“হিয়া সুরত-এ আদম বহুত হ্যাঁয় , আদম নেহি হ্যাঁয়।“- মীর তকি মীর

এখানে মানুষের মতো দেখতে অনেক আছে কিন্তু মানুষ নাই।

উর্দু সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি মীর তকি মীরের উপরোক্ত কথা কোন যুগের মধ্যে সীমাবদ্ধ না। সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য এ কথা।

ইতিহাসের অন্যতম খোদা প্রেমিক মনসুর হাল্লাজ যখন মারেফাতের জগতের চূড়ান্ত চূড়ায়, ফানা ফিল্লাহ থেকে বাকা বিল্লায় বিলীন তেমন সময় হাল্লাজের জনপ্রিয়তায় তাকে অজুহাত তৈরি করে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়।

মনসুর হাল্লাজের হত্যা প্রক্রিয়ার সময়ের কিছু ঘটনা প্রমাণ করে প্রেমে দেওয়ানা মনসুর হাল্লাজ কত সহজেই নিষ্ঠুর শাস্তি ও মৃত্যুকে অবহেলে বরণ করে নিতে পারলেন।

মৃত্যু দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত মনসুর হাল্লাজের দিকে  সমস্ত দর্শক পাথর ছুঁড়তে শুরু করলো।

শিবলি একটা লাল গোলাপ ছুঁড়ে মারলেন। পাথরের আঘাতে কাতর হন নাই মনসুর হাল্লাজ কিন্তু প্রিয় সহচরের ছোড়া গলাপের আঘাতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

মানুষ জানতে চাইল, ”পাথরের আঘাতে শব্দ করোনি, আর গলাপের আঘাতে দীর্ঘশ্বাস ফেললে কেন?”

প্রথমে মনসুর হাল্লাজের দুই হাত কেটে ফেলা হোল। হাল্লাজ হাসতে লাগলেন। জনতা ক্রুদ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করল,”হাসছো কেন?”

এবার তাঁর দুই পা কাটা হলো। মনসুর হাল্লাজ হাসতে লাগলেন আর বলতে লাগলেন, ”এই দুটো পা দিয়ে অনেক হেটেছি আমি পৃথিবীর পথে। আমার আরও দুই অদৃশ্য পা এখনও দুই জগতের মাঝ দিয়ে চলছে। পারলে তোমরা সেই পা দুটো কাটো।“

এবার এলো সেই মহিমান্বিত সময়। মাশুকের সাথে মিলনের পূর্বে নাগালের মধ্যের উপাচার দিয়ে নিজেকে সাজানোর জন্য আশেকের প্রাণান্ত প্রয়াস।

মনসুর হাল্লাজ রক্তাক্ত কাটা হাত দিয়ে নিয়ের মুখায়বব রঞ্জিত করলেন।

জানতে চাওয়া হল, ”কেন এমন করলেন?”

উত্তরে প্রেমিক মনসুর হাল্লাজ বল্লেন, ”শরীর থেকে অনেক রক্ত ঝরেছে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আমার চেহারা। তোমরা যদি ভাবো আমি তোমাদের দেওয়া শাস্তিতে ভয় পেয়েছি তাই চেহারায় রক্ত মাখালাম যাতে আমাকে গোলাপ রাঙ্গা দেখায়।  “অরুণ রাঙ্গা গোলাপ কলি, কে নিবি সহেলি আয়…।“  রক্তইতো নির্ভীক বীরের শ্রেষ্ঠ প্রসাধন!

মানুষ বলতে শুরু করলো, “মুখে রক্ত মাখানোর মারেফাত না হয় বুঝলাম কিন্তু অবশিষ্ট বাহু কেন রক্তে রাঙ্গালে?”

মনসুর হাল্লাজ বল্লেন, ”অজু করে নিলাম। রক্ত না হলে প্রেমের নামাজের অজু হয় না। আমি আমার মাশুকের সাথে দেখা করতে চলছি। “অহুয়াল গফুরুল ওদুদ”।  সে ক্ষমাশীল। সে প্রেমময়। সেই প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যেতে হলে রক্ত দিয়ে প্রেমের নামাজের অজু করতে হয়।“

এর পর তাঁর চোখ দুইটা উপড়ানো হলো। জনতা যখন মনসুর হাল্লাজের জিভ কাটতে উদ্যত হোল তখন তিনি বল্লেন, “আমাকে একটু কথা বলার সময় দাও। জিভ কাটলেতো আর সে কথা উচ্চারণ করে বলতে পারবো না!”

মনসুর হাল্লাজ আসমানের দিকে দুই খণ্ডিত বাহুদ্বয় তুলে বল্লেন, ”হে আল্লাহ্‌, তোমার খাতিরে ওরা আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে, তাঁর জন্য তুমি ওদের ত্যাগ করো না। তোমার দিকে চলছিলাম বলে ওরা আমার পা কেটেছে। “

এর পর জিভ কাটা হলো। সন্ধ্য প্রার্থনার সময় তাঁর মাথা কাটা হলো। শিরচ্ছেদের সময় মনসুর হাল্লাজ মৃদু হাসছিলেন।

মৃত্যুর আগে মনসুর হাল্লাজ বলে গিয়েছিলেন, ওরা আমার মৃতদেহ ছাই করে দজলা নদীতে ভাসাবে। তখন দজলার প্লাবনে বাগদাদ প্লাবিত হতে যাবে। তোমরা আমার আলখেল্লা পানির সামনে বিছিয়ে দিও, পানি আর এগুতে পারবে না। সেভাবেই ঐ প্লাবন থেকে বাগদাদ রক্ষা পেয়েছিলো।

আদম সুরতি কিছু মানুষ মনসুর হাল্লাজকে পথের কাঁটা মনে করে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে তো অমর প্রেমিক। বেহেশত দোজখের আশা না করে তিনি বেহেশত দোজখের  স্রষ্টাকে চেয়েছিলেন। সেই স্রষ্টাকে পাওয়ার জন্য তিনি হেন যন্ত্রণা নাই যা হাসি মুখে মেনে নেন নাই। সাধারণের থেকে অসাধারনের এটাই পার্থক্য। এই সাধনা ও যন্ত্রণা সাধারনের সাধ্যের বাইরে।

তৎকালীন দুনিয়া-লোভী মানুষেরাও তাকে মেনে নিতে পারে নাই। যুগে যুগে এটাই হয়। তুলসি দাসের সুন্দর একটা উপমা আছে যা এই প্রেক্ষাপটের অনুকূলঃ

“চোরহি চন্দিনি রাত ন ভারা।“  অর্থাৎ চাঁদনী রাত চোরের কখনো  ভালো লাগে না।  তাই মনসুর হাল্লাজকে রক্ত দিয়ে অজু করতে হয়েছে। “পথের কাঁটায় পায়ে রক্ত না ঝরালে কি করে এখানে তুমি আসবে।” এত সহজেই তুমি তোমার প্রেমাস্পদকে পাবে কি করে? ঝরানো রক্তের হিসাব নাও।

“তরুণ প্রেমিক প্রণয় বেদন জানাও জানাও বেদিল প্রিয়ায়………

নহে ঐ এক হিয়ার সমান হাজার কাবা হাজার মসজিদ……

অমর তাঁর নাম প্রেমের খাতায়, জ্যোতিরলেখায় রবে লেখা

দোজখের ভয় করে না সে, থাকে না সে বেহেশত আশায়।“ – নজরুল

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *