১১ই নভেম্বর সোরেন কিয়েরকেগারদের মৃত্যু দিবস।

স্বল্প পরিসরে তাকে তুলে ধরা শুধু অনেক কঠিন না, জটিল এক কাজ। আমি তার মৃত্যু দিবসে তাকে একটু তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।

১৮১৩ সালে কোপেনহেগেনে জন্ম নিয়ে ৪২ বৎসরে লোকান্তরিত হওয়া ক্ষণজন্মা দার্শনিক কিয়েরকেগারদ কিটস, বিবেকানন্দ, সুকান্তের মতো আঁচড় রেখে গিয়েছেন।

তাঁর কাছে জীবনের অর্থ ছিল, to find the idea for which I can live and die.

দর্শন তার কাছে ছিল ব্যক্তির অস্তিত্তের অভিব্যক্তি। তার মতে এই সুক্ষ অনুভূতির স্পর্শকাতর পথটি সচল রাখা উচিত মানুষের। বস্তুজগতের  তীব্র প্রতিযোগিতায়, বিষয়মুখিনতার চাপে এই উচ্ছল ঝরনার ধারা বন্ধ হলে মানুষের আর কিছুই থাকে না।

তিনি হেগেলের মতের বিরুদ্ধে যেয়ে প্রমাণ করেন ‘সামান্য’ ধারনা কখনো ‘বিশেষের’ অস্তিত্তের ভিত্তি হতে পারে না । ইমানুয়েল কান্ট আর কিয়েকেগারদের সুর একই।

পিতৃদত্ত অবসাদের কল্যাণে বাল্যেই যীশুর কষ্টের সাথে পরিচিত হয়ে জানতেন যে সত্য লাভের জন্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। এমন দুর্ভাগ্য তার যে অসুখী থাকাই তাঁর সুখ হয়ে উঠেছিল। ভেবেছিলেন, জীবন হয় উচ্ছৃঙ্খলতায় ডুবে কাটাতে হবে নয়তো আধ্যাত্মিকতায় ।

তিনি ভাবেন, মানুষ এমন এক সৃষ্টি যে দ্বন্দ্ব-মুখর এক বোধ তাঁর ভিতরে কাজ করে নিরন্তর। শরীর আর আত্মা পূর্ণতা অপূর্ণতার সংশ্লেষে মুখর। ইন্দ্রিয়পরায়ণতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে আবার  অনিশ্চয়তার উদবেগাকুলতা তাকে আকুল করে তোলে স্রষ্টার প্রতি আনত আনুগত্য ছিল তার পরম বিশ্বাস। স্রষ্টা যখন কাউকে নির্বাচন করেন তখন তাঁর সম্পর্কে চিন্তা করার অধিকার আমাদের নেই।

অপরাধবোধে পীড়িত ব্যক্তি নীতির পথে আসতে পারে। তবে পরম ঈশ্বর প্রেমে তাকে দুনিয়ার সব কিছু ত্যাগ করতে হবে।

কিয়েরকেগারদের মতে আদম ভয় পেয়ে পাপ করেছিল তাই পতিত আদম সন্তানদের রক্তে ভয়ের সংক্রমণ। তার মতে তিল তিল করে আত্মপীড়নে, নিষ্ঠায়, সংযমে সাধনায় নিজেকে তৈরি করা বা ‘হয়ে-ওঠা’ মানুষের অন্তর্গত অনুধ্যান।

অস্তিত্ববাদের জনক কিয়েরকেগারদ । সক্রেটিস ছিলেন তাঁর উপাস্য। ব্যক্তিকে তার স্বাতন্ত্র্য পরিচয় খুঁজে নিতে হবে। নিজেকে বেছে নিতে হবে অন্তরলীন নিজের ভিতর থেকে। সুন্দর ও অসুন্দরের স্বরূপ এখান থেকেই আসে। নিজের সত্য স্বরূপে পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন বিশ্বাসের ।

এই কর্তব্যভারে মানুষ ন্যুজ। মানুষের মুক্তি এ পথেই।

Anxiety or dread is the presentation of this terrible responsibility when the individual stands at the threshold of momentous existential choice.

কিয়েরকেগারদ যে অস্তিত্ববাদের জন্ম দিলেন তা পরিপুষ্ট হোল

হাইডেগার, জা পল সাত্র প্রভৃতির মধ্যে।

এ পথে পা রাখলেন দস্তয়ভস্কি, মারশেল প্রুস্থ, আল্বেয়ার ক্যামু,  বোদলেয়ার, রিল্কে, এলিয়ট,  আমাদের জীবনান্দ দাস, সুধিন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু।

আল্বেয়ার ক্যামু তার The Myth of Sisyphus-এ এই তত্ত্ব বা মানুষের জীবনের সঙ্কট তুলে ধরেছেন। 

মানুষ কষ্ট পায় তাঁর উদ্দেশ্যহীনতার কারণে । পারিপার্শ্বিকের সাথে তাল হারায়ে উদ্বেগের প্রতীতি জন্ম নেয়।

ভালবাসাও চিত্তচাঞ্চল্যের  প্রতিষেধক হতে পারে নি। মানুষের নিয়তি হচ্ছে কষ্টভোগ ও মৃত্যু। এই অস্তিত্ব সঙ্কট ও মানবিক মর্যাদার মুখোমুখি হয় মানুষ।  

হেমিংওয়ে, দস্তয়ভস্কি, আদ্রে মালরো সবাই একই পথের পথিক। চিত্ত সংকটে   অস্তিত্তের গুরুভার বইতে হোল ।

যেমন জীবনান্দ উচ্চারণ করেনঃ

“ জানি- তবু জানি

নারীর হৃদয় প্রেম-শিশু-গৃহ- নয় সবখানি;

অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সফলতা নয়-

আরও এক বিপন্ন বিস্ময়

আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে

খেলা করে;

আমাদের ক্লান্ত করে-

ক্লান্ত- ক্লান্ত করে।“

অস্তিত্ববাদকে কিয়েরকেগারদ অন্তর্মুখিতা ভেবেছিলেন। ভেবেছিলেন মানুষ হচ্ছে নিজের পক্ষে একমাত্র সঠিক অস্তিত্ব।  

আবার মানুষের অস্তিত্তের ভিতরে লীন হয়ে থাকে বিষণ্ণ দ্বন্দ্ব যা তার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পদ।অস্তিত্ববাদী দর্শনে জীবনের সীমাহীন অর্থশূন্যতার পথে আসে প্রতীক্ষিত ঘটনা, মৃত্যু।

কিয়েরকেগারদ বলেন, ”সত্য হচ্ছে একটা ফাঁদ। এতে ধরা না পড়লে তুমি একে পেতে পারো না। বৈপরীত্য বুদ্ধিজীবীর জীবনের প্রকৃত বেদনা।  এরাই এই প্যারাডক্সের সম্মুখিন হন।

সুধিন্দ্রনাথ দত্তের লেখায়ও ফুটে ওঠে একই সুরঃ

“কি বলে অদৃশ্য হবো ? রেখে যাব কোন প্রতিশ্রুতি ?

মাগিব কি স্মৃতিচিহ্ন ? বিনিময় করিব কি আশা?

অন্তরের অন্তরিক্ষে গুমরিছে মর্তের আকুতি

বিনাশ, নৈরাশ্য, অশ্রু, নিষ্ফলতা, কর্তব্য, পিপাসা।“

তার মতে অস্তিত্ববাদী  সঙ্কটের কারণে তিন ধরণের সমস্যা গড়ে ওঠে অচেতনতা, আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে না চাওয়া, আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়া।

রিলকের লেখায়ও প্রতিধ্বনিত হয় একই নীলকণ্ঠ সুরঃ

“Who, if I cried, would hear me among the angelic

orders?

And even if one of them suddenly pressed me against his heart, I should fade in the strength of his

stronger existence. For Beauty’s nothing

but beginning of Terror we’re still just able to bear,

and why we adore it so because it serenely

disdains to destroy us. Every angel is terrible.”

আত্মার সঙ্কট, নিরাশা এবং সিদ্ধান্তহীনতার জগত আভাষিত হয়, অস্তিত্তিবাদি সুর বেজে ওঠে।

“মহান মেঘ যতই তুমি গর্জো এবং বর্ষ

চাষ বাস করবো না আর

কারণ বিষাদ মূল ছড়াল সমগ্র অস্তিত্তে…।।“

মাত্র ৪২ বৎসর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও এমন নখের আঁচড় রেখে গেছেন যে আজো দর্শনের আলোচনায় সোরেন কিয়েরকেগারদ এক বিশেষ জায়গা দখল করে রাখেন।

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *