীবন ছেড়ে যাওয়া আমার শিক্ষক বাবার জন্যও দোয়া করি ।

শিক্ষা যেদিন থেকে ব্যবসার পণ্য হয়ে গেলো সেদিন থেকে জগতের শিক্ষকেরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলেন। এক ধরণের অল্প কিছু শিক্ষকেরা আদর্শ শিক্ষকের নীতি নৈতিকতা, আদর্শ, মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে, আদর্শ শিক্ষকের পতাকা হাতে মেরুদণ্ডী হয়ে রইলেন।

আর এক ধরণের অসংখ্য শিক্ষকেরা শিক্ষাকে পণ্যের মোড়কে মুড়ে অর্থ বিত্তশালীদের পিছু নিলেন বেশী দামে বিক্রি করবেন বলে। মেরুদণ্ডকে মুড়ে জেলিফিশ হয়ে গেলেন!

রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা নিয়ে লেখা দিয়ে শুরু করতে পারি। তিনি বলেন,

“তুমি কেরানীর চেয়ে বড়, ডেপুটি-মুন্সেপের চেয়ে বড়, তুমি যাহা শিক্ষা করিতেছ তাহা হাউইয়ের মতো মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য নহে, এই মন্ত্রটি জপ করিতে দেওয়ার শিক্ষাই আমাদের দেশে সকলের চেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা – এই কথাটি আমাদের নিশিদিন মনে রাখিতে হইবে। এইটে বুঝিতে না পারার মুঢ়তাই  আমাদের সকলের চেয়ে বড় মুঢ়তা। আমাদের সমাজে এ কথা আমাদিগকে  বোঝায় না। আমাদের স্কুলেও এ শিক্ষা নাই। ( রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৩৯৮, ত্রয়োদশ খণ্ড, লক্ষ্য ও শিক্ষা, প্রিশ্তহা-৭০০)

ব্যবসায়ীরা পেয়ে গেলেন ব্যবসা করার অণুঘটক। এইসব শিক্ষকদেরকে পুঁজি করে তাঁরা গড়ে তুললেন স্কুল, কলেজ, ইউনিভারসিটি। অনেকে শিক্ষাকেই ব্যবসা হিসেবে নিয়ে চরম বৈষয়িক সাফল্য লাভ করলেন। হয়ে উঠলেন শিল্পপতি।

যাই শেখানো হউক সেখানে শেষ কথা “প্রফিট  ম্যাক্সিমাইজেশান”, মানবিক গুণাবলী সমৃদ্ধ মানুষ হওয়া না।পরিণতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, লিখতে হবে না।

এই ব্যবসায়ীরা সব ব্যবসায়িদের উপকার করার জন্য কেরানী, কর্মচারী তৈরি করা শুরু করলেন। আমাদের দেশেও কোটি কোটি বেকার থাকার পরও একই ধরণের সিলেবাস নিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রাইভেট ইউনিভারসিটি, যার সংখ্যা এখন শ’এর উপর।

ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকায় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যাল খোলা শুরু হল, এম বি এ নাম দিয়ে ব্যবসা পড়ানো শুরু হল। যার শেষ কথা নেট প্রফিট। ব্যবসা কি বলে? আরো ইউনিভারসিটি, আরো অপ্রয়োজনীয় কেরানী, কর্মচারী। সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য জোগান দেওয়া শুরু হল দরকারি কেরানী, কর্মচারী, কর্মকর্তা।

গ্রামের চাষা থেকে শুরু করে শহুরে মধ্যবিত্ত সংসার সন্তান চালাতে ব্যবসায়িদেরকে আধুনিক জীবন উপকরণের বিনিময়ে কষ্টের উপার্জন তুলে দিচ্ছে। তাদের সন্তানকে লেখাপড়া শেখাতে তার উপার্জন বা ঋণের টাকা নিচ্ছে আবার সেই ছেলে মেয়েকে লেখাপড়া সেখায়ে সস্তায় কেরানী, কর্মচারী বানায়ে মুনাফা মোটা করছেন। এ এক কঠিন দুষ্ট চক্র। অর্জুন পুত্র অভিমুন্য চক্রব্যূহে প্রবেশের শিক্ষা পেয়েছিলো, বের হবার শিক্ষা পায় নাই তাই তাকে জীবন দিতে হয়েছিলো। এ চক্রের শেষ কোথায়? আমাদের যুব সমাজকে কতো ধুঁকে ধুঁকে মরার পর তাদের জীবনে উদ্বিগ্নতার অবসান হবে?

কোচিং বাণিজ্য থেকে শুরু করে বই বাণিজ্য, ষ্টেশনারী কতো কিছু!

দলাদলি, গ্রুপিং করে এদের কেউ কেউ হয়ে গেলেন সমাজের অনেক উচুর কিছু যাদেরকে তেলবাজ ধান্দাবাজ ছাড়া কেউই সন্মানের চোখে দেখে না।

শিক্ষা হচ্ছে এমন এক পেশা যারা অন্য সকল পেশার জন্ম দেয়। কিন্তু সেই শিক্ষক যে তিমিরে, সেই তিমিরেই রয়ে যান। কারো জীবন কৃষ্ণা চতুর্দশীর মতো আবার অনেকেই শুক্লা চতুর্দশীর মতো।

একটা সুন্দর চাইনিজ প্রবাদ আছে। শতাব্দীর পরিকল্পনা করলে ছেলেমেয়েদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে বলা হয়েছে, তবে বর্তমানের এই শিক্ষা না।

“If you are planning for a year sow rice if you are planning for a decade plant trees and if you are planning for a century or lifetime, educate your children.” Chineese proverb.

শিক্ষক মোমের মতো নিজেকে জ্বালায়ে অন্যকে পথ দেখায়। শিক্ষার কাজ পরিবর্তনে উৎসাহিত করা। শিক্ষার্থী উন্নত, সম্পন্ন পরিবার থেকে আসলে শিক্ষকের কাজ “সহজ” হয়ে ওঠে। কিন্তু যদি তা না হয় তাহলে কাজটা আরো “গুরুত্বপূর্ণ” হয়ে ওঠে।

আমাদের বর্তমান শিক্ষকদের কাজ “গুরুত্বপূর্ণ” না হয়ে “সহজ” হয়ে গেছে। আর জটিল থেকে জটিল হয়ে উঠছে আমাদের জীবন।

“তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,

সখিনা বিবির কপাল ভাঙলো,

সিঁথির সিঁদুর মুছে গেলো হরিদাসির।“ শামসুর রাহমান

সে ত্যাগ আমাদেরকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষকের মানবেতর জীবন এবং শিক্ষার এ করুণ দশা কাতবে কবে?

কত ত্যাগ হলে যে আবার শিক্ষিত হবে শিক্ষা! শিক্ষক আবার মেরুদণ্ডী হবে! আনত হবে উদ্ধত মাথা!

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *