চতুর্থ শিল্পবিপ্লবঃ আর “ক ফোঁটা চোখের জল ফেলেছো”
আমদের অধিকাংশের জীবনে সুনিদিষ্ট কোন লক্ষ্য থাকে না। প্রাকৃতিক নিয়মে জন্ম নেওয়ার মতো, বড় হওয়ার মতো, প্রাকৃতিক ভাবে বাবা মায়ের সংসারে উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া জীবনমান যাপন করি। উচ্চবিত্তের জীবন হলে তাকেই নিজের বলে ভুল করি (কারণ ওটা তো বাবা মায়ের অর্জনের ফসল), নিম্ন বিত্তের জীবনমান হলে বাবা মাকে উদয়স্ত কথা শুনাতে বা অপমান করতে ছাড়ি না অনেকে, যা চরম অপরাধ!
জীবনের কোন লক্ষ্য নির্ধারণ নাই। শিক্ষা, অভিজ্ঞতা বা দক্ষতা অর্জনে অচপল কোন নিরন্তর প্রচেষ্টা নেই।
আছে শুধু মহা মুল্যবান সময়ের নিদারুণ অপচয়। বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে চাই না আমরা। বাবা চাচা ভাই বন্ধুকে দেখে শিক্ষা নেই না যে একটা টাকা উপার্জন করতে কতটা পরিশ্রম করতে হয়। শুধু সকাল সন্ধ্যা আকাশ কুসুম স্বপ্ন দেখা যার অর্জনের কোন ভিত্তিই নাই।
সমাজ,পরিবেশ, ইন্ডাস্ট্রি, একডেমিয়া সব কিছু পর্যবেক্ষণ করলে উপলব্ধি করা যেতো বাস্তবতা কাকে বলে। আমাদের দেশের বাবা মায়েরা সাবালোক হলেও সন্তানকে ছোট্ট বাবু করেই রাখে ইউরোপ আমেরিকার মতো সাবালোক হলে বলে না, “There is no free lunch.” তোমারটা তুমি উপার্জন করে নাও। আমাদের এখানে ছেলে ছাত্র অবস্থায় প্রেম করে বিয়ে করে ফেললে বাবা মায়েরা প্রথমে বৌমা’র ভরন পোষণ করেন। কিছুদিন পর নাতি-নাতনীর ডায়াপার থেকে শুরু করে সব কিছুই নিজেদের ঘাড়ে তুলে নেন। ছেলে তখনও চাকরি খোঁজে!
এমন তো কথা ছিল না।
আসলে গত দুই প্রজন্ম ধরে অভিভাবকেরা সন্তানদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে ও নিজেদের জীবনের দুঃসহ কষ্ট থেকে সন্তানদেরকে রক্ষা করতে উদয়স্ত পরিশ্রম করেন। তাদেরকে দিয়ে কিছুই করান না। ফলে সন্তানেরা বাস্তবতার কিছুই টের পায় না, আর পেলেও গা বাঁচাতে এড়ায়ে চলে।
পরিণামে যে দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি হয় তা আমরা প্রতিনিয়ত সমাজ সংসারে দেখছি।
একটা উদাহরণ দেইঃ
ফরাসী শিল্পী পিঁয়ের অগুস্ত রেনোয়া ছিলেন গরিব দর্জির ছেলে। তের বৎসর বয়সে অভাবের তাড়নায় স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়ে কাপ-গেলাস-ফুলদানিতে ছবি আঁকার চাকরি নেন।
আজকাল যেমন আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা আলোচনা করি, তখন শুরু হোল ছাপাখানার যুগ। একটা একটা করে হাতে ছবি আঁকার পরিবর্তে হাজার হাজার কাপ-গেলাসে ছবি আঁকা হয়ে যাচ্ছিল। কোম্পানিটা বন্ধ হয়ে গেলো। কাজ হারালেন রেনোয়া।
এই বেকারত্ব রেনোয়াকে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সত্যিকারের শিল্পী হওয়ার সুযোগ এনে দেয়। হতাশ না হয়ে উঠে পড়ে লেগে গেলেন রেনোয়া ।
সুনাম, যশ আসা শুরু করলো। আসলো অর্থ। উচ্চবিত্তের জীবন। তবুও “প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন, তবু প্রাণ কেন কাঁদে রে…।” ঘুরতে বের হলেন আলজেরিয়া, ইতালি। আঁকলেন “আলজেরিয়ায় মুসলমান উৎসব” বা “আলজেরিয়ানদের সাজে ফরাসী রমণী”
দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন রেনোয়া । অঢেল অর্থ। খ্যাতি। দক্ষিণ ফ্রান্সে ঢাউশ বাড়ি।
দুর্ঘটনায় আরথ্রাইটিসের ব্যথায় কুঁকড়ে গেছেন। ডান হাত নাড়াতে পারতেন না। কিন্তু তাঁর সাধনাকে থামতে দেন নাই। সাধারণ মানুষ যা কল্পনা করতে পারে নাই সেই কল্পনাতীত পথে চালিয়ে গেছেন নিজের কাজের নেশা।
যেহেতু হাতের আঙ্গুল অচল তাই তিনি উদ্ভাবন করলেন এক একলব্যিয় সাধন পথ। ডান হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ছবি আঁকার ব্রাশ কাপড় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিয়ে বাহু ঘুরারে ঘুরায়ে ছবি আঁকতেন। যন্ত্রণায় নীল হয়ে যেতেন। কুঁকড়ে যেতো মুখাবয়ব। তবুও পরাজয় মেনে নেন নাই রেনোয়া ।
অনেক শুভাকাঙ্খি বলেছেন, এত কষ্ট করে ছবি আঁকার কি দরকার। রেনোয়া উত্তরে বলেছিলেন, ”জীবনের সব যন্ত্রণা এক দিন শেষ হয়। কিন্তু শিল্প থাকে।”
রেনোয়ার মৃত্যুর এক বৎসর আগে আঁকা স্নানরতাদের ছবি। ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামে শোভা পাচ্ছে। সারা বৎসর পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে সেই ছবি দেখে আপ্লূত হন, মনে মনে গেয়ে ওঠেন, “তুমি কেমন করে জ্ঞান করো হে গুণী, আমি অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি।”
কতজন আমরা এমন দুঃসহ যন্ত্রণা সয়ে সাধনমার্গের চূড়ায় উঠতে অটল ছিলাম?
রেনোয়ার এই উদাহরণ শুধু এজন্যই দেওয়া যে একজন মানুষ যদি একবার কঠিন সংকল্প করে বসে এবং সেই অনুযায়ী কাজ করে চলে তবে মহাকাল তাকে সফলতার মুকুট পরাতে বাধ্য।
আসুন আমরা জীবনের লক্ষ্য ঠিক করি। কত দিনে সেই লক্ষ্যে পৌঁছেতে হবে সেই সময় নির্ধারণ করি। নিজেকে দক্ষ করে গড়ে তুলি। কঠিন সাধনার সাথে ধৈর্য ধরে লেগে থাকি। সফলতা আসবেই।
“যদি পণ করেই থাকিস, সে পণ তোর রবেই রবে,
ওরে মন হবেই হবে।”- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
0 Comments