হতাশ হইয়ো না। তোমার জীবনে পরিবর্তনের ধারা শুরু করার উপমা হিসেবে এক মনীষীর জীবনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছি।
দক্ষিন আফ্রিকা পৌছার এক সপ্তাহ পরে দক্ষিন আফ্রিকার “আসল চেহারা” গান্ধীজীর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।
সারা রাত ট্রেনে ভ্রমণ করে ডারবান থেকে প্রিটোরিয়া যাচ্ছেন ইংল্যান্ড থেকে পাস করা ব্যারিস্টার মোহনলাল করমচাঁদ গান্ধী।
৪০ বৎসর পরেও তিনি অনুধাবন করেন ঐ যাত্রা এবং এর তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর জীবনের মোড় ঘোরানোর এক চরম সন্দিক্ষন।
প্রথম শ্রেণীর টিকিটে গান্ধী ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন। অর্ধেক পথ অতিক্রম করলে সাদা চামড়ার এক ইংরেজ সাহেব অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর মতো উত্ত্যক্ত করতে গান্ধীর ট্রেনের কেবিনে ঢুকে পড়লো। এবং সেই অসভ্যটা গান্ধীকে আদেশ করলো মালগাড়ীতে চলে যেতে! গান্ধী প্রতিবাদ করলেন।
পরের স্টেশনে ঐ ইংরেজ এক পুলিশকে ডেকে ব্যাগ-পত্র সহ গান্ধীকে কঠিন অন্ধকার আর তীব্র শীতের রাতে মাঝপথে ধাক্কা দিয়ে নামায়ে দিল।
একেবারে একা। তীব্র শীতে প্রকম্পিত। অন্ধকার স্টেশনে সারা রাত কাঁপতে কাঁপতে ভোরের দেখা পেলেন গান্ধী।
লাজুক, ভীরু, মুখচোরা গান্ধী ব্যাগের মধ্যের কোট এবং গরম কাপড় বের করার কথা স্টেশন মাস্টারকে বলতে লজ্জা পেয়ে জমে বরফ হলেন।
বর্ণবাদের প্রথম নিষ্ঠুর শিকার হয়ে উপলব্ধি করলেন দক্ষিন আফ্রিকার অবস্থা।
অন্ধকারে একাকী প্রার্থনায় বসলেন গান্ধী এবং গীতার ঈশ্বরের কাছে চাইলেন সাহস ও পথের দিশা।তাঁর চেয়ে ৮ বসরের বড় রবীন্দ্রনাথের পুজা পর্যায়ের গানগুলো কি তখন প্রার্থনা সঙ্গীত হয়ে উঠেছিল? না হলেও, গান্ধীর সেই নিদারুণ মসিলিপ্ত শীতের রাত্রের প্রার্থনায় প্রকাশিত অনুভব গুলো নিশ্চয়ই এরকম ছিলঃ
“শুধু তোমার বাণী নয় গো হে বন্ধু, হে প্রিয়,
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও।
সারা পথের ক্লান্তি আমার, সারা দিনের তৃষা
কেমন করে মিটাবো যে, খুঁজে না পাই দিশা
এ আঁধার যে পূর্ণ তোমার সেই কথা বলিও
মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও।
হৃদয় আমার চায় যে দিতে কেবল নিতে নয়
বয়ে বয়ে বেড়ায় সে তাঁর যা কিছু সঞ্চয়।
হাত খানি ঐ বাড়িয়ে আরও দাওগো আমার হাতে
ধরবো তারে ভরবো তারে রাখবো তারে সাথে
একলা পথে চলা আমার করবো রমণীয়।“-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মারিতবার্গ স্টেশনে যখন রাত পোহাল ভীরু, মুখচোরা গান্ধী নতুন সূর্যোদয়ের সাথে এক নতুন গান্ধী হয়ে শক্ত মাটিতে পা রাখলেন। ক্ষীণাঙ্গী ব্যারিস্টার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণও সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন । এবার ‘না’ বলতে যাচ্ছেন। প্রতিবাদে মুখর হয়ে শুধু নিজেই না, সারা পৃথিবীকে পরিবর্তনের আভাস দিয়ে বরণ করলেন নবারুণকে।
তোমার আমার জীবনের কষ্ট, অপমান, অনাদর, অবহেলা বহু বরণীয় ব্যাক্তিদের চেয়ে অনেক অনেক তুচ্ছ। ভিতরের অহংকে, আত্মগরিমাকে, দেমাগকে, কৌলীন্যকে, বংশমর্যাদাকে, দৈহিক সৌন্দর্য্যকে, বাক্চাতুর্য্যকে গলা টিপে মেরে ফেলো। নিরহংকারী হয়ে যত্নের সাথে, সতর্ক হয়ে নীরবে পা ফেলো মাটিতে। সব দম্ভ ঘুচে যাক। তোমার মধ্য হতে নতুন তুমি’র জন্ম হোক। সাফল্যের পর মাথা উঁচু করবে। সে পর্যন্ত বিনীত থাকো।
বিজয়ের বরমাল্য তোমার নিজের হাতে পরতে হবে না, মানুষ তোমার কণ্ঠে পরাবে বিজয়ের বরমাল্য। (চলবে)
0 Comments