পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের ২১ টা কারণ উল্লেখ করে রসিক ঐতিহাসিক বলেছিলেন, প্রথম কারণ জানার পর উৎসাহী পাঠক নিশ্চয়ই পরবর্তী কারণগুলো জানতে চাইবেন না । আর সে কারণটি ছিল, “জুন মাসের অঝোর ধারায় বৃষ্টিপাতে নবাব  সিরাজুদ্দউলার পক্ষের সমস্ত গোলাবারুদ ভিজে গিয়েছিলো । যে  সেনাবাহিনির গোলাবারুদ বৃষ্টিতে ভিজে যায় তাদের যুদ্ধে পরাজয়ের বাকি কারণ জানতে চাওয়া সময়ের অপচয় মাত্র ।

আজ ৬ই আগস্ট । এই দিনে হিরোশিমাতে আণবিক বোমা বর্ষণ করে ইতিহাসের নারকীয় তাণ্ডব ঘটানো হয়েছিলো ঠুনকো অজুহাতে । এর পিছনের Hidden Agenda  বা গোপন অভিসন্ধি ছিল অন্য কিছু ।

এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের সহজে জানার জন্য হিরোশিমা- নাগাসাকিতে পরমাণু অস্ত্র ব্যাবহারের পিছনের  Hidden Agenda বা  গোপন অভিসন্ধি নিয়ে আলোচনা করবো ।

চতুর্দশ শতাব্দীর রেনেসাঁ, ১৪৯২ সালে কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার, ১৪৯৮ সালে ভাস্ক ডা গামা’র কালিকট বন্দরে অবতরণ, ১৭৭০ সালে ক্যাপ্টেন কুকের অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কার, ১৭৮৯ সালের ফরাসী বিপ্লব, ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিস্কারের হাত  ধরে প্রথম শিল্প বিপ্লব, ১৮৪৫ সালে ডঃ লিভিংস্টোন-এর আফ্রিকা আবিষ্কার, ১৮৭০সালে বিদ্যুতের আবিস্কারের মাধ্যমে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবের সূচনা পৃথিবীর সমাজ কাঠামো, অর্থনীতি, নীতি নৈতিকতা  ও মূল্যবোধের ভিত্তিমূল ধরে বিরাট ঝাকুনি দেয় ।

Dark Age-এর অবসান ও Age of Exploration শুরু হওয়ায় ক্ষমতাসীনেরা  হয়ে ওঠে কল্পনায় অদম্য ও স্বার্থে হিংস্র । কল কারখানার জন্য সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ এবং উৎপাদিত পণ্য বেশী দামে বিক্রি করে সম্পদের পাহাড় গড়ার এক দানবীয় লালসা ক্ষমতাধরদেরকে অমানুষে রূপান্তর করে । এজন্য দরকার নতুন নতুন উপনিবেশ । মেশিন ও মানুষের মধ্যে তাঁরা কোন পার্থক্য দেখতে পায় না । 

শিল্পন্নোয়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে নব্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা জার্মানীর উত্থান ফ্রান্স, ব্রিটেনের সাম্রাজ্যের জন্য নিশ্চিত হুমকি ছিল এবং এটা ঠেকানোর জন্যই ফ্রান্স-রাশিয়া-ব্রিটেন এবং সবশেষে যুক্তরাষ্ট্র একজোট হয়! এবং ৪ বছর ধরে চলা ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি নিশ্চিতের পর হাবসবুর্গ (অস্ট্রিয়ান) অটোমান (তুর্কিশ) এবং রোমানভ (রাশিয়ান) সাম্রাজ্যের মত ৩ টা শতাব্দী প্রাচীন একসময়ের প্রবল আধিপত্য বিস্তারকারী সাম্রাজ্যের পতন নিশ্চিত হয় ! রুশ সম্রাজ্য   ১৯১৭ সালে, জার্মান ও অস্ত্র-হাঙ্গেরিয়ান ১৯১৮ সালে এবং উসমানীয় সম্রাজ্য ১৯২২ সালে পতিত হয় ।  

অষ্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, এস্তনিয়া, হাঙ্গেরি, লাতভিয়া, লিথুনিয়া এবং তুরস্ক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে আবির্ভূত হয় ।  উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধিকাংশ আরব এলাকা ব্রিটিশ ও ফরাসীরা নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয় । বলশেভিকরা ১৯১৭ সালে  রাশিয়ার এবং ফ্যাসিবাদীরা ১৯২২ সালে  ইতালির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় । এ যুদ্ধের অন্য ফল হলো: ইনফ্লুয়েঞ্জায় সারা বিশ্বের ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।

১৯১৪ সালের ২৮শে জুন অষ্ট্রিয়ার রাজপুত্র ফ্রানয ফারদিনান্দ দম্পতি সারায়েভো শহরে এক সার্বিয়ান আততায়ির হাতে  নিহত হলে অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সার্বিয়াকে দায়ী করে যুদ্ধ ঘোষণা করে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ, মানবচর্মের গহীনে নিহিত এক হিংস্র দানবসত্ত্বার উপস্থিতির নিদর্শন।  ১৯১৪ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে এই ধ্বংসলীলা চলে ১৯১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ।  

চার বছরের এই যুদ্ধে, ১,৫০০ দিন ধরে প্রতিদিন ৬,০০০ মানুষ নিহত হয় । কমপক্ষে ৭৪ মিলিয়ন সৈন্য এই যুদ্ধে অংশ নেয় । মিত্রশক্তির ১৮ মিলিয়ন সৈন্য এই যুদ্ধে প্রাণ হারায় । কেন্দ্রীয় শক্তির মারা যায় প্রায় ১২ মিলিয়ন সৈন্য । অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়ে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েন বিশাল সংখ্যক মানুষ । এই মহাযুদ্ধের করালগ্রাসে বদলে যায় ইউরোপের নকশা, বদলে যায় পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস । ৪ বছর স্থায়ী এই যুদ্ধে  ৩টি সাম্রাজ্যের পতন হয়, নতুন অনেকগুলো রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং বিশ্বের মানচিত্রে এত বড় ধরনের পরিবর্তন আসে যার রেশ আমরা আজও সহ্য করছি!!!

১৮৭১ সালে জার্মানী একটি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তৎকালীন সাম্রাজ্যবাদের যুগে ১৮৯৮ সালে  এসেই তাদের উচ্চাকাঙ্খী সম্রাট, কাইজার দ্বিতীয় উইলহেইমের মনে ইউরোপের বাইরেও সাম্রাজ্য স্থাপনের খায়েশ জাগে। । অবশ্য সেই স্বপ্ন দেখার মত অবস্থানে ছিলও জার্মান অর্থনীতি এবং সামরিক শক্তি ।

অপরদিকে রাশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাসও ক্ষয়িষ্ণু অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়ান সাম্রাজ্যের এলাকায় নিজ প্রভাব বিস্তারের দিকে নজর ছিল, এবং ঘরোয়া সমস্যা অর্থাৎ তৎকালীন কম্যুনিস্ট বিপ্লব থেকে জনগণের নজর ফেরানোর জন্য এবং ক্ষমতা নিশ্চিতের জন্য একটি যুদ্ধজয় খুব ইতিবাচক মনে করে। এছাড়াও অস্ট্রিয়ার সুত্র ধরে সার্বিয়ায় জার্মান উপস্থিতি রাশিয়া একটি নিশ্চিত হুমকি স্বরূপ দেখে!

কিন্তু ফ্রান্স-ব্রিটেনকে রসদ যোগান দেয়ার অভিযোগে জার্মান সাবমেরিন যখন ৭টি যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ডুবিয়ে দেয় তখন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত যুদ্ধে যোগ দিয়ে এটাকে বিশ্বযুদ্ধ রূপ দেয়! এবং মুলত এরপরই জার্মান পরাজয় নিশ্চিত হয়!

জার্মানির যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া, রাশিয়া আক্রমণ করা ও জাপানের পার্ল হারবারে আক্রমণ করা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতি প্রকৃতিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে ।

একপক্ষে জার্মানি-অষ্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি-বুলগেরিয়া-উসমানীও সম্রাজ্য যাদেরকে কেন্দ্রীয় শক্তি বলা হতো এবং অন্য পক্ষে সার্বিয়া-রাশিয়া-যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স-জাপান-ইতালি-রুমানিয়া ও আমেরিকা যাদেরকে বলা হতো মিত্র শক্তি ।

কেন্দ্রীয় শক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় । কিন্তু বিজয়ী শক্তির বল্গাহারা আচরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর ইঙ্গিত দেয় । 

নিজের শক্তির বড়াই করে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানো জার্মানিকে জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া হয় ভার্সাই চুক্তি। জার্মানি ইউরোপে ২৫,০০০ বর্গমাইল এলাকা হারায়, তার  বাণিজ্য বন্দরগুলো বিজয়ী মিত্রশক্তিদের জন্য খুলে দেয়া হয়। ব্রিটেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামকে বিশাল পরিমাণ কয়লা, রেল ইঞ্জিন ও মোটর গাড়ি দিতে হয় জার্মানিকে। সেই সাথে যুদ্ধাপরাধের দায় হিসেবে তার উপর চাপে ক্ষতিপূরণের বিশাল বোঝা । জার্মানিকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেয়ার সকল ব্যবস্থা গৃহীত হয়। কিন্তু এই প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা জার্মানিকে চিরতরে পঙ্গু করতে পারেনি, বরং এনেছিল আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ ।

It is greatest condemnation that it contained within it the germs of a second world war.-Historian Riker

অপমানকর ভারসাই চুক্তির মধ্যেই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের বীজ নিহিত ছিল।

এ যুদ্ধ শেষ হবার ২০ বৎসর পর ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্তেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে বসে । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি তার সম্পদ, সম্মান এবং ক্ষমতার প্রায় সবটুকুই হারিয়ে বসে। এর সম্রাজ্যবাদি  চিন্তাধারার মূল কারণ ছিল জার্মানির হৃত অর্থনৈতিক, সামরিক এবং ভূমিকেন্দ্রিক সম্পদ পুণরুদ্ধার করা এবং পুণরায় একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। এর পাশাপাশি পোল্যান্ড এবং ইউক্রেনের  সম্পদসমৃদ্ধ ভূমি নিয়ন্ত্রণে আনাও একটি উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করেছে। জার্মানির একটি জাতীয় আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর সম্পাদিত ভারসাই চুক্তি হতে বেরিয়ে আসার। এরই প্রেক্ষাপটে হিটলার এবং তার নাজি বাহিনীর ধারণা ছিল যে একটি জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে সংগঠিত করা সম্ভব হবে।

শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে জাপান জার্মানীর পক্ষে অবস্থান নেয়। জার্মানী, জাপান, ইটালি, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াকে নিয়ে গড়ে ওঠে অক্ষ শক্তি। অপরদিকে আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে ডেনমার্ককে নিয়ে গড়ে ওঠে মিত্রশক্তি। টানা ছয় বছরের যুদ্ধে জাপান, জার্মানী ইটালির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি পরাজিত হয়। কিন্তু জাপান আত্মসমর্পন করতে বিলম্ব করায় জাপানকে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে, জার্মানি এবং ইতালি যখন আত্মসমর্পন করে ফেলেছে,এবং অক্ষশক্তির তিন নম্বর দেশ জাপানও প্রায় আত্মসমর্পনের মুখে তখনই হিরোশিমা নাগাশাকি তে পারমানবিক বোমা ফেলা হয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অজুহাত দেয় যে তারা নাকি দ্রুত এই বিশ্বযুদ্ধের শেষ দেখতে চাইছিল,মজার ব্যাপার হল গোটা বিশ্ব জানত যে যুদ্ধ প্রায় শেষই হয়ে গেছে এবং বিদ্ধস্ত ও বন্ধুহীন জাপানের পক্ষে এমনিতেই আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই ।

আসল কারন হল ক) যুক্তরাষ্ট্র তাদের নতুন আবিস্কৃত মারণাস্ত্রটির  কার্যকারিতা পরীক্ষা এবং প্রদর্শন করতে চাইছিল।

খ) যুদ্ধ শেষ দিকে আসার সাথে সাথে মিত্র শক্তিও পরিষ্কার দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পুর্ব ইউরোপের বেশ কিছু দেশ এবং অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলি। ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হওয়ার তা ছিল পূর্ব মুহূর্ত , মার্কিনরা সোভিয়েত কে ভয় দেখাতে চাইছিল।

আইনস্টাইনের নেতৃত্বে একদল ইহুদী বৈজ্ঞানিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্টকে একটি পত্রের মাধ্যমে জার্মানীর পূর্বেই আণবিক বোমা তৈরীতে উদ্বুদ্ধ করেন ।  জার্মানরা পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে, আর আমেরিকানরা বসে থাকবে!   ১৯৩৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আণবিক অস্ত্র তৈরি করা যায় কিনা তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য নির্দেশ দেন । ১৯৪১ সালে পরামর্শ পরিষদ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, তিন বছরের মধ্যেই দু’ধরনের আণবিক বোমা ইউরেনিয়াম বোমা ও প্লুটোনিয়াম বোমা তৈরি করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব ।


একটি ইউরেনিয়াম ও একটি প্লুটোনিয়াম বোমা তৈরি করার জন্য ১৯৪১ সালের জুন মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সমরাধিনায়ক মেজর জেনারেল লেসলি আর গ্রোভসকে প্রকল্প প্রধান করে ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’ নামে একটি উদ্যোগ চালু করে । জেনারেল লেসলি সমস্ত কর্মসূচি পরিচালনার জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করে । ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এর কার্যবিধি এমনভাবে ভাগ করে দেয়া হয় যাতে বিভিন্ন গবেষক ও প্রকৌশলীদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ তেমন সম্ভব না হয় । ‘কি জন্য কি কাজ হচ্ছে’ তথা ‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এর উদ্দেশ্য সবাই যাতে বুঝতে না পারে তার জন্য এরূপ কঠোরতা অবলম্বন করা হয়েছিলো ।

‘ম্যানহাটান প্রজেক্ট’-এর কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমিত সংখ্যকেরই কেবল পরিস্কার ধারণা ছিল কি হচ্ছে । তাদেরও সবাই জানত যে গোটা প্রকল্পের উদ্দেশ্যে হচ্ছে জার্মানীর আগেই আণবিক বোমা তৈরি করে জার্মানীর বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা ।  ১৯৪২ সালে জার্মানী তার আণবিক অস্ত্র তৈরীর কর্মসূচী পরিহার করলে মার্কিন গোয়েন্দা সূত্রে এ খবর পেয়ে যায় । কিন্ত খবরটি ‘ম্যানহাটন প্রকল্পে’ কর্মরত কাউকে ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়া হয়নি । ‘ম্যানহাটান প্রকল্পের’ গোপনীয়তা এতখানি ছিল যে, মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান পর্যন্ত জানতো না প্রকল্পটির কথা ।

জার্মানীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করার নাম করে যে আণবিক বোমা তৈরি করা হয় তা কিন্তু জার্মানীর বিরুদ্ধে ব্যবহার না করে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র পক্ষের মূল শত্রু জার্মানীর আত্মসমর্পণ করার তিন মাস পর ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে বিশ্বের প্রায় তাবৎ শক্তির বিরুদ্ধে একা লড়ে যাওয়া দেশ জাপানকে পদানত করার জন্য আদৌ আণবিক বোমার শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর অনেক বিশেষজ্ঞই নেতিবাচক আখ্যায়িত করে থাকেন ।

মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত ওয়াশিংটনের ওই বর্বর পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য নানারকম যুক্তি প্রদর্শন করা হলেও যে বিষয়টি মোটামুটি পরিস্কার হয়ে গেছে, তা হলো হিরোশিমা-নাগাসাকির আণবিক বোমার লক্ষ্য যতটা না ছিল জাপানের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা, তার চেয়ে বেশী ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ওয়াশিংটনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বির ভূমিকায় আবির্ভাব হতে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নকে মার্কিন সামরিক ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করে দেয়া । তবে এখানেও যে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায় তা হলো, ভয় পেয়ে পিছিয়ে না গিয়ে বরং নিজেদের জন্যও সে রকম অস্ত্রের মালিকানা নিশ্চিত করতে মস্কোর ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ । সে রকম পথ ধরেই অল্প দিনের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নও হয়ে দাঁড়ায় কাঙ্খিত সেই অস্ত্রের অন্যতম অধিকারী ।

বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে গবেষণার মাধ্যমে একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছিলেন। ট্রুমান এই বোমা সম্পর্কে জানতেন। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের ম্যানহাটন প্রোজেক্ট -এর গবেষণায় সৃষ্টি এই নতুন বোমা। তিনি এটির পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণের অনুমতি প্রদান করেন। সেনা কর্মকর্তারা দিনক্ষণ আর স্থান ঠিক করেন। এই মিশনের নাম দেয়া হয় ‘ট্রিনিটি’ ।

কড়া নিরাপত্তায় গ্যাজেট নামক পারমাণবিক বোমাটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোর আলামোগোরডো পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। বিজ্ঞানীগণ বেশ কয়েকবার সতর্কতার সাথে বোমাটি পরীক্ষা করে শেষ পর্যন্ত সবুজ সংকেত প্রেরণ করেন। সংকেত পাওয়ামাত্র নিরাপদ দূরত্ব থেকে পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে যেন পৃথিবী কেঁপে উঠলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন মার্কিন সেনা কর্মকর্তা টি এফ ফ্যারেল। তিনি তার সুদীর্ঘ সামরিক জীবনে এর আগে কখনো এমন কিছু দেখেননি। সেদিনের বিস্ফোরণে পুরো মাঠ জুড়ে প্রায় ৩০০  মিটার দীর্ঘ একটি খাতের সৃষ্টি হয়। নিউ মেক্সিকোর সেই অন্ধকার খাতের দিকে তাকিয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফ্যারেল বুঝতে পারেন, পৃথিবীর বুকে এক নতুন অভিশাপের আগমন ঘটেছে। সেই অভিশাপের হাত ধরে শুরু হয় এক নতুন যুগ, যার নাম পারমাণবিক যুগ ।   

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন । শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলারের কুখ্যাত ইহুদি হত্যাযজ্ঞের ফলে বহু নামিদামি বিজ্ঞানী ইউরোপ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পাড়ি জমান। দিন দিন যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকে। যুদ্ধে জয়লাভের উদ্দেশ্যে দু’পক্ষই বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে থাকে। কিন্তু কেউই সফল হতে পারছিলো না। ওদিকে দু’পক্ষের বিজ্ঞানীরাই শঙ্কিত ছিলেন । কারণ, বাতাসে গুঞ্জন উঠেছিলো যে, জার্মান বিজ্ঞানীগণ নিউক্লীয় বিদারণকে কাজে লাগিয়ে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই খবরে চিন্তিত হয়ে পড়েন বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজেভেল্টকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবগত করে পত্র প্রেরণ করেন। সেই ঐতিহাসিক পত্রে তিনি বলেন, 

সামান্য একটি পারমাণবিক বোমা যদি একটি নৌকায় করে কোনো বন্দরের নিকটে বিস্ফোরিত করা হয়, এর দ্বারা সেই বন্দরসহ এর আশেপাশের বেশ কয়েকটি শহর নিমেষেই ধ্বংস হয়ে যাবে।

রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট আইনস্টাইনের কথা তেমন আমলে নেননি। পরবর্তীতে ১৯৪১ সালে জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রমণের ফলে টনক নড়ে যুক্তরাষ্ট্রের। এবার রুজভেল্ট নড়েচড়ে বসেন। তিনি পারমাণবিক বোমা গবেষণায় যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেন। পুরো প্রকল্পের কোড নেম দেয়া হয় ‘ম্যানহাটন প্রোজেক্ট’।  যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যও এই গবেষণায় যোগ দেয়। বোমা তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়ামের খনির সন্ধানে কাজে লেগে পড়ে সবাই ।

 

দ্যা ম্যানহা টান প্রোজেক্ট ঃ প্রায় দেড় লাখ কর্মী নিয়ে গঠিত এই দলের নেতৃত্বে থাকেন রবার্ট অপেনহাইমার, লিও সাইলারড, হ্যান্স বেথ, ক্লাউড ফুক্স, রিচার্ড ফাইনম্যান । আইনস্টাইনের প্রচেষ্টায় এই প্রোজেক্ট শুরু হয়েছিলো কিন্তু তিনি এর সাথে জড়িত ছিলেন না ।

 ১৯৪২ সালের ২৮ ডিসেম্বর এই প্রকল্পের অধীনে বোমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পে বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের অবদার সবচেয়ে বেশি ছিল। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার জগতে অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী ওপেনহাইমারের অধীনে নিউ মেক্সিকোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে নির্মিত হতে থাকে বিংশ শতাব্দীর নতুন ত্রাস। প্রায় তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সফলতার মুখ দেখেন তারা। ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ট্রুমানের নিকট সুসংবাদ প্রেরণ করেন ওপেনহাইমার। তার এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ‘পারমাণবিক বোমার জনক’ হিসেবে অভিহিত করা হয় ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্র পক্ষের মূল শত্রু জার্মানীর আত্মসমর্পণ করার তিন মাস পর ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে বিশ্বের প্রায় তাবৎ শক্তির বিরুদ্ধে একা লড়ে যাওয়া দেশ জাপানকে পদানত করার জন্য আদৌ আণবিক বোমার শক্তি প্রদর্শনের প্রয়োজন ছিল কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তর অনেক বিশেষজ্ঞই নেতিবাচক আখ্যায়িত করে থাকেন ।

মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত ওয়াশিংটনের ওই বর্বর পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য নানারকম যুক্তি প্রদর্শন করা হলেও যে বিষয়টি মোটামুটি পরিস্কার হয়ে গেছে, তা হলো হিরোশিমা-নাগাসাকির আণবিক বোমার লক্ষ্য যতটা না ছিল জাপানের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত করা, তার চেয়ে বেশী ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ওয়াশিংটনের মূল প্রতিদ্বন্দ্বির ভূমিকায় আবির্ভাব হতে যাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নকে মার্কিন সামরিক ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করে দেয়া ।

তবে এখানেও যে বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা যায় তা হলো, ভয় পেয়ে পিছিয়ে না গিয়ে বরং নিজেদের জন্যও সে রকম অস্ত্রের মালিকানা নিশ্চিত করতে মস্কোর ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ । সে রকম পথ ধরেই অল্প দিনের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নও হয়ে দাঁড়ায় কাঙ্খিত সেই অস্ত্রের অন্যতম অধিকারী ।

আসলে ১৯৪১ সালে জাপান পার্ল হারবার আক্রমণের আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কয়েক বছর ধরে সমুদ্রে জাপানকে হেনস্তা করতে থাকে । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পিতভাবে জাপানকে উত্যক্ত করছিল । যাতে জাপান উত্যক্ত হয়ে বড় কিছু একটা করে । জাপান তেমন কিছু করলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা হয় সরাসরি জাপানের বিরুদ্ধে বড় আকারে যুদ্ধে নেমে যাওয়ার । পার্ল হারবার আক্রমণ করে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সে সুযোগ করে দেয় ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক অস্ত্র তৈরীতে সফলতা বিশ্বের কাউকে না জানানো হলেও (আজকের মিত্র) বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনসটন চার্চিলকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী উইনসটন চার্চিল দু’জনই ঠিক করে এই অস্ত্র সম্বন্ধে কোন কিছুই আর কোন মিত্রকে জানানো হবে না । ১৯৪৪ সালেই রুজভেল্ট-চার্চিল জুটি মিলে ঠিক করে ফেলে আণবিক বোমা তৈরি হয়ে গেলে তা ব্যবহার করা হবে জাপানের বিরুদ্ধে । রুজভেল্ট-চার্চিল জুটি কৌশল হিসেবে তাদের যুদ্ধকালীন মিত্র সোভিয়েত নেতা স্টালিনকে রাজি করায় জাপানের বিরুদ্ধে লড়তে ।

আণবিক অস্ত্র তৈরীর কর্মসূচী রুজভেল্টের আমলে শুরু হলেও ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে হঠাৎ করে মৃত্যুবরণ করায় বোমা ব্যবহার করা হয় নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করা ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের নির্দেশে । রুজভেল্টের মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পর নতুন প্রেসিডেন্ট ট্রুুম্যানের নির্দেশে আণবিক বোমা বর্ষণের লক্ষ্যস্থল নির্ধারণের জন্য কমিটি গঠিত হয় । জাপানের কোন কোন শহরে একটি ইউরোনিয়াম ও একটি প্লুটোনিয়াম বোমা বর্ষণ করা যেতে পারে সে সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করে ফেলে তারা।

এ ব্যাপারে কমিটি কয়েকটি জিনিস বিবেচনা করে ।
-শহর দুটি হতে হবে অত্যন্ত ঘন বসতি পূর্ণ
-যথাসম্ভব সমতল হতে হবে যাতে আণবিক বোমার তেজষ্ক্রিয়তা ভালভাবে ছড়াতে পারে ।

-সর্বোপরি শহর দুটি এমন হতে হবে যেখানে এর আগে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ঘটেনি, একেবারে সম্পূর্ণ অক্ষত শহর বাছাইয়ের কারণ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাতে তাদের আণবিক বোমার ধ্বংসকারিতা যাচাই করতে পারে ।
জুন মাসে নতুন একটি কমিটি আণবিক বোমা বর্ষণের জন্য আরো তিনটি নীতি যোগ করে ।
১। শহর দু’টি হতে হবে শিল্প ও কলকারখানায় সমৃদ্ধ এবং জাপানের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও ।
২। শহরের চারদিকে শ্রমিকদের প্রচুর ঘরবাড়ি থাকতে হবে।
৩। আণবিক বোমা বর্ষণ করা হবে অতর্কিতে, কোন সতর্কবাণী ছাড়াই যাতে কোন মানুষ শহর থেকে সরে কোথাও না যায় ।

ইতোমধ্যেই মার্কিন বোমার আঘাতে জাপানের ৬০টি শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। শুধুমাত্র টোকিতেই কমপক্ষে এক লাখ মানুষ বোমায় পুড়ে মারা যায় । কোনরকম ঘোষণা ছাড়া আণবিক বোমা বর্ষণের সরকারী সিদ্ধান্তে কিছু মার্কিন বিজ্ঞানী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন । তারা মার্কিন সরকারকে একটি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠনের জন্য এবং প্রকাশ্যে সবাইকে জানিয়ে আণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য অনুরোধ করলেও প্রত্যাখাত হন । বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল, বিশ্ব যদি একবার আণবিক বোমার অভূতপূর্ব ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে পায় তাহলে জাপান আমেরিকার হাতে এমন অস্ত্র আছে জেনে ভয় পেয়েই আত্মসমর্পণ করবে । বিজ্ঞানীদের যুক্তিকে অগ্রাজ্য করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের ইতোমধ্যে গৃহীত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে ।

এদিকে ‘যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত জাপান’ ইতিমধ্যে যুদ্ধ বন্দ করার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ানের সাথে আলোচনা শুরু করে । সোভিয়েত ইউনিয়ানের কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের শর্ত নিয়ে গোপন আলোচনা হচ্ছিলো । জাপানের শর্ত ছিল যে সম্রাটকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে না । আমেরিকা এই আলোচনার  খবর পেয়ে আণবিক বোমা বর্ষণের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে

জাপান সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে আত্মসমর্পণ করুক-এ ধরনের দৃষ্টান্ত মেনে নেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কষ্টদায়ক ছিল । মার্কিনরা চায়নি সোভিয়েত ইউনিয়নের মর্যাদা বেড়ে যাক এবং পূর্ব এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বৃদ্ধি পাক । এই অবস্থায় ১৯৪৫ সালের ২৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান জাপানে আণবিক বোমা বর্ষণের চূড়ান্ত নির্দেশ জারি করেন । জাপানীরা ঘুর্ণাক্ষরেও টের পায়নি যে তাদের দুটো শহরের ওপর আণবিক বোমা বর্ষণ হতে যাচ্ছে ।

জাপানী শহরে আণবিক বোমা বর্ষণের প্রস্তুুতি চলছিল ১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই । বৈমানিকরা গোপনে মহড়া চালিয়ে যাচ্ছিল ।  তারা তাদের বোমারু বিমানগুলোকে এমনভাবে রঙ করে যাতে জাপানীদের মনে হয় সেগুলো ছিল পর্যবেক্ষণকারী বিমান । ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসের মধ্যে মার্কিন বৈমানিকদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়ে যায় এবং বোমাও প্রস্তুুত থাকে ।

১৯৪৫ সালের ২ আগষ্ট নির্দেশ দেয়া হয় ৬ আগষ্ট একটি বোমা বর্ষণের জন্য । সম্ভাব্য লক্ষ্যস্থল হিসেবে শেষ পর্যন্ত বাছাই করা হয় জাপানের শহর হিরোশিমা, নাগাসাকি ও ককুরাকে । এ হিরোশিমা, নাগাসাকি ও কোকুরার মধ্যে যে দুটিতে শেষ পর্যন্ত বেশী সুবিধা হয় সে দুটিতে বোমা বর্ষণ করা হবে । এর মধ্যে কোন শহরের ওপর প্রথমে বোমা বর্ষণ করা হবে তা নির্ভর করবে ৬ আগষ্ট সকালে কোথায় আবহাওয়া সবচেয়ে ভাল থাকে তার ওপর ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে, জার্মানি এবং ইতালি যখন আত্মসমর্পন করে ফেলেছে,এবং অক্ষশক্তির তিন নম্বর দেশ জাপান ও প্রায় আত্মসমর্পনের মুখে তখনই হিরোশিমা নাগাশাকি তে পারমানবিক বোমা ফেলা হয় । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অজুহাত দেয় যে তারা নাকি দ্রুত এই বিশ্বযুদ্ধের শেষ দেখতে চাইছিল,মজার ব্যাপার হল গোটা বিশ্ব জানত যে যুদ্ধ প্রায় শেষ ই হয়ে গেছে এবং বিদ্ধস্ত ও বন্ধুহীন জাপানের পক্ষে এমনিতেই আর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষের  দিকের ঘটনা। ৬ আগস্ট বেলা আড়াইটা। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী বিশ্ব মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জাপানের হিরোশিমা শহরের ওপর লিটল বয় নামের নিউক্লিয়ার বোমা ফেলে। মুহূর্তের মধ্যে চমৎকার ঝকঝকে শহরটি পরিণত হয় মৃত্যুকূপে। লিটল বয়ের ওজন ছিল ৬০ কেজি। গন্তব্যে পৌঁছতে এটি সময় নেয় ৫৭ সেকেন্ড। এ বিস্ফোরণটি ঘটে ১৩ কিলোটন (টিএনটি)-এর সমান।

সে সময় তাপমাত্রা হয়েছিল ৩৯০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বিস্ফোরণের পর ১ মাইল ব্যাসার্ধের এলাকাজুড়ে ধ্বংসলীলা শুরু হয় এবং হিরোশিমার প্রায় ৯০ ভাগ বাড়িঘর সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। বোমা নিক্ষেপকারী পাইলট টিবেটস বিমান থেকে শহরের ভয়াবহ ধ্বংসের দৃশ্য দেখে ভয়ে-আতঙ্কে চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, হায় ঈশ্বর, এ কি করলাম !

হিরোশিমার ভয়াবহতার কারণ বুঝে ওঠার আগেই এর ঠিক তিন দিন পর জাপানেরই নাগাসাকি শহরে দ্বিতীয় বোমা ‘ফ্যাটম্যান’-এর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ কলঙ্কজনক ঘটনার নেপথ্যে ছিল অস্ত্রের উন্নয়নে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের প্রত্যাশায় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নির্লজ্জ অমানবিক প্রতিযোগিতা। যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী হিসেবে বসবাস করা হাঙ্গেরির বিজ্ঞানী ড. লিও জিলার্ড সর্বপ্রথম বোমা তৈরির উদ্যোগ নেন। এ বোমার মানবতা বিরোধী ভয়াবহতার কথা চিন্তা না করেই আইনস্টাইন জিলারডকে সাপোর্ট করেন ।

১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমায় আনুমানিক ১ লাখ ৪০ হাজার লোক মারা যান। পারমাণবিক অস্ত্রের নকশা প্রণয়নে শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ফ্যাটম্যান’ মডেল অনুসরণ করা হয়েছে। ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পর ককুরা শহরকে টার্গেট করা হয় । কিন্ত আকাশে কালো মেঘ থাকায় বিকল্প টার্গেট হয় নাগাসাকি । মেজর চার্লস সুইনে বিমানটির পাইলট ছিলেন। ১ হাজার ৬৫০ ফুট উঁচু থেকে বোমাটি নিক্ষেপ করেন। এর ক্ষমতা ছিল ৮৮ টেরাজুল বা ২১ কিলোটন ।

আকাশ মেঘে ঢাকা থাকার ফলে সঠিকভাবে লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ করা যায়নি। ফলে বোমাটি  কেন্দ্রস্থল বিচ্যুত হয় এবং হিরোশিমার তুলনায় কম ক্ষতি করে। তবুও আনুমানিক ৩৯ হাজার লোক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ ছাড়া ২৫ হাজার লোক মারাত্মক আহত হন। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে শত শত লোক আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন নাগাসাকিতে। নাগাসাকি আক্রমণের ৬ দিন পর ১৫ আগস্ট মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনণ করতে বাধ্য হয় জাপান।

পারমাণবিক বোমা লিটল বয় ছোড়ার পর পাইলট অপেক্ষা করছিলেন বোমার ভয়াবহতা দেখার জন্য। মুহূর্তে আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গেল গোটা শহর। বোমা বিস্ফোরণের পর শহরজুড়ে তৈরি হয় নীল, সাদা রঙের আলো। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুতে আগুন ধরে যায়। বিস্ফোরণের দেড় কিলোমিটারের মধ্যে যা যা ছিল সব পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। হাজার হাজার মানুষ পুড়ে মিশে গেল মাটির সঙ্গে। যারা কিছুটা দূরে ছিলেন তাদের কারও শরীরের মাংস উঠে গেল। কারও হাত-পা উড়ে গেল। কারও চোখ অন্ধ হয়ে গেল।

সবাই মিজু মিজু বা পানি পানি বলে চিৎকার করতে লাগল। বোমার আগুনের তাপে মানুষের শরীর পানিশূন্য হয়ে গেল। ৪৮ হাজার বড় বড় বাড়ি পুড়ে কয়লা হয়ে গেল। মাটির নিচের আলু পর্যন্ত পুড়ে সিদ্ধ হয়ে গেল। হিচিয়ামা নামক নদীর পানি হয়ে গেল গরম। এমনই ভয়াবহ ছিল সেই অ্যাটম  বোমা। এই বোমার আঘাতে মারা গিয়েছিল প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। আর আহত ২ লাখ মানুষ চিরদিনের জন্য হয়ে গিয়েছিল পঙ্গু ।

জাপানের কিউশো দ্বীপের এক শহর নাগাসাকি। ১৬ শতকে পর্তুগিজ নাবিকরা জাপানি মৎস্যজীবী অধ্যুষিত এ দ্বীপে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে করুণ পরিণতি ভোগ করে শহরটি। ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট সকাল ১১টা ২ মিনিটে মার্কিন বিমান বাহিনীর একটি বিমান থেকে ফ্যাটম্যান নামের পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়।

বোমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহরটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। কিছু বাড়ি উড়ে যায়, কিছু বাড়ি পুড়ে যায়। পর দিন শহরের বাড়িঘর, রাস্তাঘাট দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে এখানে মানুষ বসবাস করতে পারে। ধারণা করা হয়, প্রায় ৭৪ হাজার মানুষ তখনই মারা যায়। বোমাটি মাটি থেকে ৫০০ মিটার উপরে বিস্ফোরিত হয়। বোমার তেজস্ক্রিয়তায় শিশুদের মাথার চুল পর্যন্ত উঠে যায়। শিশুরা খাওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে আর বোমার আঘাতে আহতরা দীর্ঘদিন কষ্ট ভুগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখে পৌঁছে যায় ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন সেই বিখ্যাত কবিতাঃ

‘‌নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে ।“

এবং  ‘‌যেদিন চৈতন্য মোর’‌, এর  অবিস্মরণীয় কয়েকটি পঙ্‌ক্তিঃ  
‘‌.‌.‌.‌ মহাকালসিংহাসনে
সমাসীন বিচারক, শক্তি দাও, শক্তি দাও মোরে,
কণ্ঠে মোর আনো বজ্রবাণী, শিশুঘাতী নারীঘাতী,
কুত্‍সিত বীভত্‍সা‌ পরে ধিক্কার হানিতে পারি যেন.‌.‌.‌’‌

শিল্প বিপ্লব সৃষ্ট  লালসা, অন্যকে দমন করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার একরোখা, একগুঁয়ে জিদ সমর নায়কদেরকে অন্ধ করে ফেলেছিল । মানবিকতা বলে কিছু তাদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল না । তাদের দরকার ছিল মাটি, কাঁচামাল আর মাটির নীচে খনিজ পদার্থ । মানুষ তাদের কাছে ছিল মেশিনের মতই একটা উপাদান । সেই দুরাত্মাদের  দৌরাত্বে  থর থর কম্পমান আজো এই পৃথিবী । ঈশ্বর এদেরকে সুবুদ্ধি দান করুন । পৃথিবী আবার হয়ে উঠুক মানবিকতায় পূর্ণ আনন্দধাম ।  

Categories: Uncategorized

0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *