“হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব,

ঘোর কুটিল পন্থ তার, লোভ জটিল বন্ধ।“

আজ মানব ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যযজ্ঞের দিন।

আজ হিংসা, জিঘাংসা, প্রতিশোধপরায়নতা, পরাশক্তির উল্লাস প্রদর্শনের দিন।

আগস্টের এই ৬ তারিখে সকাল ৮.১৫ মিনিটে “লিটল বয়” নামের আনবিক বোমা বর্ষণ হয় হিরশিমাতে। নিমেষেই পাঁচ বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংস হয়ে যায়। তখনো জাপান আত্মসমর্পণ করে নাই। তিন দিন পর আগস্টের ৯ তারিখে ১১.০২ মিনিটে নাগাসাকিতে “ফ্যাট ম্যান” নামের আনবিক বোমা বর্ষণ  হয়। হিরোশিমায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার  এবং নাগাসাকিতে চুয়াত্তুর হাজার মানুষ মারা যায়। বোমার বায়ু দূষণ থেকে বাচার জন্য ওখানকার লোকেরা মাস্ক পরতো।

ম্যানহাটান প্রজেক্টের দায়িত্তে রবার্ট ওপেনহাইমার। আইনস্টাইন উপলব্ধি করেছিলেন কি হতে যাচ্ছে পৃথিবীতে। নাজি বাহিনী ক্ষমতা নেওয়ায় আইনস্টাইন জার্মানি ছেড়ে আমেরিকা চলে যান। তার উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণার ফসল আনবিক বোমা। ভীত আইনস্টাইন চিঠি লেখেন আমেরিকার তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের কাছে। কিন্তু কাজ হয় নি।

ইউরোপে ৭ই মে, ১৯৪৫, যুদ্ধ বন্ধ হয়। জাপানকে ২৮শে জুলাই সময় দেওয়া হয় কিন্তু জাপান আত্মসমর্পণ না করায় আনবিক বোমা বর্ষণ করা হয়।

“ক্রন্দনময় নিখিল হৃদয় তাপদহনদীপ্ত

বিষয়বিষবিকারজীর্ণ খিন্ন অপরিতৃপ্ত।“ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

হোয়াইট হাউজের বাইরে ট্রুম্যানের ভাষণ দিলেন, “এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম” । ১৫ই আগস্ট জাপানের সম্রাট হিরোহিতো রেডিওতে ভাষণ দেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বললেন, “আমাদের শেষ শত্রুকেও আমরা শেষ করে দিতে পেরেছি। “

আমেরিকার বিস্ময়কর আবিস্কার ছাড়া এ যুদ্ধ আরও অনেক বছর চলতে থাকতো।

টোকিও উপসাগরে অবস্থানরত ইউ এস এস মিসৌরিতে ২রা সেপ্টেম্বর জাপান আত্মসমর্পণের দলিলে সই করে ।

‘দা নিউ ইয়র্র্কার’ পত্রিকার সম্পাদক উইলিয়াম শন জাঁদরেল সংবাদিক জন হারসি কে দিয়ে লেখাতে চান হিরোশিমার ইতিহাস। হারসি তখন সাংহাইতে। ৪৬ এর মার্চে হিরোশিমা যান।  এই আগস্ট মাসে প্রকাশিত হল “অ্যা নয়েজলেস ফ্ল্যাশ”। পত্রিকার ইতিহাসে এই প্রথম ও শেষ যে “সমস্ত সংবাদ বাদ দিয়ে সব পাতা জুড়ে ছাপা হল রিপোর্টটা।“  বিপুল আলোড়নের ফলে বই আকারে ছাপা হল, নাম “হিরোশিমা”

আমার বাবা চাকরী করতেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কোলকাতা অফিসে। জাপানের পর বার্মা। এর পর টার্গেট কোলকাতা। পরিণতির কথা চিন্তা করে বাবা ছুটি চাইলেন কিন্তু ব্রিটিশ কর্মকর্তা ছুটি দিলেন না। বাবা  কঠিন সিদ্ধান্ত নিলেন। যোগাযোগ বিধ্বস্ত। ৪৩ এর মন্বন্তরের কারণে এই ভূভাগ চূড়ান্ত ভাবে নিঃস্ব।

কোলকাতা থেকে পায়ে হেটে রওয়ানা হলেন। ক্ষুধার্ত আশ্রয়হীন বাবা বারাসাত, বেনাপল, যশোর, নড়াইল হয়ে “ক্লান্ত পথিক এক” হাজার বছর ধরে না হোক পাঁচ দিন পর বাড়ি এসে পৌঁছুলেন।

কোলকাতায় সব ফেলে আসা নিঃস্ব মানুষটা ভগ্নস্তূপ থেকে আবার সৃষ্টির উল্লাসে মাতলেন।

গড়লেন একটা হাই স্কুল। নতুন করে গড়তে দায়িত্ব নিলেন আলিয়া মাদ্রাসার।

তাঁর বাবার কাছ থেকে পাওয়া কিছু জমি থেকে পাওয়া অর্ধেক বর্গা-ফসল, নিজের কিছু উপার্জন এই দিয়ে শুরু করলেন দ্বিতীয় জীবন।

কোলকাতায় না, আমাদের জন্ম ও বড় হওয়া হলো মাগুরা জেলার এক গ্রামে যেখানে সন্ধ্যার আগেই আঁধার নামতো অজস্র মহীরুহ, বন-বনানীর নিবিড় আলিঙ্গনে। আকাশে অজস্র তারাকারা ছায়াপথ বেয়ে “আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী”,  আর ধরায় জোনাকিরা নিকষ কালো আঁধারেও জ্বালাত আশার মিটি মিটি প্রদীপ। জোনাকি ধরতে ছুটোছুটির সময় মনে পড়েছে,

” তুমি নও তো সূর্য নও তো চন্দ্র,

তোমার তাই বলে কি কম আনন্দ

তুমি আপন জীবন পূর্ণ করে আপন আলো জ্বেলেছ

ও জোনাকি, কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ। “

সারা দুনিয়ার সাহিত্য, ধর্ম, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল তাবৎ জ্ঞান ভাণ্ডার দিয়ে আমাদের জীবন পূর্ণ করে তুললেন ওই আমাদের “মিনি শান্তিনিকেতন”। আমাদের বাড়িটাকে আমি বলতাম “মিনি শান্তিনিকেতন” কারণ জ্ঞান ছাড়া আর কোন কথা ছিল না সেখানে।

সেখানে প্রাচুর্য ছিল না। বিলাসিতা ছিল না। ভোগের কল্পনাও করতে শিখিনি। শিখেছিলাম জ্ঞানের প্রদীপ হাতে অন্ধকার জগত আবিস্কার করতে, আলোকিত করতে।    

পার্ল হারবার থেকে হিরোশিমা-নাগাসাকি-সিঙ্গাপুর-বার্মা হয়ে কোলকাতা। কিন্ত না কোলকাতায় আনবিক বোমা বর্ষণ প্রয়োজন হয় নি। সিঙ্গাপুর,বার্মাতেও না। জাপানের আত্ম সমর্পণের মধ্যে শেষ হয় মরণ-খেলা। কিন্তু যুদ্ধের বিভীষিকা একজন মানুষকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলো। কঠিনতর পরিশ্রম করতে হয়েছিলো জীবনকে নতুন করে সাজাতে।

কানে বাজে আল মুজাহিদী’ কবিতাঃ

“হিরোশিমা, তোমার মাটিতে আজ নতুন বৃক্ষের সোপান।

 কুঁড়ি ফোটানর শব্দে পৃথিবীর ঘুম ভেঙ্গে যায়।

তুমি বার বার জেগে ওঠো ধ্বংসস্তূপ থেকে

অঙ্গীকার করো পাখির কুলায় আন্দোলিত দিন রাত্রি।“

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *