(২২শে অক্টোবর রূপসী বাঙলার কবি জীবনানন্দ দাসের প্রয়াণ দিবস। মেহেদী পাতার মতো টকটকে লাল রক্ত রঙ বুকে লালন করে আমাদেরকে দিয়ে গেছেন সবুজের সমারোহ। তাঁর স্মরণে আমার এ নিবেদন)
“আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে।“
মা কুসুমকুমারীর লেখা কবিতার মতো তাঁর ঘরেই সেই ছেলে হয়েছিল, স্বল্পবাক জীবনানন্দ।
নিঃসঙ্গ নীল নক্ষত্র। আমাদের সমাজে থেকেই উত্তরাকাশের নীল নক্ষত্রের মতো ব্যাথা-বিষের বিষাক্ত দ্যুতিতে আকাশ জুড়ে এক অপূর্ব কাব্য লিখে নিঃসঙ্গই চলে গেলেন জীবনানন্দ দাস।
রেখে গেলেন সম্পূর্ণ এক অদ্ভুত মায়াবী বুঁদ হওয়া জগত যেখানে ডুবলে পাওয়া যায় সোনালি ডানার চিলের করুণ কান্না, ঘাস ফড়িঙ, ইঁদুর, হেমন্তের কুয়াসা, খড় বিচালির মাঝে ভেঙ্গে পড়া হলুদ সোনালি রোদ আরও কত শত উপমা যা আর কোন কবির চোখে পড়েনি কখনো । নিচের পংতিগুলর মধ্যে সব চেনা উপমারা এসে ভিড় করেছে যা কেউ দেখেনি তাঁর আগেঃ
“দেখেছি সবুজ পাতা অঘ্রাণের অন্ধকারে হয়েছে হলুদ,
হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা,
ইঁদুর শীতের রাতে রেশমের মতো রোমে মাখিয়াছে খুদ,
চালের ধূসর গন্ধে তরঙ্গেরা রুপ হয়ে ঝরেছে দুবেলা,
নির্জন মাছের চোখ; পুকুরের পাড়ে হাঁস সন্ধ্যার আঁধারে,
পেয়েছে ঘুমের ঘ্রাণ- মেয়েলী হাতের স্পর্শ লয়ে গেছে তারে;”
অথবা,
“বাঙলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রুপ
খুঁজিতে যাইনাকো আর।“
অথবা,
“যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের-মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা”।
বনলতা থেকে দৃষ্টি সরায়ে একটু নাবিকের দিকে দৃষ্টি দিলে তাকে কি হাল ভাঙ্গা নাবিক জীবনানন্দ বলে মনে হয় না? সৌভাগ্য দেবী লক্ষ্মীর মতো তাঁর কাঙ্ক্ষিত নিয়তিকে ছুয়ে দেখতে পারেন নাই। কল্পনায় যখন তার দেখা পেলেন, সে যেন কবিকে বলে উঠলো, ”এত দিন কথায় ছিলেন? কবি তাকে কিন্তু অন্ধকারে দেখেছেন অর্থাৎ তার জীবনের ঘোর অমানিশায়, দুঃসহ অভাব অনটনের মাঝে কল্পনায় দেখেছেন তাঁর সৌভাগ্য দেবীকেঃ
“চুল তাঁর কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তাঁর শ্রাবস্তির কারুকার্য, অতি দূর সুমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা,
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি- দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখছি তারে অন্ধকারে, বলেছে সে, ‘এত দিন কথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন ।“
১৯২৭ সালে “ঝরা পালক” প্রকাশ করতে হোল কষ্ট করে জোগাড় করা নিজের টাকায় । রবীন্দ্রনাথ ও ধূর্জটি মুখোপধ্যায়ের কাছে বইয়ের কপি পাঠায়েও কোন প্রশংসা পাননি । একদিকে কর্মহীন, অন্যদিকে বিষাক্ত দাম্পত্য জীবনে নীলকণ্ঠ হয়ে উঠা বিষণ্ণ কবি এক ঘোরের মধ্যে দুর্দান্ত অভাব আর আসামের অবসকরা প্রেমানুভুতিতে তাঁর প্রথম বই ‘শোভনার’ নামে ‘কল্যাণীয়াশু’ বলে উৎসর্গ করলেন। কিন্তু শোভনার কাছ থেকে কোন সাড়া আর পেলেন না । ফিরে পেলেন না আসামের সেই চপলা শোভনাকে।
“নক্ষত্রেরা চুরি করে নিয়ে গেছে, ফিরায়ে দেবে না তাকে আর।“
সিটি কলেজের চাকরিটা গেল। ১৯২৯ সালের ডাইরিতে লিখলেন,”It looks like that, I shall survive to see me impotent and forgotten.” নিজের উপর জাগতিক বিষয়ে আস্থা হারায়ে ভেবেছিলেন নিজেকে অকর্মণ্য ও বিস্মৃত দেখতেই বেঁচে থাকতে হবে তাকে। মৃত্যু চিন্তা উকি দিচ্ছিল মনের কোণে ।
বেকার। মেয়ে মঞ্জুষার জন্ম। বিষাক্ত দাম্পত্য কলহ। ডাইরিতে লিখলেন, ”কি করবো? আত্মহত্যা? শীতের রাতে অন্ধকারে পুকুরে ডুবে মরব?”
সংগ্রাম করছেন বেঁচে থাকার জন্য, ধুঁকছেন আবার মৃত্যুকে নিয়ে লিখছেন এমন সব কবিতা ঃ
“অত চুপি চুপি কেন কথা কও
ওগো মরণ, হে মোর মরণ
অতি ধীরে এসে কেন চেয়ে রও,
ওগো, একি প্রণয়েরই ধরন!”
অথবা,
“কাল রাতে- ফালগুণের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।“
কাঠের ব্যাবসায়ের জন্য ফরেস্ট অফিসার চাচার কাছে আসাম যাওয়া ।বিবাহিত জীবনে চরম হতাশ জীবনানন্দের সাথে কনভেন্টে পড়া চাচাতো বোন শোভনার সাথে প্রণয়।
“বনের চাতক বাঁধল বাসা মেঘের কিনারায়,
মনের চাতক হারিয়ে গেল দুরের দুরাশায় ।“
জীবনানন্দ যতটা আগ্রাসী ছিল, শোভনা ততোটা না। শোভনা সময়কে উপভোগ করেছিল মাত্র।
“যে পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস- আকাশ তোমার।
জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছ, তবুও মৃত্যুর ব্যাথা দিতে পার তুমি।“
কাঙ্গাল হয়ে কত প্রেমের কবিতাই না লিখলেন শুধু নিজেকে নিঃসঙ্গ পেলেন ! যে হাহাকার গুঞ্জরিত হয়েছে শব্দে শব্দে আসলে তা ছিল কবির হৃদস্পন্দনের প্রতিচ্ছবি।
“সুরঞ্জনা , ঐখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ঐ যুবকের সাথে
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রূপালী আগুণ ভরা রাতে ।“
নিজের সাথে কথা বলেছেন এই নিঃসঙ্গ কবি। খুব বেশী কি চেয়েছিলেন জীবনে? একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকা আর একজন হৃদয়ের কাছের মানুষ এইতো ছিল তাঁর চাওয়া! কোনটাই পাননি।
‘আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে-
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়?”
বাবার চেষ্টায় অশ্বিনী কুমার দত্তের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দিল্লীর রামযশ কলেজের চাকরি। অন্যরা কোট, প্যান্ট, টাই পরে আসলেও জীবনানন্দ ধুতি, পাঞ্জাবী পরে পড়াতেন। ছাত্র ও সহকর্মীদের অনেক অপমান মাথায় নিয়ে চাকরিটা করে গেছেন।
সহকর্মীরা টিটকিরি দিয়েছে এই বলে যে বাঙালরা নিজ দেশে ভাত পায় না তাই এসেছে আমাদের গ্রাসে ভাগ বসাতে! নিজের যোগ্যতার মুল্যায়ন পান নি। বরং সেই কোট, প্যান্ট, টাই পরা মানুষেরা ঈশ্বরের মতো আচরণ করেছে।
“অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশী আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই- প্রীতি নেই- করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাঁদের সুপরামর্শ ছাড়া।“
মাটির উপর বেঁচে থাকার, ভাত কাপড় আর একটু মাথা গোজার ঠাইয়ের জন্য কত কিছুই না করেছেন ।ইন্সুরেন্সের দালালির কথা ভেবেছেন। বোর্ডিঙে ঢেঁড়স খেয়ে বেঁচেছিলেন। পয়সার অভাবে খবরের কাগজ বন্দ। বন্দ চা খাওয়া । ছাতার বাট বানানো বেতের ব্যাবসার কথা চিন্তা করেছেন। বাড়ি মর্টগেজের দালালির কথাও ভেবেছেন।
চাকরির জন্য ডঃ দাসের কাছে গেলে অপমান করে মুখের উপর দরজা বন্দ করে দিলে পয়সা না থাকায় হেটে বাসায় ফিরে এসেছেন। স্বর্গের পানে তাকায়ে অনুযোগ করেছেন, “আর কত??”
“ভগবান, ভগবান তুমি যুগ যুগ থেকে ধরেছ শুঁড়ির পেশা।“
“Had I been even an office typist!” আমাদেরকে দিয়ে গেছেন ‘শঙ্খচিল শালিখের বেশে’ এই বাংলায় ফিরে আসার অনুপম কবিতা আর নিজের জন্য লিখেছেন ‘আমি যদি একটা অফিসের সামান্য টাইপিস্ট হতে পারতাম’!!
তাঁর ছাত্র ইস্টবেঙ্গল রেলওয়েতে গার্ডের চাকরী দিতে চেয়েছেন। বি এম কলেজ চাকরিটা হলে একটু নিশ্বাস নিতে পেরেছেন বুক ভরে তবে তা স্থায়ী হয়নি । স্ত্রী লাবণ্যকে বি এ তে ভর্তি করে দিয়েছেন বি এম কলেজে। বেশ কাটছিল দিনগুলো ।সামসুদ্দিন আবুল কালামের মতো ছাত্রদের পেয়ে পড়াশুনা, সাহিত্য আলোচনা করে এক মনোরম সময় পার করছিলেন।
শুরু হল দাঙ্গা। দেশ ভাগ হোল। তার সাথে ভাগ হোল জীবনানন্দের কপাল ।কলকাতা পাড়ি জমালেন। বি এম কলেজের চাকরিটা গেল। বেকার হয়ে লজ্জা, দ্বিধা, সংশয় নিয়ে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন।
টাকা কামানর কৌশলটা তিনি শিখে উঠতে পারেন নাই । সংসার চালানোর দুঃসহ কষ্ট বইতে না পেরে ডাইরিতে লিখেছেন “Almost every night I thought of ending life tangled by suicide.” প্রায় প্রতি রাত্রেই গলায় দড়ি দিয়ে জীবন শেষ করে দিতে চেয়েছেন। সবাইকে নিয়ে সাগরে আত্মহত্যার চিন্তাও করেছেন।
আয়ুর হিসেব কষতে বসেছেন। ৭০ বৎসর বাঁচলে আর ২০ বৎসরের মত সময় পাওয়া যেতে পারে এর মধ্যে সব লিখে শেষ করতে হবে।
চাকরী নেই। ভাই দেয় বাড়ি ভাড়ার টাকা । নিজের টিউশনি আর লাবণ্যর বাচ্চাদের স্কুলে চাকরী থেকে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে সংকুলান।
সঞ্জয় ভট্টাচার্যকে লিখলেন, ”বেশী ঠেকে পড়েছি, সেই জন্য বিরক্ত করতে হল আপনাকে। এখুনি ৪-৫ শত টাকা দরকার। দয়া করে ব্যাবস্থা করেন। লেখা দিয়ে আপনার টাকা শোধ করে দেব”।
যুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক কলহ, মন্বন্তর সব কিছু দেখে স্পর্শকাতর কবি লিখলেন সেই বিখ্যাত পংতিগুলোঃ
“চারিদিকে বিকলাঙ্গ অন্ধ ভিড়-অলিক প্রয়াণ ।
মন্বন্তর শেষ হলে পুনরয় নব মন্বন্তর;
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে নতুন যুদ্ধের নান্দীরোল ;
মানুষের লালসার শেষ নেই;
উত্তেজনা ছাড়া কোনো দিন ঋতু ক্ষণ
অবৈধ সঙ্গম ছাড়া সুখ
অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই।“
১৯৫৩ সালে হাওড়া গার্লস কলেজের চাকরী হোল কিন্তু দুর্গতি গেল না।
১৯৫৪’র এই অক্টোবর, ট্রামের সাথে দুর্ঘটনা । দুর্ঘটনা না ঘটনা আমরা জানব না। হসপিটাল। বোন, ভাই আর ভুমেন্দ্রর সেবা। লাবণ্য কোনদিনও হসপিটালে থাকে নাই।একদিন এসে শুধু দেখে গিয়েছিল ।ব্যাস্ত ছিল সিনেমা, নাটকের শুটিং নিয়ে।
১৯৫৪ সালের ২২শে অক্টোবর রাত ১১.৩৫ মিনিটে ‘আবার আসিব ফিরে’র কবি ফিরে গেলেন নক্ষত্রলোকে।
অনেক নামী দামী মানুষেরা এলেন শেষ বিদায় জানাতে। কেন এলেন যারা আসেনি কোনদিন বা পাশে দাঁড়ায়নি মুখচোরা অভাবী কিন্তু রবীন্দ্র পরবর্তী ৩০শের দশকের কবিদের চেয়েও বলিষ্ঠ এই হতভাগা কবির পাশে?
কায়েদে আযম মোহাম্মাদ আলি জিন্নাহ অসুস্থ হলে লিয়াকত আলী খান তাকে দেখতে গিয়েছিলেন। লিয়াকত আলী খান দেখে চলে আসলে জিন্নাহ শয্যা পাশের আপনজনদেরকে বলেছিলেন,” ও কি আমাকে দেখতে এসেছিল? ও এসেছিল দেখতে যে আমি আর কতক্ষণ বেঁচে থাকব!!”
জীবনানন্দ দাসের মৃত্যুর পর যারা দেখতে এসেছিল তারা কি কবির প্রতি ভালবাসায়, সহানুভূতিতে এসেছিল না কি ভিন্ন ধারার এক শক্তিশালী কবির নিশ্চিত মৃত্যু দেখতে এসেছিল!!
যখন সবাই বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ দাসের অবদান ও অতুলনীয় সাহিত্য সম্পদ রেখে যাওয়ার কথা আলচোনা করছিল তখন লাবণ্য ভুমেন্দ্রকে বলেছিলঃ
”তোমার দাদা তাহলে বাংলা সাহিত্যের জন্য অনেক কিছু রেখে গেলেন, আমার জন্য কি রেখে গেলেন বলোতো?”
0 Comments