“So the unwanting soul
sees what’s hidden,
and the ever-wanting soul
sees only what it wants.” – Lao Tzu

আমাদের চোখ দুটো আমাদের পাকস্থলীর চেয়ে বড়ো।

সমস্যাটা এখানেই। পাকস্থলী পূর্ণ হওয়ার পরও খাদ্য, সম্পদ, উপাচার জড়ো করে নিজের চারপাশে সাজায়ে রাখি। তৃপ্তির ঢেকুর তুলে ‘আরো’ জোগাড় করার জন্য পথে-বেপথে দৌড়াই। পেলে আনন্দিত হই। না পেলে আহত হই, ব্যাথিত হই, দুঃখ পাই।

জীবনে দুঃখে ও আনন্দে ‘সবর’ বা ধৈৰ্য্য ধারণ করা প্রকৃত জ্ঞানীদের জন্য অপরিহার্য্য।
অপছন্দনীয় বিষয়গুলো যেমন,অসুখ-বিসুখ, দারিদ্র, দুঃখ-কষ্ট মন্দ বলে এড়াতে চাই আমরা।

অন্যদিকে, পছন্দনীয় বিষয়গুলো যেমন, সুস্থতা, নিরাপত্তা, প্রাচুর্য্য, আনন্দ-উল্লাস মনোরম বলে এগুলো আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই। আসলে আমার জন্য কোনটা মঙ্গলজনক তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন।

তাই উভয় অবস্থায় ‘সবর’ করতে হবে। উভয় অবস্থার ‘হক’ হচ্ছে ‘সবর’। দুঃখের সময় ‘সবর’ বোঝা গেলেও সুখের সময়ের ‘সবর’ বুঝতে একটু কষ্ট হয়। দুঃখের সময় অপসন্দনীয় বিষয়গুলো কষ্ট করে সহ্য করলে আমাদের কাঙ্খিত সুখের সময় আসবে। কিন্ত সুখের সময় সবর কি? দুঃখের জন্য অপেক্ষা ??

না। দুঃখের জন্য অপেক্ষা না। উভয় অবস্থায় আমাদেরকে পরীক্ষা দিতে হয় যে, কে উভয় অবস্থায় দৃঢ় থাকতে পারে ? বিচলিত হয়ে সীমালঙ্ঘন করে না। বিশেষ করে প্রাচুর্যের সময় দিগ্বিদিগ-শুন্য দিশেহারা হয়ে পথ না হারায়। বিপদে ‘সবর’ করা বা ধৈর্য্য ধরার চেয়ে বিলাসে ও বিত্তে ‘সবর’ করা বা ধৈর্য্য ধারণ করা অনেক অনেক কঠিন।

হযরত ওমর (রাঃ) বলেছেন,”আমরা যখন বিপদে পতিত হলাম, তখন তো ‘সবর’ করলাম, কিন্ত যখন সুখ ও আরাম আয়েশে লিপ্ত হলাম, তখন ‘সবর’ করতে পারলাম না। অর্থাৎ এর ‘হক’ আদায়ে দৃঢ়পদ থাকতে পারলাম না।”

১৯৭৫/৭৬ সালে বিদেশে গেলে ২০ ইউ এস ডলার সাথে নিয়ে যাওয়া যেত। এখন ১২ হাজার ডলার নেওয়াও কোনো সমস্যা না। এটাই প্রমান করে আমাদের সক্ষমতার মাত্রা। সেই অনুযায়ী কি আমাদের মেধা ও মননে বৈদগ্ধ্য এসেছে? আমাদের ১৫ কোটি মোবাইল আছে আর আছে ১০ কোটি ইন্টারনেট। আমরা অনেকেই যে মোবাইল বা ইন্টারনেটের মালিক হলেও এর সভ্য ব্যবহার শিখিনি তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ইকোনমিকসে একটা কথা আছে,”it is easy to earn money but difficult to spend.” কিছু প্রাচুর্য্য আসায় আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দেশে বিদেশে কোথাও কিছু দেখলেই বা টেলিভিশনে দেখলেও সেটা পাবার জন্য এমন কোনো পন্থা নাই যা আমরা গ্রহণ করি না। বাথরুমে মগের পানিতে গোসলের পরিবর্তে এসেছে শাওয়ার, গিজার, বাথটাব, জ্যাকুজি, আরো কত কিসিমের প্রসাধনী !! সেটা পাবার উপযুক্ততা আছে কিনা আমার বা থাকলেও সামর্থ্য আছে কিনা বা সামর্থ্য থাকলেও গুরুত্বের মাপকাঠিতে সেটা আমার এই মুহূর্তে প্রয়োজন আছে কি না সে বিচার আমরা করিনা বা করার ক্ষমতা নাই।

“যারা কুফরী করে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর সামনে কখনও কাজে আসবে না। আর তারাই হচ্ছে দোজখের ইন্ধন।” সূরা আল-ইমরান, আয়াত-১০।

তাহলে জীবন ধরণের অতিরিক্ত আয়োজন করে রিক্ত হয়ে লাভ কি ? কি সুখ? কি মোহ? ভোগবাদ যে ভুয়া, ভোগবাদ যে জীবনে,সমাজে শান্তি আনতে পারে না,স্বস্তি আনতে পারে না ইউরোপ,আমেরিকার লাশের পাহাড় কি তা প্রমাণ করতে পারে নাই ?

মাইকেল মধুসূধনের ভাষায় বলতে হয়,

“দিন দিন আয়ু হীন,
হীন বল দিন দিন,
তবু এ আসার নেশা ছুটিল না, একি দায় !
রে প্রমত্ত মন মম! জাগিবিরে কবে,
জীবন উদ্যানে তোর যৌবন কুসুম ভাতি কতদিন রবে ?
কে না জানে, অম্বু বিম্ব অম্বু মুখে সদ্যপাতি ?-“

দুনিয়ার মহব্বত সব অনিষ্টের মূল। আপাতঃ মোহনীয় বাহ্যিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে মানুষ পরকালকে ভুলে যায়। উক্ত আয়াতের আলোকে জানতে পারি দুনিয়ার আকর্ষণীয় বস্তূ ত্রিবিধ কারণে সৃষ্টি করা হয়েছে :
১. ঐসব কাম্য বস্তূর প্রতি আল্লাহ মানুষের আকর্ষণ তৈরী করেছেন জগতের শৃঙ্খলা ও ব্যাবস্থাপনার জন্য। জগতের অস্তিত্ব ও স্থায়িত্ব এর উপর নির্ভরশীল। সংসারের জন্য মানুষ উদয়স্ত পরিশ্রম করে এই সব ক্ষণস্থায়ী বস্তূ সংগ্রহের জন্য যার অনেক কিছুই না হলেও জীবন ধারণ করা যায়। সক্রেটিসও যেমন বলেছিলেন,” How many things I can do without !! কত কিছু ছাড়াইতো আমি চলতে পারি !

২.জাগতিক নেয়ামতের প্রতি আকর্ষণ ও ভালোবাসা না থাকলে পরকালের নেয়ামতের প্রতি আকর্ষণ তৈরী হতো না। সৎ কর্ম করে জান্নাত অর্জন করা ও অসৎ কর্ম থেকে বিরত থেকে জাহান্নাম দূরে রাখার চেষ্টা করতো না মানুষ।

৩. এই আকর্ষণের মাধ্যমে পরীক্ষা নেওয়া হয়ে থাকে, ইহলোকের মোহে মত্ত হয়ে কে পরকাল ভুলে থাকে এবং কে প্রয়োজনীয়টুকু অর্জনে ব্যাপৃত থাকে এবং পরকালীন কল্যানের জন্য তার সুষ্ঠ ব্যবহার করে।

সূরা আল-ইমরানের ১৪ নং আয়াত ” মানবকুলকে মোহগ্রস্থ করেছে নারী,সন্তান-সন্ততি,রাশিকৃত স্বর্ণ-রৌপ্য,চিহ্নিত অশ্ব,গবাদি পশুরাজি, এবং খেত খামারের মতো আকর্ষণীয় বস্তূ সামগ্রী। এসবই হচ্ছে পার্থিব জীবনের ভোগ্য বস্তূ। আল্লাহর নিকটই হলো উত্তম আশ্রয়। “

ক্যাটাগরিক্যালি পার্থিব ভোগ্য বস্তূর উল্লেখ করে আল্লাহ বলে দিচ্ছেন যে এর চেয়েও উত্তম ভোগ্য বস্তূ আল্লাহর আছে। সুতরাং ক্ষণস্থায়ী সুখের প্রতি লালায়িত না হয়ে, অধিক সম্পদ কুক্ষিগত না করে অন্যকেও মান-সম্মত ভাবে বাঁচার সুযোগ দিয়ে পরকালের সুখ-সম্পদের জন্য মেহনত করা উচিত। দুনিয়ার সুখ-সম্পদের জন্য লোভী-লালায়িত হওয়া উচিত না।

লোভ হচ্ছে চিরস্থায়ী দাসত্ব।
ধনীদের মধ্যে সেরা তো সেই, যে লোভের গোলাম না।
রেশম পোকার মতো দুনিয়ার লোভের পাকে পাকে প্যাচে প্যাচে লোভী জালে আটক পড়ে।

আমাদের চিন্তা ও অনুভূতির পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন এক মহাশক্তিধর, মহাজ্ঞানী স্রষ্টা।
আনন্দের ক্ষণিক মায়ামৃগ স্বপ্ন শুধু অবোধ হতভাগাদের জন্য শোভনীয়। জ্ঞানীদের জন্য না। যে জন্য পবিত্র কোরানে বার বার বলা হয়েছে,” লাআল্লাকুম তাকেলুন” যাতে তারা বুঝতে পারে। কিন্ত কতজন আমরা বুঝতে পারলাম ? অপকর্মের জন্য তো এই মহা দুর্যোগে নিপতিত হলাম!

আপন সত্তার উর্ধতর কোনো সত্তা ছেড়ে নিম্নতর কোনো পশুত্বের স্তরে নেমে যাচ্ছিলাম আমরা। আমাদের পাপ কাঁদে না, কাঁদে আমাদের প্রাচুর্য্য। কারণ এই প্রাচুর্য্য অনেক মহৎ কাজে ব্যবহার করা যেত। কিছু তুচ্ছ পার্থিব জিনিস না থাকাকেই আমরা দুঃখ বলে ধরে নেই। আসলে উপলব্ধির স্তর অনুযায়ী দুঃখের সংজ্ঞা নানাবিধ। তার পরও সবার জীবনে একটু দুঃখ থাকা উচিৎ। কারণ জার্মান ধর্মতত্ত্ববিদ মাস্টার একহার্ট বলেন, “সব চেয়ে দ্রুত প্রাণী যে তোমাকে বয়ে নিয়ে যাবে পূর্ণতার পানে-সে হচ্ছে দুঃখ।”

প্রখ্যাত হাদিস শাস্ত্র বায়হাকী অনুযায়ী, “জ্ঞান লোভী আর সম্পদ লোভী কারো লোভই পরিতৃপ্ত হয় না।” তবে জ্ঞান লোভী বিনীত হয় এবং জ্ঞান তাকে পাহারা দেয়। অন্যদিকে সম্পদ লোভী হয় দুর্বিনীত এবং সারা জীবন তাকে সম্পদ পাহারা দিতে উৎকণ্ঠিত থাকতে হয়। উত্তম হচ্ছে পরকালে কল্যান লাভের লোভী হওয়া। অতিরিক্ত সম্পদ-লোভী না।

প্রকৃতির উপর অত্যাচার-অনাচার করে, স্রষ্টার দেখানো পথ থেকে সরে এসে, মানুষের প্রতি অমানবিক আচরণ করে কি ফল লাভ করেছি ? স্রষ্টার থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। হুবহু প্রাসঙ্গিক না হলেও শাব্দিক ভাবে নীচের বাণীগুলো কানে বাজে:

“জটিল হয়েছে যা, প্রতিকূল হলো তা
উন্মাদ তানে তানে কেটে গেছে তান
কে জানে তোমার বীণা, সুরে ফিরে যাবে কি না
নিঠুর বিধির টানে, তার ছিড়ে যায় পাছে।
কাছে ছিলে দূরে গেলে, দূর হতে এস কাছে।”

ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী রচয়িতা জ্ঞানদাস তাঁর বৈদগ্ধের কল্যানে লিখতে পেরেছিলেন,
“সুখেরও লাগিয়ে এ ঘরও বাঁধিনু অনলে পুড়িয়ে গেলো
অমিয়া সায়রে সিনানো করিতে সকলি গরল ভেল। ”
বাংলা-ব্রজবুলি-মৈথিলী ভাষার সংমিশ্রণে পদাবলী রচনা করে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়ে দিয়েছেন মানুষ সুখের জন্য অনেক আয়োজন করে কিন্ত অনেক সময়ই তা স্বার্থ হয় না। সে লেখার তাৎপর্য্য গৃহবন্দী হয়ে উপলব্ধি করছি।

চৈনিক দার্শনিক লাও জু’র কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। আড়াই হাজারেরও বেশি বৎসর আগে তিনি বলে গিয়েছিলেন, যে আত্মা কিছুর প্রত্যাশা করে না শুধু কাজ করে যায়, সে যা কিছু গোপন আছে তা সব দেখতে পায়। আর চির-কাঙাল আত্মা শুধু সেটুকুই দেখতে পায় যার স্বপ্ন সে দেখেছিলো।

সুতরং কামনা-বাসনা রহিত হয়ে নিষ্কাম-কর্ম করে যাওয়াই উত্তম। যোগ্যতা অনুযায়ী ফল আসবেই। আজ। কাল। পরশু। অবশ্যই কোনো একদিন। যেমন, এখন আমরা পাচ্ছি করোনা ভাইরাসের কল্যানে !!

কারণ প্রতিটা কর্মের সমান ও বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়া আছে। কর্ম করে আমি ভুলে যেতে পারি কিন্ত কর্ম কিছুই ভোলে না যতক্ষণ না তার উপযুক্ত কর্মফল উপস্থিত হয়।পরিণতির কথা মনে রেখে কাজ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। Begin with End in mind-Stephen Covey.

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *