“কপালকুণ্ডলা কাঁদিতে কাঁদিতে কাপালিককে কতো কথাই কহিল কিন্তু কাপালিক কিছুই কহিল না। “
বাংলা সাহিত্যে অনুপ্রাসের অন্যতম উদাহরণ উপরের বঙ্কিমীয় বাক্যটি, যেখানে ‘ক’ অক্ষরটি ১১ বার কেউ কারও সঙ্গ ছাড়ে নি,নিশীথ উর্মিমালার মতো ফেনিল হাহাকারে শঙ্কায় ত্রস্ত ছুটেছে।
আমি বিজন বনে কাপালিকের হাতে মানুষ হওয়া কপালকুন্ডলার আঁখি-নীরে ভাসার কাহিনী বলতে বসিনি।
৮ই মার্চেকে মহার্ঘ্য করে আমাদের মা-জননী-জায়াদেরকে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্মরণ করে তাদেরকে আরো অতলে নিক্ষেপ করার কুটিল ভণ্ডামি নিয়ে কিছু বলতে বসেছি।
কপালকুণ্ডলারুপী নারীরা “জনম জনম গেলো আশা পথ চাহি” র মতো আমাদের মতো কাপালিকদের কাছে সানুনয় কাঙালপনা করে করে জন্মেছেন আবার মাটিতে মিশছেন সেবা করার পরবর্তী প্রজন্ম প্রতিপালন করে। সে নারীও একই প্রক্রিয়ায় কবর বা চিতায় যাওয়ার আগে কর্তব্যে অবহেলা না করে সেবাদাসী প্রস্তূত করে নক্ষত্রলোকে বিলীন হয়েছে।
কাপালিকেরা কোনো কথা বলেনি।
পেশী-শক্তি, অর্থনৈতিক-শক্তি আর ধর্ম-শক্তি। এই ত্রিশূলে গেঁথে আমরা কাপালিকেরা নারীদেরকে সেবাদাসী থেকে উত্তরণের পথ মোহনীয় ভাবে রুদ্ধ করে রেখেছি।
নারীর অধিকার বলতে আমি কখনোই উগ্রতা, অশালীনতা বুঝাইনি। শালীনতার মধ্যে থেকে একটু মাথা তুলে বুক ভরে নিঃশাস নেওয়ার কথা বলছি। নারীর নিজেকে মানুষ ভাবতে পারার কথা বলেছি। অন্যের কাছে কিছু অর্থ কড়ির জন্যে হাত পাতার নির্লজ্জ অসহায়ত্বর কথা বলেছি। ধর্ম নারীকে যে মর্যাদায় আসীন করেছে তাঁকে সেই আসনটুকু দেওয়ার কথা বলেছি। আমাকে ভুল বোঝার কোনো অবকাশ নেই এখানে। আমাদের ধর্মে বলা হচ্ছে,”হুন্না লেবাছুকুম, ও আনতুম লেবাছুহুন্না। ” তাঁরা (নারীরা) তোমাদের পোশাক স্বরূপ আর তোমরা তাঁদের পোশাক স্বরূপ। নিশ্চয়ই এর ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা পরিধানের (বস্তূ) পোশাকের সাথে যে মমত্বের আচরণ করি, ব্যাক্তি নারীর সাথে কি সেইটুকু আচরণ অন্তত করি ? করি, তবে করিনা’র পাল্লা অনেক ভারী।
যে আমি এখন লিখছি সে একজন মমতাময়ী মা’য়ের সর্বগ্রাসী স্নেহে লালিত। জীবনের বাঁকে বাঁকে কোনো না কোনো জননীর পরোক্ষ ছোঁয়া ছাড়া এতদূর আসতে পারতাম না। আর সহধর্মিনী ? ‘আমার আঁধার ঘরের প্রদীপ’ সে না হলে কি হতো তা সন্তানদের ছোট্ট বেলায় বলতাম , “আমি একদিন ছুটি নিলে কিছুই হবে না , দুই দিন ,তিন দিন, এমনকি আমি চাকরি ছেড়ে দিলেও কিছুই হবে না অফিসের। কিন্তু তোমাদের মা একবেলা অসুস্থ হলে ? হয়তো চলবে। দুই বেলা ? একদিন, দুইদিন ? ঘর আবর্জনার স্তূপ হবে। …” ওদেরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি বাবা টাকা উপার্জন করলেই মহাভারত শুদ্ধ হয়ে যাবে না। তোমাদের জননীর ব্যাবস্থাপনা ও পরম মমতার পরশ সংসারকে ধরিত্রীর স্বর্গ বানাতে পারে।
আমরা অনেকেই সভ্য হওয়ার সাথে সাথে বিলাসিতার উপাচার বাড়াতে বাড়াতে ঘরের নারীকেও তেমনই এক বস্তূ হিসেবে বিবেচনা করতে অভ্যাস্ত হয়ে গেছি।
পরিবার থেকে, উত্তরাধিকার থেকে,ইতিহাস থেকে শিখে শিখে সেই তরিকায় চলতে চাই। আর সেই তরিকা যদি মধুর শোষণ হয় !
১৭০ বৎসর আগে ঈশ্বর গুপ্তের লেখা কবিতায় এই উপমহাদেশের পুরুষদের মানসিকতা সূর্যালোকের মতো পরিষ্কার :
“আগে মেয়েগুলো ছিলো ভালো, ব্রত-ধর্ম করতো সবে,
একা ‘বেথুন’ (বেথুন কলেজ) এসে শেষ করেছে , আর কি তাঁদের তেমন পাবে ?
যত ছুড়িগুলো তুড়ি মেরে, কেতাব হাতে নিচ্ছে যবে
তখন ‘এ বি’ শিখে , বিবি সেজে , বিলাতি বোল কবেই কবে। …..”
ওদিকে ১৮৪৫ সালে রাশিয়ায় সরকারিভাবে নারীদের নিকৃষ্টতার বিবরণ দেয়া হয় নিম্নরূপ:
” প্রকৃতই নিম্নশ্রেণীর জীব হিসেবে নারীদের সৃষ্টি করেছে পুরুষের উপর নির্ভরশীল করে। অতএব নারীদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, শাসন করা নয়, স্বামীর বশ্যতা স্বীকারই তাঁদের জন্য নিয়তি নির্ধারিত। তাঁদের আরো মনে রাখতে হবে যে , পরিবারের প্রতি তাদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেই তাঁরা পরিবারের গন্ডির মধ্যে ও তার বাইরে সুখী হতে পারেন এবং শ্রদ্ধা লাভ করতে পারেন। “
দুনিয়ার মানসিকতার ধারাবাহিকতার ধারায় আমরা এখানে। জিন’র মধ্যে তো সেই শোণিত ধারা।
GDP-তে নারীর অবদান স্বীকৃত না কারণ নারীর কাজের কোনো অর্থ মূল্য নাই। অবশ্য বুয়া-দের বা গৃহ পরিচারিকাদের আছে। আমার জানা মতে বহু শিক্ষিত চাকুরীজীবি বেতনের টাকা স্ত্রীদের হাতে দেন না। সামান্য কেউ দেন। কেউ কেউ কিছু কিছু দেন। কেন দেন না জানতে চাইলে আমি কোনো সদুত্তর পাই নি।
যাঁর যত্নে পরিপাটি ঘরে ঘুমাতে পারি। হাতের রান্না আর্সেনিকের সন্দেহ না করে খেতে পারি। সন্তান ধারণ ও লালনের (লালন সাঁই না!) মতো গুরু দায়িত্ব দিতে পারি , শুধু পারি না বেতনের সবটুকু টাকা তাঁর হাতে তুলে দিতে। কারণ দিলে তো ক্ষমতা চলে যাবে।
সুতরাং পেশী শক্তি পুরুষের আছে। অর্থ-শক্তি কূটযুক্তিতে কুক্ষিগত। “মোকসেদুল মোমেনীন” বা “স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কর্তব্য” একখানা কিনে পড়তে দিলেই সর্বময় জাগতিক ক্ষমতাতো আপনারই হাতে। “আহা আজি এ বসন্তে এতো ফুল ফোটে। ..”
আমাদের পূর্ব মহাপুরুষেরা কি করেছিলেন একটু দেখি : বঙ্কিমচন্দ্রের স্ত্রীর বয়স ছিল ৫ বৎসর। দেবেন্দ্রনাথ ও বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর স্ত্রীদের বয়স ছিল ৬ বৎসর। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রীর বয়স ছিল ৭ বৎসর। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্ত্রীর বয়স ছিল ৮ বৎসর। কেশব সেন ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রীদের বয়স ছিল ৯ বৎসর। শিবনাথ শাস্ত্রীর স্ত্রীর বয়স ছিল ১০ বৎসর। আর তালিকা লম্বা করবো না। বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয়েছিল আড়াই গুণ বেশি বয়সের দোজবরে বহুমূত্র রোগাক্রান্ত পাত্রের সাথে পাত্রীর মতামতের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে।
আলেক্স হেলি’র রুটস্ যারা দেখেছেন তারা জানেন আফ্রিকার দাসদের কি দুর্বিষহ যন্ত্রণা। তারও একটা শুরু, পরিণতি ও পরিণাম ছিল। আজো দক্ষিণ আমেরিকার আখের খেতে গেলে কান পাতলে হয়তো “ওগো সুদূর বিপুল সুদূর তুমি যে বাজাও ব্যাকুল বাঁশরী , কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সে কথা যে যাই পাশরি”র মতো যুগৎপত কালো দাসদের মর্মবেদনার সাথে আবহমান নারীর অনাহুত নাদ শুনতে পাওয়া যাবে।
আমার বাবাকে দেখতাম তাঁর গড়া হাইস্কুল, মাদ্রাসা থেকে ফেরার পথে বাড়ি লাগোয়া জঙ্গল থেকে রান্না ঘরে রান্নার জন্য কিছু খড়ি/লাকড়ি নিয়ে ঘর্মাক্ত কলেবরে উঠোনে ঢুকতেন। বাল্য-কৈশোরে দেখা সেই ম্রিয়মাণ ছবি মনে করে দেয় মায়ের প্রতি তাঁর সামর্থের, সাধ্যের সহানুভূতি।
বাবার মতো আমি পারিনি। আমার অনেক ত্রূটি, অনেক ব্যাস্ততা। তবে আমি একটা রেওয়াজ প্রচলন করেছি আমার সংসারে। মাছের মাথা মেয়েরা খাবে। পুরুষেরা অনেক খেয়েছে। (অন্যের দ্বিমত থাকলে আমি ক্ষমা প্রার্থী।) ডাইনিং এ পেয়ালায় আলাদা করে বিশেষ খাবার পুরুষের জন্য রাখার দরকার নেই, প্রয়োজন নাই। আমি আমার স্ত্রীর কাছে প্রয়োজনে টাকার জন্য হাত পাতি কারণ তিনি চাকরি করে না। আমার সমুদয় উপার্জন এই তিন দশকে আমি তাঁর হাতে দিয়েছি। সেই অর্থ এমন দক্ষ ব্যাবস্থাপনায় ব্যবহার করেছেন যে, সুন্দর ভাবে নৈমিত্তিক সংসার যাত্রা নির্বাহ করেছেন, সন্তানদেরকে আদর্শ করে গড়ে তুলেছেন, এবং আজ আমার অবসরের পর স্বাধীন প্রতিষ্ঠান চালানোর সময় তাঁর সঞ্চয়ই আমাদেরকে সুচারুভাবে চালিয়ে নিচ্ছে।
চিলির নোবেল বিজয়ী কবি পাবলো নেরুদা’র একটা কথা দিয়ে শেষ করবো ,”You can cut off roses but can not postpone Spring.” তুমি গোলাপ গুচ্ছ নির্মূল করতে পারো কিন্তু বসন্তের আগমন ঠেকাতে পারো না। যুগ যুগ বঞ্চিত ও অপদস্থ নারীরা দেখে এসেছে তাদের মায়েরা কিভাবে সহ্য করে কবরে গেছে। এখন মায়েরা যেমন সর্বস্ব দিয়ে তার কন্যাকে শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন তেমনই কন্যারাও মায়েদের দুর্দশা দেখে অবর্ণনীয় কষ্ট হলেও হাল না ছেড়ে শিক্ষা নিচ্ছে একটু মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য।
এ মাথা উঁচু প্রতিবাদের করার জন্য না, অপমান করার জন্য না, প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য না , উসৃঙ্খল হওয়ার জন্য না, বেহায়াপনা করার জন্য না। শুধু একটু মমতার জন্য, একটু সহমর্মিতার জন্য। হাত পাতার জন্য না, হাত উপুর করে প্রিয়জনকে কিছু দেওয়ার জন্য। সবচেয়ে বেশি নাড়িছেড়া ধন সন্তানকে জগতের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য। নেপোলিয়ন বোনাপার্টের কথাটা রাখার জন্য।
ইহজাগতিক সবকিছূ দেওয়ার পর স্রষ্টা পরজগতের শ্ৰেষ্ঠ ধন স্বর্গ এনে নারীর পদতলে রাখলেন আর ঘোষণা করলেন,” সন্তানের স্বর্গ জননীর পায়ের নিচে। “
(আমার দেখা সমাজের চিত্রের উপর ভিত্তি করে এ লেখা। যাঁরা আচরণে আমাদের অনেকের চেয়ে উর্ধে তাদেরকে সশ্রদ্ধ সালাম। কাউকে আঘাত করার জন্য না , বাতাসে ভাসা নারীর অশ্রূত কাঁন্নার রোল শব্দবন্দী করার প্রয়াস মাত্র আমার।)
nazar.zilani@gmail.com
0 Comments