বাবা-মা দিবস হতে পারে সেই পশ্চিমা বিশ্বে যেখানে বলা হয়, “There is no free lunch.”
যেখানে নিদিষ্ট বয়সের অপেক্ষায় থাকে সন্তানেরা মা-বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য।
আমাদের এই পূর্ব-দেশ তথা এই উপমহাদেশে না। তবুও বানের পানির মতো ভেসে এসেছে মা-বাবা দিবস!!
আমার বাবা-মা দিবস শুরু হয় ফজরের নামাজের পর বাবা-মা’র কবর জিয়ারতের উদ্দ্যেশে ফাতেহা পাঠ ও মোনাজাতের মাধ্যমে।
মনে হয় সকালের চা খাওয়ার আগে বাবা-মা’র উদ্দ্যেশে দোয়া দুরুদ নজর নেয়াজ না করে আমার চা খাওয়া অর্থহীন।
আজ বর্ষণ মুখর সকালে খুলে বসেছিলাম বাবার পাঠানো চিঠির বান্ডিল।
বাবা সারা জীবন যত চিঠি লিখেছিলেন আমাকে আমি তা পরম যত্নে আগলে রেখেছি। হার্ড কপি গুলো সযত্নে রেখেছি। তবুও মহাকালের থাবায় তা ম্লান হতে চলেছে। সব গুলো চিঠি স্ক্যান করে, ক্লাউডে রেখেছি।
বাবা’র সমস্ত চিঠির বক্তব্য ঘুরে ফিরে একটাই ছিল,”একজন আদর্শ মানুষ হওয়া।” দুনিয়ার প্রলোভন থেকে দূরে থাকার জন্য জীবনের সেই ঊষালগ্ন থেকে নানা উদাহরণ, উপমা উৎপ্রেক্ষার মাধ্যমে বুঝায়েছেন দুনিয়ার সাথে সম্পর্কের করুন পরিণতির কথা। সেগুলো এমন ভাবে মেরু-মজ্জায় লীন হয়ে ছিল যে পথ হারানোর কথা কল্পনাও করতে পারিনি।
যদিও “নফসে-আম্মারা” তাড়িত মানুষ হিসেবে এক সময় কদাচিৎ ভুল হয়ে গেছে তৎক্ষণাৎ অনুতাপের মাধ্যমে আবার সেই বেঁধে দেওয়া কঠিন রাস্তায় ফিরে এসেছি।
আমি আমার অধিকাংশ আলোচনায় বলে থাকি যে, আজকের এই আমি আমার বাবার হাজার ভাগের এক ভাগ। তাঁকে ধারণ করার মতো যোগ্যতা আজো আমার তৈরি হয় নাই। একাকী অনেক সময় ভাবি একজন কঠিন সংগ্রামী মানুষ কি করে এতগুলো ভাষা ও এত বিষয়ে পারদর্শী হতে পারেন।
অনেক শাসন করেছেন। আজ মনে হয় যদি আরও একটু বেশী শাসন করতেন তাহলে কত না ভালো হতো। তাঁর শাসনের লগ্ন ও বিষয় ছিল অদ্ভুত!
রাত্রে খাবার খেতে বসলে সারাদিনের পড়াশুনার ভুলের সংশোধন করতেন। তাঁর আহার ছিল বিলম্বিত লয়ের বিলাসিতা যা আমারও অন্যতম অনুসংগ হয়ে উঠেছে কবে সেই জীবনের প্রভাত বেলা থেকে।
উল্লেখ্য, বাবা আমাকে প্রাইমারীতে পড়তে না দিয়ে নিজে তৈরি করে সরাসরি ক্লাস সিক্স’এ ভর্তি করেছিলেন। দেওয়া থাকতো অনেক বিষয় ও ভাষার পড়া।
তাঁর দেওয়া পড়া ঠিক মতো না করলে শাসন হিসেবে পিটানোর পরিবর্তে উচ্চারণ করতেন নজরুলের প্রেমের কবিতার দুইটা লাইন। কত কথা যে ঐ দুই লাইনের মধ্যে লুকানো থাকতো! শপথ করতাম মনে মনে যে আগামীকাল থেকে পড়া ঠিকঠাক ভাবে করবো।
উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, পড়াশুনা তাঁর মনমত না হলে বলতেন, নজরুল কি সাধে লিখেছেন,
“যে পূজা পুজিনি আমি স্রষ্টা ভগবানে,
যারে দিনু সেই পূজা, সেই আজি প্রতারণা হানে!”
অর্থাৎ, সন্তান, তোমার জন্য আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গলদঘর্ম, আর তুমি পড়াটুকু তৈরি না করে সময় নষ্ট করলে।
আমার সমস্যা হতো যখন “কাক উড়ে যায়” এটার ১২ টা ট্রান্সলেশান করতে হতো প্রথমে, বাংলায়, এর পর ইংরেজিতে, পরে আরবিতে ইত্যাদি। কিন্তু গুলায়ে ফেলতাম আরবিতে এসে কারণ আরবিতে অতীত কাল ৬ প্রকার। এদিকে এক বচন আর বহুবচন জানলেও আরবি, সংস্কৃতি’তে একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন!!
বাবার একটা শেষ ও নিখুঁত অস্ত্র ছিল, তাঁর মৃত্যুর কথা স্মরণ করায়ে দিয়ে আবৃতি করতেন,
“যেদিন আমি হারিয়ে যাবো, বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্ত পারের সন্ধ্যা তাঁরায় আমার খবর পুছবে,
বুঝবে সেদিন বুঝবে।”
আজ হাড়ে হাড়ে বুঝি তাঁর চলে যাওয়া কত বড় শূন্যতা তৈরি করেছে।
কোন কোন দিন আমাকে শাসন করতে রবীন্দ্রনাথে ভর করতেন। নিজের অনুপস্থিতির কথা বলতেন!
“বলাকা” কাব্যের ‘শাহজাহান’ কবিতার এই লাইন গুলো আবৃতি করতেন,
“মরণেরে কে রাখিতে পারে,
আকাশের প্রতি তাঁরা ডাকিছে তাহারে,
তারই নিমন্ত্রণ লোকে লোকে।”
বাবার বিশদ বিশ্লেষণে মনে হতো আমি যেন কাশ্মীরের ডাল লেকে রবীন্দ্রনাথের মতো বোটে বসে দিবাশেষে নীড়মুখী বলাকা সারি দেখতে পাচ্ছি। বাবা বলে চলেছেন, রবীন্দ্রনাথ কি করে ফিজিক্স ‘কে কাব্যে নিয়ে এলেন। পৃথিবীর সমস্ত কিছুর মধ্যের গতির সুত্র একে দিলেন। গাছ যে গতিশীল, স্থাণু না তা বোঝাতে সেই বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এলেন,
“ওগো নদী আপন বেগে পাগল পারা,
আমি স্তব্ধ চাঁপার তরু গন্ধে ভরা, তন্দ্রা হারা,
……………………………………।
আমি সদাই অচল থাকি,
গভীর চলা গোপন রাখি,
আমার চলা যায় না বলা
আমার চলা নবীন পাতায়।”
এভাবে শেক্সপিয়ার, বায়রন, মিলটন, কিটস, হোমার হয়ে শেখ সাদি, ওমর খৈয়াম, রুমি, হাফিয হয়ে কখন তলস্তয়, তুরগেনিভ, দস্তয়ভস্কির পথ ধরে মুন্সী প্রেমচাদ, আসাদুল্লাহ খান গালিব, মীর তকি মীর, ইকবাল হয়ে কালিদাসে এসে পৌঁছেছেন!
মরা কাঁটাল আর ভরা কাঁটালের মতো বাবার মেজাজের উপর নির্ভর করত কোনদিন কোন পথে তাঁর আলোচনা ধাবমান হবে। হয়তো শুরু করলেন কোরানের কোন বিশেষ নির্দেশ আলোচনা, এর সাথে হাদিস, তাঁর ভূগোল, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি আরও কত কি। সাথে শুরু হতো গীতা, উপনিষদ, ত্রিপিটক, বাইবেল, জেন্দ-আবেস্তা, গ্রন্থ সাহেব কি বলেছে ঐ বিষয়ে।
বাবা যে হাত দিয়ে আমাকে এত এত চিঠি লিখেছিলেন সেই হাত দীর্ঘ ২২ টি বৎসর অচল ছিল পক্ষাঘাতে। দেখতে অবিকল আগের সেই হাত। কোন পরিবর্তন নাই। চিমটি কাটলেও ব্যথা পেয়ে শরীর ঘুরায়ে হাত সরায়ে নিতেন, সরাসরি হাতটা সরাতে পারতেন না।
ঐ হাতের লেখা চিঠিগুলো খুলে বসি, খুঁজে পাই সান্তনা, উৎসাহ আর প্রশান্তির প্রলেপ।
কিছু কিছু চিঠি ইংরেজিতে শুরু হয়ে সংস্কৃত, উর্দু, আরবি, ফার্সি সহ নানা ভাষা ও উপদেশাবলিতে সমৃদ্ধ।
আজ মনে হোল বাবার কিছু চিঠির উপদেশাবলি শেয়ার করি। দুইটা পোস্টাল খামের একটা গুলশানে Islamic Research and Comparative Religion’এর scholar থাকা কালিন। অন্যটা সূর্যসেন হলের ঠিকানায়। তাঁর খামের বিশেষত্ব ছিল প্রেরকের ঠিকানার যায়গায় আরবিতে প্যাঁচানো সিগনেচার।
ক্রপ করা চিঠির প্রথমটার কিছু অংশে বাবা লিখেছিলেন, কোন মুসিবতে পড়লেই জায়নামাজে দাঁড়িয়ে সুরা ফাতেহা ও প্রতি রাকাতে তিন বার সুরা ইখলাস পড়ে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে। বলেছিলেন, নবী করীম (সঃ), তাঁর সাহাবারাও কঠিন বিপদে এমনই করতেন।
দ্বিতীয় ক্রপ করা অংশে বলছেন, শহীদের রক্তের চেয়ে জ্ঞানীর কলমের কালি অনেক দামী। সাথে সাথে সংস্কৃত শ্লোকটাও লিখে দিয়েছেন। জ্ঞান অর্জনের উপর তাগিত দিয়েছেন সবচেয়ে বেশী।
তৃতীয় চিঠির অংশে অর্থনীতির আলোচনা করতে যেয়ে পরামর্শ দিয়েছেন মানুষের অভাব অসীম। তাই উপার্জন বিবেচনা করে খরচ না করলে বিপদের সম্ভাবনা। আরও লিখলেন, একটা প্রশান্তির জীবন যাপন করতে চাইলে শব্দাকীর্ণ সমাজের কোলাহল থেকে দূরে নির্জন জীবন যাপন করতে হবে।
পরের চিঠির অংশে শোনালেন কোরানের সেই অমোঘ বাণী যা আমাকে এস এস সি পাশ করে বাড়ীর বাইরে পা রাখার সময় বলেছিলেন। “যত পারো দুনিয়ার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো। দুনিয়ার জীবন তো প্রতারণা, ছলনা ছাড়া আর কিছুই না।” যদিও সেই অল্প বয়সে শোনা উপদেশ কিন্তু ধীরে ধীরে তা চৈতন্যের এত গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে যে দুনিয়ার পিছনে কাঙাল হয়ে ঘুরি নাই। পরিশ্রমের ফসল হিসেবে আল্লাহ্ যা দিয়েছেন তাতেই আলহামদুলিল্লাহ্। কোন আফসোস, কোন আক্ষেপ নাই।
মোনাজাতের শেষে আল্লাহ্র কাছে কাঙ্গালের মতো বলি, “তাদেরকে মাফ করে দাও। আমাদেরকে হেদায়েত দাও।”
এখনও বাবার ভাণ্ডার নিয়ে বসলে, বা চিন্তা করতে গেলে বাবার মুখ থেকেই শেখা রবীন্দ্রনাথের গান মনের পর্দায় ভেসে ওঠে,
“তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী,
আমি অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি।”
বাবাকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন দুনিয়া থেকে নিয়ে গেছেন। এটাই অমোঘ সত্য।
আমরা দুইটা ভাই, বোনেরা চেষ্টা করেছি তাঁর খাবার, চিকিৎসা সহ অন্যান্য প্রয়োজন মনমতো পুরণ করতে।
এ বিষয়ে কোনো আক্ষেপ নেই। তবুও মাঝে মাঝে মনে হয় “কেন আরো ভালোবেসে যেতে পারেনি হৃদয়, আমি এত যে তোমায় ভালবেসেছি” ‘র মতো যদি আরও কিছু করতে পারতাম!
ওকুর রববির হাম হুমা কামা রববাইয়ানি সাগীরা।
0 Comments