আজ ২২শে শ্রাবণ।
৮০ বৎসরের জীবনে ৪০টা মৃত্যু। গড়ে প্রতি দুই বৎসরে একটা মৃত্যু।
বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে উপনিষদীয় দর্শনে জারিত। পারশ্য কবি হাফিজে দেওয়ানা। ইন্দ্রিয়লোকে থেকে এক অতীন্দ্রিয় ভুবনে বাস করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
ধর্মীয় গোঁড়ারা রবীন্দ্রনাথকে জমিদার তনয়, বিলাসী বাবু বলেন যদিও রবীন্দ্র হিমশৈলের চূড়াটিও তারা ছুয়ে দেখতে পারেন নাই। দূর থেকে আভাস দেখেছেন মাত্র।
দুঃখ কষ্ট, যন্ত্রণা, ব্যাথা বিষে নীলকণ্ঠ কবি নীলোৎপলের সৌরভ সৌন্দর্য বিলিয়ে গেছেন অকাতরে। জীবনের এমন কোন দিগন্ত নাই যা নিয়ে তিনি আশার বাণী শোনান নাই। তাইতো, প্রতিটা ক্ষেত্রে নিদানের স্নিগ্ধ পরশ পেতে সবাই রবীন্দ্রনাথে মগ্ন হয়।
মা বাবার পর সবচেয়ে কাছের যাদেরকে হারিয়েছিলেন তারা হচ্ছেনঃ
১৮৮৪ সালে বৌদি কাদম্বরী দেবী। ১৯০২ সালে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। ১৯০৩ সালে মেঝ মেয়ে রেনুকা। ১৯০৭ সালে পুত্র শমিন্দ্রনাথ। ১৯১৮ সালে বড় মেয়ে মাধুরিলতা (বেলা)।
মৃণালিনী দেবি যখন মারা যান তখন কবির বয়স তখন ৪১। রেনুকা, মাতৃহারা মেঝ মেয়েটা বড় নেওটা ছিল বাবা রবীন্দ্রনাথের। মৃত্যু পথযাত্রী মেয়ে বাবার হাত ধরে আছে। বাবা থাকলে ভয় নাই। বাবার হাত ধরে পরপারের পথে। ভগবান রুপী বাবার হাত ধরে অদৃশ্য ভগবানের কাছে যেতে এতটুকুও চিন্তা নাই মেয়ের।
ছোট ছেলে শমিন্দ্রনাথ মুঙ্গেরে কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মাতৃহারা ছেলেকে আগলে ধরেছিলেন কবি। রাখতে পারেন নাই। স্ত্রী, কন্যা, পিতার শেষ শয্যায় তিনি থেকেছেন কিন্তু শমীর শেষ বিদায়ে বাবা ঘরে ধ্যানস্ত। মানব জীবনের অনেক অসীমে এক অন্তর্মুখী সাধক! আঘাতের স্রষ্টাকে লিখলেন,
“আরও আঘাত সইবে আমার সইবে আমারও,
আরও কঠিন সুরে জীবন তারে ঝংকারো।“
স্ত্রীর স্মরণে লিখলেন,
“আজিকে তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া রব দুয়ারে, রাখিব জালি আলো
তুমি তো ভালো বেসেছ, আজই একাকি শুধু আমারে বাসিতে হবে ভালো।“
বউদিকে স্মরণ করে লেখা,
“তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হবো নাকো পথ হারা।
…………………………………………………………
কখনো বিপথে যদি ভ্রমিতে চাহে এ হৃদি
অমনি ও মুখ হেরি শরমে সে হয় সারা।“
অবলা বসুকে লিখলেন,”ঈশ্বর আমাকে যাহা দিয়াছেন,তাহা তিনি গ্রহণ করিয়াছেন,। তাহা শিরোধার্য করিয়া লইব।আমি পরাভুত হইব না।“
জগদীশ বসুকে লিখেছেন, ”আমাদের চারিদিকে এত দুঃখ, এত অভাব,এত অপমান পড়িয়া আছে যে নিজের শোক লইয়া অভিভূত হইয়া এবং নিজেকেই বিশেষ রুপ দুর্ভাগ্য মনে করিয়া পড়িয়া থাকিতে আমার লজ্জা হয়।“
“সংসারে কোন ভয় নাহি নাহি” “প্রচণ্ড গর্জনে আসিল একই দুর্দিন” “বিপুল তরঙ্গ রে” এমন অগণিত সৃষ্টি তিনি করে গেছেন প্রতিটা আঘাত নীরবে সয়ে।
শমীর মৃত্যুর পর একটু ধাতস্ত হয়ে বোলপুরে যাচ্ছিলেন ট্রেনে। টল টল জলে টইটুম্বুর কবির চোখ। আদিগন্ত প্লাবিত বাধহারা জোস্নায়। কবি লিখলেন,
“আজ জোস্না রাতে সবাই গেছে বনে,
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে,……
যাব না গো, যাব না যে,
রইনু পড়ে ঘরের মাঝে
এই নিরালায়,
এই নিরালায় রব আপন কোণে।“
মরণকে এত আপন করে নিয়েছিলেন যে এই ঋষি কবি মরণের সাথে পেলেন খোদ মরণ স্রষ্টা ঈশ্বরকে, আঘাত দিয়ে সে জীবন দেবতা বসে রইলো না, তিনি নেমে এলেন সাথে সাথে,
“তোমার আঘাতের সাথে নেমে এলে তুমি”- মৃত্যুঞ্জয় কবিতার লাইন।
“আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে।
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ , তবু অনন্ত জাগে।
তবু প্রাণ নিত্যধারা, হাসে চন্দ্র সূর্য তারা
বসন্ত নিকুঞ্জ আসে বিচিত্র রাগে।“
তাইতো,বিপদে, আপদে, দুর্যোগে, দুর্বিপাকে অভয়বাণী শোনা যায় রবীন্দ্রনাথে।
0 Comments