বয়েসের ভারে ক্লান্ত চোরের ছেলে একদিন তার বাবার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে বাবাকে বলল যে, ”তুমি তো সারা জীবন কষ্ট করে চুরি করে আমাদেরকে লালন পালন করেছ। এখন তোমার বয়স হয়েছে। এবার তুমি বিশ্রাম নাও। তাছাড়া, এই দুর্বল শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে চুরি করেত যেয়ে ধরা পড়লে তুমিও মাইর সহ্য করতে পারবা না আর আমরাও লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবো না! তার চেয়ে বরং তুমি আমাকে চুরি বিদ্যাটা শিখায়ে দাও। এখন থেকে আমি চুরি করব আর তুমি বিশ্রাম নেবে।
চোর জানে এ বিদ্যা শেখানো কত কঠিন! বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে শুধু কেতাবি খুৎবা দিয়ে এই ট্রেড-এ সফল হওয়া যায় না। সব চুরির প্রতিটা সময় চোরকে ইমপ্রভাইজ করতে হয়। এটা তো অভিজ্ঞতার ব্যাপার। হাতে কলমে শেখার সব কিছু। গুগল করে শেখানোর কিছুই না। ইউটিউবেও কিছু নাই। সব ঋতুর, সব আমাবশ্যার, সব রাত তো একই রকম হয় না। সব গৃহীর ঘর দোরও এক রকম না। সবার ঘুমও এক রকম না।
কারো বাড়িতে পোষা কুকুর থাকে। সবার আগে সেটাকে ঘুম-পাড়ানো খাবার ছুঁড়ে দিয়ে ও নানা বাহানায় বাগে আনতে হয়। কারো বাড়িতে বৃদ্ধ মানুষ থাকে। অনিদ্রা, হাঁফানি সহ নানা ব্যামো বিমার থাকে, জেগে থাকতে হয়। কারো প্রস্টেটের সমস্যা থাকে। রাত বিরেতে বার বার বাথরুমে যেতে হয়। কারো বাতের ব্যাথায় ঘুম কম হয়। এই সব এনভায়রোনমেন্ট তো চুরির অনুকূল না।
কোন বাড়িতে ছোট বাচ্চা থাকে। রাতে খাবার, কাঁথা-কাপড় ও প্যাম্পার পালটানর জন্য মা’এর ঘুম কম থাকে। কোন বাড়িতে ছাত্র থাকে। তাদের পড়াশোনার শিডিউল অনুযায়ী প্ল্যান করতে হয়। কারো আবার শেষ রাতে পড়ার অভ্যাস থাকে। কেউ প্রেম করলেও ঐ নিশিরাতকেই বেছে নেয়।
প্রহরে প্রহরে যখন শিয়াল কুকুর পাখ-পাখালির ডাক ওঠে তখন অনেকের ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিছু আল্লাহ্র প্রিয় বান্দার “গভীর নিশিথে ঘুম ভেঙ্গে যায় কে যেন আমারে ডাকে, সেকি তুমি, সেকি তুমি সে কি তুমি?” হ্যাঁ, সে সেই মহান স্রষ্টা যিনি “কুমিল্লায়লা ইল্লা কালিলান” বলে নবী (সঃ) ‘কে আদেশ করেছিলেন রাতের কিছু অংশ বাকি থাকতে জায়নামাজে দাঁড়াতে যা তাঁর উপর ফরজ ছিল কিন্তু আমাদের জন্য নফল। সেই তাহাজ্জত পড়া মানুষেরা কখন ওঠেন তাও জানা দরকার।
কোন নব দম্পতি থাকতে পারে, জামাই আসতে পারে যাদের মনে হতে পারে,
“যাক না নিশি গানে গানে,
আজকে গানের বান এসেছে আমার মনে।“- নজরুল
আর গানের বান তো তখন এমনি আসে না। “এসট্রোজেন-প্রজেসটেরন” ফুলে ফেঁপে উঠলেই “আজি ঘুম নহে নিশি জাগরণ।‘ তাও চোরের পেশার অনুকূল না।
এর পর রয়ে গেছে প্রতিটা ঘর বাড়ীর নির্মাণ কৌশল ও শৈলী জানা। সব দিকের সব পথ ঘাট জানা। কারণ কোন অবস্থায় কি উপায় অবলম্বন করতে হবে তার জন্য এর সব কিছু জানা দরকার।
শিয়াল বেড়ালের উৎপাতে মুরগীর ডাক শুরু হলে বাড়িওয়ালার ঘুম ভেঙ্গে যেতে পারে। সে উৎপাত নিবারনের ব্যবস্থা করতে হয়। এদিক দিয়ে সাপ অনেক ভালো। সাপ মুরগীর খোপের কাছে যেয়ে হিস হিস শব্দ করলে মুরগী চুপ করে থাকে। সাপ মুরগীর বুকের নীচ দিয়ে বরফ শীতল স্পর্শ করে তাকে আয়ত্তে নিয়ে আসে। মুরগী কোন শব্দই করতে পারে না। সেই জন্য সৌখীন মুরগী চোরেরা পেঁপে গাছে ডালের দুই মুখ কেটে পাইপ বানায়ে মুরগীর খোপের কাছে যেয়ে ফুঁ দিলে মুরগী মনে করে সাপ এসেছে। এর পর সৌখীন মুরগী চোরেরা ভেজা গামছা-তোয়ালে মুরগীর পেটের নীচে ধরলে মুরগী আর শব্দ করে না। আস্তে করে মুরগী নিয়ে সন্তর্পণে বনভোজন সেরে ফেলে তারা। চোরকেও তেমনি মানুষ থেকে মুরগী সব কিছু থেকে নিজেকে হেফাজত করে তারপর কার্যসিদ্ধি করতে হয়।
এই যে এত ঝক্কি ঝামেলা তা কি কোন মার্কেটিয়ারের প্ল্যান, সট্রাটেজি তৈরি করা, প্ল্যান-এ, প্ল্যান-বি করার চেয়ে কোন অংশে কম!
চোরকে সব তথ্য উপাত্য ডাটা সংগ্রহ করতে হয়। বিগ ডাটা আন্যালাইসিস করতে হয়। তার কাস্টমার ডেমোগ্রাফি স্পষ্ট করে জানতে হয়।
চোরের ওয়রকিং আওয়ার আবার অড এবং অর্ধেক। কাজটা রাতে করতে হয় এবং মাসের কৃষ্ণ পক্ষে করতে হয়। বলতে গেলে অর্ধেকও না দুই তৃতীয়াংশ বড়জোর। কারণ কৃষ্ণা নবমী থেকে শুক্ল পক্ষ শুরুর আগ পর্যন্ত এই কয়টা দিন তার কাজের মরশুম!
প্রোডাক্টিভিটির কথা বিবেচনায় নিলে ৯-১০ দিনের বেশী এক মাসে সে কাজ করতে পারে না। অর্থাৎ অন্য কাজের লোক এক মাসে যা করে একজন চোরকে তার ৩৩% সময়ে অনেক বেশী রিস্ক কাভার করে কাজ করতে হয়।
তার ইন্ডাস্ট্রির কম্পিটিশন নিয়ে কোন আলোচনাই আমরা করি নি। শুধু তার একার কাজের সময়, পরিমাণ, পরিধি, রিস্ক ইনভল্ভড এগুলো নিয়ে আলোচনাই করেছি।
এমন যদি সুযোগ থাকতো চোর গুগল, ইউটিউব থেকে কপি করে ছেলেকে শেখাতে পারতো তাহলে ভালো হতো। কিন্তু তাতে চুরির চেয়ে অনেক বেশী রিস্ক। সব চেয়ে বড় কথা তার নিজের ছেলে। তাকে তো গুগল টাইপের ট্রেনিং দিলে হবে না। ধরা পড়ে বংশের বাতি নিভে যেতে পারে।
সমস্ত এনভাইরনমেন্ট বিবেচনা করে চোর সিদ্ধান্ত নিলো একদিন হ্যান্ডস-অন ফিল্ড ট্রেনিং দেবে ছেলেকে। সব ধরনের পরিকল্পনা করে এক কৃষ্ণা চতুর্দশীতে ছেলেকে নিয়ে চোর বের হোল চুরি করতে ও ছেলেকে চুরিবিদ্যা শিক্ষা দিতে।
ঘরে ঢুঁকে চোর ছেলেকে এক ঘরে ঢুকতে বলে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। এবং নিজে শব্দ করে সদর্পে বের হয়ে এলো।
বাড়ীর লোকজন জেগে উঠে চোর খোঁজা শুরু করলো। চোরের ছেলে ভয়ে ভয়ে কাপড় ভিজায়ে বিড়ালের ডাক ডাকতে লাগলো। বাড়ীর লোকেরা দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথে চোর পুত্র ভোঁ করে দৌড় দিলো।
সামনে চোর পিছনে বাড়ীর মহল্লার সব মানুষ ছুটেছে। ট্রেনিং না থাকলেও ‘ডিএনএ’ তো কথা বলে। দৌড়ানো অবস্থায় চোরের ছেলে একটা পাথর তুলে পথের পাশের ইঁদারায় ফেলে দিয়ে গাছের ছায়ায় লুকোলো।
ইঁদারার পানিতে ঝম করে পাথর পড়ার শব্দে সবাই বুঝল চোর এই ইঁদারার পানিতে ঝাপ দিয়েছে। সবাই মাথা নিচু করে ইঁদারার মাঝে চোর খুঁজতে লাগলো।
ইত্যবসারে চোরের ছেলে এক দৌড়ে বাড়ি এসে হাজির।
সিনিয়র চোর বসে বসে হুক্কা খাচ্ছিল। ছেলে হন্তদন্ত হয়ে হাফাতে হাফাতে বাপের পায়ের কাছে বসে পড়লো। ধাতস্ত হয়ে ছেলে বাপকে তাকে ফেলে পালায়ে আসার মতো নিষ্ঠুর কাজ করার জন্য নিন্দা মন্দ করতে লাগলো এবং তার জীবন বাচায়ে ফিরে আসার ঘটনা ন্যারেট করতে গেলো।
বাপ হুক্কায় একটা লম্বা টান দিয়ে বুকের ভিতর থেকে প্রশান্তির ধোঁয়া উদ্গিরন করতে করতে ধমক দিয়ে উৎসাহী ছেলের বয়ান বন্ধ করে দিলো।
বাপ বলল যে, রিপোর্ট করতে হবে না। তুই যে আমার সামনে জীবিত ফিরে এসেছিস এটাই আসল কথা। এটাই তোর ট্রেনিং। ছেলেকে বাপ বলল, এই পেশায় কোন চুরি নেই বাপ! সহজ পথ নেই। তোকে জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে। এর কোন বিকল্প বয়ান আমার কাছে নেই। এ জন্যেই তোকে রেখে আমি সরে এসেছিলাম।
বাপের সফল ট্রেনিং ‘এর পর ছেলে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলো।
বাপ হাতে নিলো হুক্কার নল।
0 Comments