“যদি মন কাঁদে

তুমি চলে এসো, চলে এসো

এক বরষায়।

এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে

জল ভরা দৃষ্টিতে

এসো কোমল শ্যামল ছায়।

যদিও তখন আকাশ রবে বৈরী

কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি।

উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো

ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আলো।

তুমি চলে এসো, চলে এসো

এক বরষায়।”  হুমায়ুন আহমেদ

আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন।

কদম ও শুভেচ্ছা !

ষড়ঋতুর এই দেশে বর্ষা প্রকৃতি ঘিরে যেভাবে  চপলা কিশোরী অবয়বসম লাবন্য নিয়ে আবির্ভূত হয় আর ঋতুই  এমন করে আসে না। 

বর্ষার আগমনে মানব মনে যে কাতর আবেদন সৃষ্টি হয়, আবেগে উদ্বেলিত হয়, এক আকুল আকুতি নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তন্ময় হয় তেমন আর কোন ঋতুতেই হয় না। 

কালিদাসের “মেঘদূত” থেকে একালের কবিদের পর্যন্ত সবার লেখায় মূর্ত হয়ে উঠেছে বর্ষার আবেদন।  

ময়ূরীর মতো পেখম মেলে কবি শব্দের তুলিতে একে চলেন মেঘ মেদুর স্নিগ্ধ আকাশ, বৃষ্টিধারা,  রহস্যময়  আলো-আঁধার থৈ থৈ মেঠো পথ, উতলা ফেনিল নদী, নৌকা, শাপলা শালুক আরও কত নিসর্গের নিবেদন!

অঝোর বারিধারা মনকে কখনো আনন্দে উদ্বেলিত, কখনো বেদনা কাতর করে তোলে। 

আদি যুগ হয়ে মধ্য ও আধুনিক সব যুগের সব কবি সাহিত্যিকই বর্ষা নিয়ে লিখেছেন আপনভোলা হয়ে। 

কালিদাসের “মেঘদূত”-এ কালিদাস প্রথম বর্ষার মেঘ দেখে রামগিরি পাহাড়ের ওপারে অলকাপুরির রম্য প্রাসাদে প্রিয়ার কথা মনে পড়ায় উতলা হয়ে উঠেছেন। মেঘকে অনুনয় করে বলেছেন কেয়া পাতায় লেখা তার বিরহলিপি অলকাপুরিতে পৌঁছায়ে দিতে। 

রবীন্দ্রনাথ কবি কালিদাসকে স্মরণ করে লিখেছেনঃ

“কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে

কোন্ পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

লিখেছিলে মেঘদূত! মেঘমন্দ্র শ্লোক

বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক

রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে

সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত করে।”  মেঘদূত, রবীন্দ্রনাথ।

কাজী নজরুল ইসলাম সে ছবি একেছেন এভাবেঃ

“যাও মেঘ দুত দিও প্রিয়ার হাতে,

আমার বিরহ লিপি  লেখা কেয়াপাতে। 

আমার প্রিয়ার দিরঘ নিশাসে

থির হয়ে আছে মেঘ সে দেশেরই আকাশে 

আমার প্রিয়ার ম্লান মুখ হেরি

ওঠে না চাঁদ আর সে দেশে রাতে।।” 

চণ্ডিদাসের লেখায় বর্ষা বিরহবিধুর হাহাকার হয়ে বাদল বারী আর অশ্রুতে একাকারঃ  

“এঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইল বাটে

আঙিনার মাঝে বধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরাণ ফাটে।”

মৈথিলী কবি বিদ্যাপতিও কম বিরহী ননঃ 

“এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর- 

এ ভরা ভাদর মাহ বাদর

শূন্য মন্দিরও মোর।” 

মধুসূদন দত্তের কবিতায় বর্ষা প্রকৃতির অপরূপ শক্তির প্রতীক। কবির সাথে দেবতারাও একাত্ম। 

“গভীর গর্জন করে সদা জলধর উথলিল নদ-নদী 

ধরনীর উপর রমণী রমন লয়ে সুখে কেলি করে দানবাদি 

দেব যক্ষ সুখিত অনন্তরে।”

বর্ষাকে বাদ দিলে রবীন্দ্রনাথ অনেকটা অনাথ হয়ে ওঠেন। কত না বিচিত্র রুপে তিনি দেখেছেন বর্ষার রুপ।স্বাদেশ, প্রকৃতি,প্রেম পূজা সব ক্ষেত্রেই বর্ষার মাঙ্গলিক রুপ একেছেন রবীন্দ্রনাথ। 

“বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর” কবিতায় বৃষ্টিঃ

“বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে, ছেলে বেলার গান

বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদে এল বান।

শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যার দান।” 

বর্ষার বারিধারায় অধিক ব্যাকুল হয়ে আবেগতাড়িত কবি-মন গেয়ে অথেঃ 

“এমন দিনে তারে বলা যায়

এমন ঘনঘোর বরিষায়-

এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে

তপনহীন ঘন তমসায়।”

আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছেন। বৃষ্টি দেখে পুলকিত, মেঘের ঘনঘোরে শঙ্কিত হয়েছে। তাঁর ভাবনায় বর্ষা এসেছে বিভিন্ন আঙ্গিকে, সৌন্দর্যে-সৌকর্যে। 

নজরুল ইসলামের  কবিতায়ও বর্ষা উপস্থিত নানা প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। কবিতার চেয়ে গানেই বেশী মুখর নজরুলের বর্ষাঃ

“শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে,

বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারী ঝরে।”

বা

“মেঘ মেদুর বরষায়, কথা তুমি,

ফুল বিছায়ে কাঁদে বনভুমি…

ঝুরে বারী ধারা, ফিরে এসো পথ হারা,

কাঁদে নদী জল চুমি।।”

বা

“শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এলো না,

বরষা ফুরায়ে গেল আশা তবু  গেল না।

ধানী রঙ্গ ঘাগরা, মেঘ রঙ্গ ওড়না,

পরিতে আমায় মাগো অনুরোধ করো না।

কাজরীর কাজল মেঘ পথ পেল খুজিয়া

সে কি ফেরার পথ পেল না মা, পেল না।।” 

বা 

“রিমি ঝিম রিমি ঝিম ওই নামিল দেয়া!

শুনি শিহরে কদম, বিদরে কেয়া॥

……………………………

বারি-ধারে কাঁদে চারিধার,

ঘরে ঘরে রুদ্ধ দুয়ার;

তেপান্তরে নাচে একা আলেয়া॥

কাঁদে   চখাচখি, কাঁদে বনে কেকা,

দীপ নিভায়ে কাঁদি আমি একা,

আজ  মনে পড়ে সেই মন দেয়া-নেয়া॥”

বা

“কে দুরন্ত বাজাও ঝড়ের ব্যাকুল বাঁশি।

আকাশ কাঁপে সে সুর শুনে সর্বনাশী।

……………………………………

তোমার প্রলয়-মহোৎসবে

বন্ধু ওগো, ডাকবে কবে?

ভাঙবে আমার ঘরের বাঁধন

কাঁদন হাসি।” 

বা

“সখী বাঁধো লো বাঁধো লো ঝুলনিয়া।

নামিল মেঘলা মোর বাদরিয়া॥

চলো কদম তমাল তলে গাহি কাজরিয়া

চলো লো গোরী শ্যামলিয়া॥ 

………………………………

মেঘ-বেণিতে বেঁধে বিজলি-জরিন ফিতা,

গাহিব দুলে দুলে শাওন-গীতি কবিতা,

শুনিব বঁধূর বাঁশি বন-হরিণী চকিতা,

দয়িত-বুকে হব বাদল-রাতে দয়িতা।” 

এমন অজস্র গানে বর্ষা ধরা দিয়েছে নজরুলের লেখায়।

জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বর্ষাঃ

“এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে

ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে

তার শান-স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে

ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;

এই জল ভালো লাগে; নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে

ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে- বনের ভিতর

বার বার উড়ে যায়, তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে

আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে।”

পল্লী কবি জসিমউদ্দীনের কবিতায় বর্ষাঃ 

“আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে

বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলো কেশ, মন যেন চায় কারে।”

কবি ফররুখ আহমদঃ

“বৃষ্টি এলো কাশবনে, জাগলো সাড়া ঘাসবনে

বকের সারি কোথায় রে, লুকিয়ে গেলো বাঁশবনে।

নদীতে নাই খেয়া যে,  ডাকলো দূরে দেয়া যে

কোন সে বনের আড়ালে, ফুটলো আবার কেয়া যে।”

এদিকে বর্ষা নিয়ে কবি শামসুর রাহমানঃ 

“টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়

ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়, যদি জড়ো

হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল, বৃষ্টি। অলস পেন্সিল

হাতে, বকমার্কা। পাতা জোড়া আকাশের খাঁ খাঁ নীল।”

কবি আল মাহমুদের চোখে বর্ষাঃ  

“শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলা পিছল

আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।’’

নির্মলেন্দু গুণঃ 

“আমি কতো ভালোবাসা দু’পায়ে মাড়িয়ে অবশেষে,

কল্পনা মেঘোলোক ছেড়ে পৌঁছেছি বাস্তব মেঘে।

আজ রাত বৃষ্টি হবে মানুষের চিরকাম্য দাবির ভিতরে।”

সৈয়দ শামসুল হক বর্ষার বৃষ্টিকে মনে করেছেন পবিত্র জলফোয়ারা।

“তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ,

তুমি ফিরে এসেছ তোমার বৃষ্টিভেজা খড়ের কুটিরে

যার ছায়ায় কত দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে সন্তান এবং স্বপ্ন” 

কবি মোহাম্মদ নূরুল হুদাঃ  

“বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে মনে মনে বৃষ্টি পড়ে

বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বনে বনে বৃষ্টি পড়ে

মনের ঘরে চরের বনে নিখিল নিঝুম গাঁও গেরামে

বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে।”

কবি মহাদেব সাহাঃ 

“এই যে জীবন উজাড় করে বর্ষার মেঘের মতো

তোমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছি

তুমি কখনোই তার কিছু অনুভব করলে না;

তুমি বুঝলে না এই সহস্র সহস্র চুম্বনের ব্যাকুলতা নিয়ে

আমি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি,

তোমাকে ভিজিয়ে দেওয়ার জন্য হাজার বছর ধরে

আমি মেঘ হয়েছি সমুদ্রে,

লক্ষ লক্ষ শীতরাত্রি ভেদ করে তোমার জন্য ফুটেছি গোলাপ;

তুমি বুঝলে না আমি কতকাল এই বর্ষা হয়ে আছি,

মেঘে মেঘে মল্লার হয়ে আছি তোমার জন্য

একবিন্দু অশ্রু হয়ে আছি সমস্ত প্রেমিকের চোখে।” 

কবি অসীম সাহাঃ 

“ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, মাধবী এখন তুমি বাইরে যেও না

এই করুণ বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্লান হয়ে যাবে তোমার শরীর

মাধবী বৃষ্টিতে তুমি বাইরে যেও না। মাধবী তুষারপাতে

বাইরে যেও না।” 

শেষ করবো রবীন্দ্রনাথের মেঘ বৃষ্টি বর্ষার গান দিয়েঃ 

“শাওন গগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীত যামিনী রে

কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।”

“তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,

কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা।”

“বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা

তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা।”

“ওরে ঝড় নেমে আয়

আয়রে আমার শুকনো পাতার ডালে

এই বরষায় নবশ্যামের আগমনের কালে।”

“বাদল বাউল বাজায়রে একতারা—

সারাবেলা ধ’রে ঝরো ঝরো ঝরো ধারা।”

“এসো নীপ বনে ছায়াবীথি তলে

এসো কর স্নান নবধারা জলে।”

“হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো নাচেরে

শত বরণের ভাব উচ্ছ্বাস কলাপের মতো করেছে বিকাশ

আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।”

“আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে

জানিনে জানিনে কিছুতে কেন যে মন লাগে না।”

“পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে

পাগল আমার মন জেগে ওঠে।”

“আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার

পরান সখা বন্ধু হে আমার”

প্রকৃতি প্রেম হয়ে রবীন্দ্রনাথ বর্ষা ঋতুর মধ্য দিয়ে জীবনদেবতার সাথে মিলনের আকুলতা প্রকাশ করেছেন। 

দুর্যোগের রাত্রে নির্ঘুম চোখে কবি দুয়ার খুলে বার বার বাহিরে তাকাচ্ছেন তাঁর পরান সখার সাথে সাক্ষাতের দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায়। 

কবি কল্পনা করছেন দুরের কোন এক নদীর পাড় দিয়ে গহন বনের অন্ধকারের ভিতর দিয়ে তাঁর পরান সখা পাড় হয়ে যাচ্ছেন।

আর এদিকে কবি বারে বারে দুয়ার খুলে প্রিয়তমের আসার আশায় উৎকণ্ঠিত হয়ে আছেন।

বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,

তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।

সুদূর কোন  নদীর পাড়ে, গহন কোন বনের ধারে

গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার।

পরাণ সখা বন্ধু হে আমার।” 

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *