লিডারশীপ-৩
লিডারশীপে যখন টীমের সদস্যদের উপর শক্তি, ক্ষমতা আর দমন-পীড়ন আসেঃ
অনেকেই চাকরীতে অহোরাত্র কঠিন পরিশ্রম করে শুধু নিজের উপযুক্ততা প্রমাণ করতে। তারা একদিকে নিজেদেরকে ক্ষমতাবান দেখতে চায় অন্যদিকে উৎসুক থাকে দেখতে যে অন্যরাও তাকে শক্তিশালী মনে করে। তারা তাদের শক্তির সামনে বাধা বিপত্তি, চ্যালেঞ্জকে উড়ায়ে দিয়ে তাদের ক্ষমতার প্রচণ্ডতার প্রচার দেখতে চায়।
মিটিং-এ নিত্য নব নব উদ্ভাবনী আইডিয়া উপাস্থাপন করে নিজেকে পদের উপযুক্ত প্রমাণে সদা শশব্যাস্ত থাকে। কোন চ্যালেঞ্জকে সবার আগে নিজেই মোকাবেলা করে, নিজে দীর্ঘ ঘণ্টা ধরে অফিসে কাজ করে নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করতে অস্থির থাকে।
যদিও তারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন তবুও তারা নিজেদের ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ প্রমাণে তৎপর হয় না অথচ অন্যের মধ্যে, বিশেষ করে লিডারের মধ্যে সবার আগে যে জিনিসটা দেখা হয়, খোঁজা হয় তা হল ‘বিশ্বাসযোগ্যতা।‘
নুরেম্বারগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অরগানাইজেশনাল সাইকোলজিস্ট আন্দ্রেয়া আবেলে গবেষণা করে দেখায়েছেন যে,কম্পিটেন্স-রিলেটেড স্কিল (যেমন টাইম ম্যানেজমেন্ট) ও উষ্ণ-আন্তরিকতা-রিলেটেড স্কিল (যেমন সামাজিক সহযোগিতা) এর মধ্যে কোন একটা বেছে নিতে সুযোগ দিলে অধিকাংশ প্রশিক্ষণার্থী নিজেদের জন্য কম্পিটেন্স-রিলেটেড স্কিল বেছে নেয় আর অন্যদের জন্য অন্য স্কিলটা রেখে দেয়।
অন্য একটা গবেষণায় দেখা যায় যে, অংশগ্রহণকারীদেরকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় কোন ঘটনা তাদের ‘ব্যাক্তি-ইমেজ’ গঠনে বেশী প্রভাব ফেলেছে তখন তারা তাদের কম্পিটেন্স-রিলেটেড স্কিলের কথা উল্লেখ করে। যেমন, “আমি প্রথম পরীক্ষায়ই আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়েছি।“
কিন্তু কম্পিটেন্স-রিলেটেড স্কিলকে সবার উপর স্থান দিলে লিডারশীপকে অবমাননা করা হয়। কারণ বিশ্বাসযোগ্যতার শক্ত ভিত ছাড়া টীমের মানুষ লোক দেখানো ভাবে লিডারকে মানবে। অফিসের বাইরে খুব কমই তাকে মানবে।
বিশ্বাসযোগ্যতা বিহীন প্রতিষ্ঠানে এক ধরণের কালচার তৈরি হয় যেখানে “every employee for himself” জাতীয় আত্ম-সুখ-স্বার্থপরতার চলন তৈরি হয়। প্রতিটা মানুষ তার তার নিজ নিজ স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই চিন্তা করতে পারে না।
এমন পরিবেশে একজন অন্যজন কে সাহায্য সহযোগিতা করতে কুণ্ঠিত থাকে এই ভেবে যে তাদের কাজ কি স্বীকৃতি পাবে বা তারা কি তেমন কোন প্রতিদান পাবে?
ফলাফলঃ প্রতিষ্ঠান শিকার হয় এক করুণ ট্রাজেডির ।
ক্ষমতা দিয়ে আর সব হলেও লিডারশীপ হয় না এ যুগে। মেকী আনুগত্যের ঝকঝকে ছবির অন্তরালে থাকে এক বিষাদ-করুন আর্তনাদ। লিডার যদি সেই ভাষা বুঝতে না পারে তাহলে বিপর্যস্ত পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকাই ভালো।
কারণ, অনেক টীম মেম্বারদের মাঝে বাস করে একটা শিশু, একটা ভবিষ্যতের লিডার, একটা স্রষ্টা। সে সন্মান জানাতে জানে, অভিবাদন জানাতে জানে কিন্তু জানে না শুধু হাত কচলাতে আর মেরুদণ্ড বাঁকা করতে।
আর যারা হাত কচলাতে জানে তাদের দিয়ে কাজও হবে না আবার নিজের পরবর্তী উত্তরসূরিও হবে না। সেই মেরুদণ্ডহীন জেলিফিশকে ঘাড়ে করে বইতে হবে আপনাকেই।
মেরুদণ্ডী টীম মেম্বেররা ইভগেনি ইয়েভতুশেঙ্কোর মতো উচ্চারণ করে মনে মনেঃ
“চাই না মাথা নত করতেদেবতাতুল্য কারও সামনেকিংবা গোঁড়া ধর্মবিশ্বাসীদের গির্জায়আনন্দে মত্ত হতে,
বরং চাইবৈকাল হ্রদের গভীরে ঝাঁপ দিয়েভেসে উঠতেঅন্য কোথাও;মিসিসিপিতেই বা নয় কেন? (চলবে)

লিডারশীপ-২
লিডারশীপে ভয় ও ভালবাসা কার ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী?ভয় দিয়ে সাময়িক সফলতা আসতে পারে তবে তাকে সফলতা না বলে সাময়িক কাজ উদ্ধার বলা যেতে পারে।
কারণ ভয় জ্ঞানের স্ফুরণের সম্ভাবনাকে অবদমিত করে। সৃজনশীলতা, সমস্যার সমাধানের স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশকে বাধাগ্রস্থ করে। এমনকি সহকর্মীকে স্থবির করে দিতে পারে এবং বাংলা সিনেমায় ভিলেনকে বলা নায়িকার ডায়ালগের মত,”শয়তান দেহ পাবি, মন পাবি না” র মতো সহকর্মীর কাজে মনঃসংযোগ ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী।
ভয়কে “হট ইমশন” বলে যার প্রভাব অনেক সুদূরপ্রসারী। এটা আমাদের স্মৃতিকে এমনভাবে কাবাব করে যা “কুল ইমশন” করতে পারে না। জ্যাক জেঞ্জার ও জোসেফ ফকম্যান ৫১,৮৩৬ জন লিডারের উপর গবেষণা করে দেখায়েছেন যে ৫৬ জন মাত্র লিডার হিসেবে সহকর্মীদের পছন্দের তালিকায় উঠতে পেরেছেন। অর্থাৎ একজন ম্যানেজার যাকে সহকর্মীরা অসম্ভব অপছন্দ করে তার ভালো লিডার হিসেবে বিবেচিত হওয়া ০.১১% মাত্র যা এমনকি এক শতাংশও না।
বর্ধিষ্ণু গবেষণা মানুষকে প্রভাবিত ও পরিচালিত করতে উষ্ণ আচরণের পক্ষে ভোট দিচ্ছে। প্রভাবিত করার মূল সুত্র হিসেবে উষ্ণ আচরণকে প্রভাবক হিসেবে বিবেচনা করছেন তারা। উষ্ণ আচরণ, আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যাবহার বিশ্বাস অর্জন করতে, ভালো যোগাযোগ ঘটাতে এবং কোন আইডিয়া অনুধাবন করতে সহায়ক হয়।
এমনকি কিছু অব্যাক্ত সঙ্কেত যেমন একটু হ্যাঁ বোধক মাথা ঝাঁকুনি, স্মিত হাসি, একটু উদার খোলামেলা আচরণ মানুষকে ইঙ্গিত দিতে পারে যে তুমি তার উপর খুশি, তার বিষয়ে যত্নশীল।
উষ্ণ আচরণের উপর গুরুত্ব আরোপ করে তুমি তোমার চারিপাশের সবার সাথে আত্মিকভাবে যুক্ত হতে পারো দ্রুত। সহকর্মীদেরকে গুরুত্ব দিলে, মর্যাদা দিলে তারা উপলব্ধি করবে যে তুমি তাদের কথা শুনছো, তাদেরকে বুঝছো এবং তারা তোমাকে বিশ্বাস করতে পারে।
যে সহকর্মীরা তোমার উপস্থিতি/অনুপস্থিতিতে তোমার উপর অর্পিত কাজ করে যাচ্ছেন, তোমার অর্জনের জন্য, তোমার সাফল্যের জন্য দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন তাদের সাথে যদি ভালো সম্পর্ক তৈরি না হয়, যদি আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি না হয় তাহলে তুমি কিভাবে নিজের সাফল্য আশা কর?
ভয় দিয়ে সরাসরি কিছু কাজ কখনো কখনো করানো যায় তবে ভালবাসায়, স্নেহ মমতার বন্ধনে যে কাজ করানো হয় উপস্থিত/অনুপস্থিত সব অবস্থায় সমান গুরুত্ব ও সতর্কতার সাথে তার শ্রেষ্ঠটুকুই সম্পাদিত হয়।
“জানবে না কেউ কোন তুফানে, তরঙ্গ দল নাচবে প্রাণে চাঁদের মতো অলখ টানে জোয়ারে ঢেউ তোলাবো।আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলবো নাগো, গান দিয়ে দ্বার খোলাবো”-রবীন্দ্রনাথ

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *